আমার মেয়ে স্কুলে যেতে চায় না

করোনার শুরুতে, অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চে যখন সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলো, তখন যে শিশুটি কিন্ডারগার্টেনের নার্সারিতে পড়তো, বছরের পুরো সময়টা সে ঘরে বসে থাকলো এবং প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন তার আদতে কোনো পড়ালেখাই হয়নি।

করোনার শুরুতে, অর্থাৎ ২০২০ সালের মার্চে যখন সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলো, তখন যে শিশুটি কিন্ডারগার্টেনের নার্সারিতে পড়তো, বছরের পুরো সময়টা সে ঘরে বসে থাকলো এবং প্রথম দিকে বেশ কিছুদিন তার আদতে কোনো পড়ালেখাই হয়নি।

এরপর অনলাইন ক্লাস চালু হলো। কিন্তু সেটি বুঝতে বুঝতে কিংবা কার্যকর হতে হতে সে নার্সারিতে পরীক্ষা দিয়ে কেজি ওয়ানে উঠে গেলো। যেহেতু সরাসরি ক্লাস হয়নি, সুতরাং নার্সারির কারিকুলাম সে শেষ করতে পারেনি। স্কুল থেকে সরবরাহ করা মূল্যায়ন শিটে বাসায় বসে (অভিভাবকের সহায়তায়) পরীক্ষা দিয়ে সে নার্সারি পাস করে উঠে গেলো কেজি ওয়ানে। কিন্তু নার্সারির বিরাট শূন্যতা থেকেই গেলো।

এরপর কেজি ওয়ানের পুরো সময়টাও সে ঘরবন্দি। সরাসরি ক্লাস হলো না, অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। কিন্তু সরাসরি ক্লাসেই যেখানে শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন, সেখানে সে অভিভাবকের কাছে ল্যাপটপে বা ফোনের স্ক্রিনে সমস্ত পড়া শেষ করে ফেলবে কিংবা কারিকুলাম সঠিকভাবে সম্পন্ন/আত্মস্থ করতে পারবে, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। এভাবে একদিনও স্কুলে না গিয়েও সে বছর শেষে মূল্যায়ন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে কেজি থেকে উঠে গেলো ক্লাস ওয়ানে। সঙ্গত কারণেই কেজি ওয়ানের কারিকুলামও সে শেষ করতে পারেনি। তার মানে নার্সারি ও কেজি ওয়ানের বিরাট শূন্যতা মাথায় নিয়েই সে উঠে গেলো পরের ক্লাসে।

কিন্ডারগার্টেন ভেদে ক্লাস ওয়ানের যে কারিকুলাম, ৬-৭ বছরের একটি শিশুর জন্য তা যৌক্তিক নয়। ইংরেজি মাধ্যম তো বটেই, বাংলা মাধ্যমেও। যেহেতু সে করোনার কারণে প্রায় ২ বছর স্কুলেই যায়নি বা যেতে পারেনি এবং অনলাইন ক্লাসেও যেহেতু তার আগের ২ ক্লাসের সব পড়া সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি, ফলে এখন ক্লাস ওয়ানে সরাসরি ক্লাস করতে গিয়ে সে দেখছে পাহাড় সমান কারিকুলাম।

সঠিকভাবে ইংরেজির সব অক্ষর না চিনে কিংবা ছোট ছোট শব্দ লেখা না শিখেই তাকে এখন ইংরেজি প্যারাগ্রাফ লিখতে হচ্ছে। ক্লাস ওয়ানের একটি শিশুকে কেন ইংরেজিতে প্যারাগ্রাফ লিখতে হবে? তাকে বড় বড় ইংরেজি বাক্য দিয়ে সেটির শূন্যস্থান পূরণ করতে বলা হচ্ছে। অথচ আগের ২ বছর সে কীভাবে শূন্যস্থান পূরণ করতে হয়, সেটা ভালো করে শেখারই সুযোগ পায়নি। তাদের এমন সব অংক দেওয়া হচ্ছে, যা সরকারি প্রাথমিক স্কুলের কারিকুলামের চেয়ে অনেক কঠিন। এভাবে হাত পা বেঁধে ৬-৭ বছরের একটি শিশুকে বলা হচ্ছে সাঁতার কাটো। পড়ালেখাটাকে তাদের কাছে রীতিমতো আতঙ্কের বস্তুতে পরিণত করা হয়েছে।

নিজের মেয়ের অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো লিখছি। সে রাজধানীর একটি নামকরা স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ে—যে কিনা নার্সারি ও কেজি ওয়ানের পুরো সময়টাই ছিল গৃহবন্দি এবং এই ২ ক্লাসের সব পড়া শেষ না করেই সে এখন পরের ক্লাসের বিরাট সিলেবাস নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কিত। পড়ালেখা তার কাছে এখন একটা ভুতের ভয়। আগে স্কুল থেকে এসে ব্যাগটা রেখেই সে বসে যেতো ছবি আঁকতে। এখন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দেখা যায় তার মন খারাপ। কারণ 'মিস বকা দিয়েছে'। কথিত ইংরেজি প্যারাগ্রাফ আর বড় বড় যোগ বিয়োগের চাপে আনন্দময় শৈশবকে এভাবে নিরানন্দ আর আতঙ্কের বস্তুতে পরিণত করার কী মানে আছে? আমার মেয়ে এখন স্কুলে যেতে চায় না। অথচ যখন সে প্লেতে ছিল, তখন স্কুলে যেতে না পারলেই সে বরং কান্না করতো।

কেন এই পরিস্থিতি তৈরি হলো?

যদি স্কুল কর্তৃপক্ষকে প্রশ্ন করা হয় তাহলে তারা বলবে, করোনার সময় স্কুল বন্ধ ছিল, কিন্তু অনলাইন ক্লাসে তো সব পড়ানো হয়েছে। অভিভাবকরা কেন তাদের সন্তানদের দিয়ে ওই পড়াগুলো শেষ করতে পারেননি। বস্তুত অনলাইনে ক্লাস হয়েছে খুবই সামান্য এবং সপ্তাহে ২-৩ দিন। সপ্তাহে ৫ দিন সরাসরি উপস্থিত থেকে একজন শিশু যা শিখবে, ২-৩ দিন বাসায় বসে, ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে সে একই পরিমাণ লেখাপড়া শিখে ফেলবে, এটা চিন্তা করাও বোকামি। বরং করোনার মধ্যে যেরকম কারিকুলাম সংক্ষিপ্ত করে অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হয়েছে এবং সেই আলোকে মূল্যায়ন পরীক্ষা নিয়ে পরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, করোনা শেষে সরাসরি ক্লাস চালু হলেও আগের ২ বছরের ধারাবাহিকতায় নতুন ক্লাসেও কারিকুলাম সংক্ষিপ্ত করা উচিত ছিল। কিন্তু সেটি না করে ২ বছর গ্যাপের পরে একটি বিরাট কারিকুলামের সমুদ্রে পড়ে শিশুরা হাবুডুবু খাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, করোনার সময়ে সারা দেশের মানুষ যে কী রকম আতঙ্কের মধ্যে সময় কাটিয়েছে, বিশেষ করে যাদের পরিবারে এক বা একাধিক ব্যক্তি করোনায় সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন কিংবা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, সেইসব পরিবারের অভিভাবক কী করে তাদের সন্তানদের পড়ালেখা শেষ করাবেন? নিজের কিংবা পরিবারের কেউ না কেউ করোনার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাননি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। সুতরাং এরকম একটা কঠিন ও দমবন্ধ করা পরিবেশে যে ২টি বছর কেটে গেলো, সেই সময়ে শিশুরা তাদের স্কুলের সিলেবাস সঠিকভাবে সম্পন্ন করে ফেলতে পারবে, সেটি ভাবার কোনো কারণ নেই। অথচ সেই ভাবনাটি বিবেচনায় না নিয়েই এখন তাদের সামনে পড়াশোনার বিরাট চাপ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই চাপ নিতে না পেরে শুধু আমার সন্তান নয়, পরিচিত অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জেনেছি, তাদের সন্তানরাও স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে। অথচ দীর্ঘদিন পরে স্কুলে যাওয়ার আনন্দে তাদের ‍রাতে ঘুম হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু এখন তাদের সকালে ঘুম থেকে ওঠানোই কঠিন।

তাহলে কী করা যেতো?

শিশুকে আগের ক্লাসেই রাখা যেতো। কিন্তু তাতে তারা এক বছর পিছিয়ে যেতো এবং যখন সে দেখতো যে তার সহপাঠীরা উপরের ক্লাসে পড়ে আর সে নিচের ক্লাসে, তখন এটি তার জন্য আরেকটি মনোপীড়ার কারণ হতো। সুতরাং এটি কোনো ভালো সমাধান নয়। সেক্ষেত্রে করোনার ২ বছরের অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে শিশুদের কারিকুলাম সংক্ষিপ্ত করা উচিত ছিল এবং তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝে ধীরে ধীরে পড়ালেখার পরিমাণ বাড়ানো যেতো।

সরকারি প্রাথমিক স্কুলের কারিকুলাম নিয়ে কখনো এরকম অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে না। তাহলে বেসরকারি কিন্ডারগার্টেনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ কেন? কারণ, অভিভাবকদেরও বিরাট অংশের মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, যে স্কুলে পড়ালেখার চাপ বেশি, বইয়ের সংখ্যা বেশি, যে স্কুলের শিশুদের ব্যাগ যত ভারী, সেটা তত ভালো স্কুল। অথচ হওয়ার কথা উল্টো। অর্থাৎ যে স্কুলে বইয়ের সংখ্যা যত কম, সেটা তত ভালো স্কুল।

কেন এটা হয়েছে?

কারণ শিক্ষাকে সাংবিধানিক অধিকারের বাইরে গিয়ে ব্যবসায় পরিণত করা হয়েছে। শিশুদের শৈশবও এখন 'এডুকেশন বিজনেস'-এর আওতাধীন। সে কী শিখছে, কী শিখবে, তার ব্যাগটা কত ভারী, সে স্কুলে যেতে চায় কি না—তারচেয়ে বড় প্রশ্ন বছরে তার টিউশন ফি কতো; প্রতি বছরই ভর্তির নামে তার কাছে কত টাকা নেওয়া যাচ্ছে; বই-খাতা-রং পেন্সিল-স্কুল ড্রেস ইত্যাদির নামে কত টাকা নেওয়া যাচ্ছে; স্কুলের বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, শিক্ষকের বেতনসহ নানাবিধ খাতে তার অভিভাবকের কাছ থেকে কত টাকা নেওয়া যাচ্ছে এবং সেই টাকা স্কুলে সরাসরি না গিয়েও কীভাবে অনলাইনে সহজে দেওয়া যাবে ইত্যাদি। শিশুর জন্য কারিকুলামটি আধা লিটারের বোতলে দেড় লিটার পানি ভরার অদ্ভুত ও উদ্ভট প্রচেষ্টা কি না—সেটি নিয়ে ভাবার সময় তাদের নেই।

এখন কী করণীয়?

১. কারিকুলাম ছোট করতে হবে। করোনার ২ বছরে যে গ্যাপ হয়েছে সেটা পূরণ করতে হবে। একজন শিশু সর্বোচ্চ কতটুকু ধারণ করতে পারবে, সেটা বুঝে তার উপর পড়ালেখার চাপ তৈরি করতে হবে।

২. করোনার ২ বছরে শিশুদের পড়ালেখায় কী পরিমাণ শূন্যতা তৈরি হয়েছে এবং সেই শূন্যতা পূরণে কী করা যায়, সে বিষয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের বসতে হবে। একসঙ্গে সবাইকে নিয়ে বসা সম্ভব না হলেও ধারাবাহিকভাবে বসতে হবে। সেই বৈঠকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদেরও রাখা যেতে পারে যাতে তারা নোট নিতে পারেন।

৩. সরকার এখন 'ব্লেন্ডেড লার্নিং'য়ের কথা বলছে। অর্থাৎ ক্লাসে সরাসরি পড়ানো হবে আবার সেই ক্লাসটি অনলাইনেও থাকবে। যাতে করে বাসায় বসে শিক্ষার্থীরা ক্লাসটি দেখতে পারেন। অভিভাবকরাও দেখতে পারেন। অর্থাৎ ব্লেন্ডেড লার্নিং পদ্ধতিটা এখনই চালু করা দরকার। অন্তত শিশু শ্রেণিগুলোতে।

৪. সরকারের উচিত হবে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সকল বেসরকারি স্কুলের কারিকুলাম পরীক্ষা করিয়ে ত্রুটিবিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো শোধরানোরা জন্য সময় বেঁধে দেওয়া। যেসব স্কুল তা মানবেন না, সেগুলোর বিরুদ্ধে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিতে হবে।

৫. পড়ালেখা যে আতঙ্কের নয়, বরং আনন্দের বিষয়; শিক্ষা যে পণ্য বা বাণিজ্য নয় বরং সাংবিধানিক অধিকার, সে বিষয়টি আগে স্কুল কর্তৃপক্ষ, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের বুঝতে হবে। এটা বুঝানোর জন্য সরকারকেও দায়িত্ব নিতে হবে।

সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, পড়ালেখার নামে আতঙ্ক নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশু ভবিষ্যতে এই সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য শুধু আতঙ্কই তৈরি করবে। পড়ালেখার চাপে সে হয়তো কিছু সার্টিফিকেটের মালিক হবে, কিন্তু তাকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সর্বোপরি পরিবার কী ভূমিকা পালন করছে, সেই প্রশ্নটিই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments