শফিকুলের ফিরে আসা

শফিকুল
মাতৃভূমির টানে ৩০ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরে কৃষিকাজ শুরু করেছেন ৭০ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

'ফিরে চল, ফিরে চল, ফিরে চল মাটির টানে-যে মাটি আঁচল পেতে চেয়ে আছে মুখের পানে'-- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গানের এই কথাগুলোই যেন হৃদয়ে ধারণ করেছেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার চকতৈল গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী শফিকুল ইসলাম জুয়েল।
 
জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে যে দেশ মাতৃকাকে স্বাধীন করেছিলেন, বুকভরা অভিমান নিয়ে একদিন প্রিয় সে দেশটি ছেড়েই চলে গিয়েছিলেন সুদূর মার্কিন মুল্লুকে। কিন্তু চলে গেলেই কি আসলে চলে যাওয়া হয়? শেকড়ের টান যে রয়েই যায়।

আর এ টানেই ৩০ বছরের প্রবাসী জীবনের অবসান ঘটিয়ে আপনজনদের ছেড়ে শফিকুল ফিরে এসেছেন নিজ দেশের মাটিতে। গ্রামে ফিরে শুরু করেছেন কৃষিকাজ।

শফিকুল ইসলাম জুয়েল। ছবি: সংগৃহীত

ছাত্র অবস্থায় দেশকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সরকারি চাকরিজীবী বাবার ছয় ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে ষষ্ঠ শফিকুল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অস্ত্র ছেড়ে আবার হাতে তুলে নিয়েছিলেন বইখাতা।

পড়ালেখা শেষে মন দেন আয়-রোজগারে। নিজেই একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান খুলে শুরু করেন করে ঠিকাদারি ব্যবসা। বিয়ে করে সুখেই কাটছিল জীবন।

কিন্তু একদিন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের বাধা পেয়ে মনের দুঃখে সিদ্ধান্ত নেন আর থাকবেন না এ দেশে। চলে যান আমেরিকার নিউইয়র্কে। পরে স্ত্রী সন্তানদেরও নিয়ে যান সেখানে।

শফিকুলের পারিবারিক ছবি। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ষষ্ঠ। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

জীবিকার তাগিদে সেখানে অনেক কিছুই করেছেন শফিকুল। চাকরি করেছেন দোকানের সেলসম্যান, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ম্যানেজার হিসাবে। আয় বাড়াতে চালিয়েছেন ট্যাক্সিক্যাব।

ইতোমধ্যে লেখাপড়া শেষ করে সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান তার সন্তানরা। বৃদ্ধ বয়সে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগে আক্রান্ত হন শফিকুল। চিকিৎসার পাশাপাশি তখন তার কাজ হয় বাড়িতে বসে থাকা আর সমবয়সীদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া।

এমন অবস্থায় শফিকুল সিদ্ধান্ত নেন, বিদেশ বিভূঁইয়ে আর নয়। এবার ফিরে যাবেন নিজের দেশে। কিন্তু তার এ ইচ্ছায় বাধ সাধেন স্ত্রী ও মেয়েরা। তাদের যুক্তি, অসুস্থ শরীরে একা দেশে ফিরে গেলে কী অবস্থা হবে তার।

উপায়ান্তর না দেখে একদিন স্ত্রী কন্যাদের ডেকে বলেন, 'হয় তোমরা আমাকে দেশে ফিরে যেতে দেবে। আর না হলে রেললাইনে আমাকে মৃত অবস্থায় পাবে।'

শফিকুল
গ্রামে ফিরে পৈতৃক ভিটা পরিষ্কার করে বাড়ির সামনে গড়ে তুলেছেন ফলের বাগান। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

এ কথা শুনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হন তারা। ২০২০ সালে তাদের রেখে একাই দেশে ফিরে আসেন শফিকুল।
 
যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের চাকচিক্যপূর্ণ জীবন ফেলে কেন ফিরে এলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে শফিকুল দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সেখানে কোনো ফুলেই গন্ধ নেই। সেখানে ট্যাক্সি ক্যাব চালানোও অনেক পরিশ্রমের কাজ। আর শেষ বয়সে তো কেউ কোনো কাজেই নিচ্ছিল না আমাকে।'

'আমার ইংরেজি শুনেই আমেরিকানরা সহজেই বুঝে ফেলত যে আমি সে দেশে ইমিগ্র্যান্ট। ওরা বলতো, এটাতো তোমার দেশ নয়। কেন এসেছ এখানে। তখন খুবই অপমান বোধ হতো,' বলেন তিনি।

গ্রামে ফিরে পৈতৃক ভিটা পরিষ্কার করে কাজে লেগে পড়েন শফিকুল। বাড়ির সামনের জমিতে গড়ে তোলেন মিশ্র ফলের বাগান। অন্যান্য পতিত জায়গাগুলোতে তৈরি করেন লেবুসহ বিভিন্ন ফল-সবজির বাগান। ধান চাষ করেন বেশ কয়েক বিঘা জমিতে। দৈনিক মজুরিতে কাজে নেন ডজনখানেক গ্রামবাসীকে।

দৈনিক মজুরিতে গ্রামবাসীদের কাজে নেন তিনি। ছবি: মির্জা শাকিল/স্টার

কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের অংশ হিসেবে কেনেন নানা যন্ত্রপাতি। বসত বাড়ির একটি ঘরকে পরিণত করেন ওয়্যারহাউজে। সার, কীটনাশক থেকে কী নেই সেখানে। ইন্টারনেট ঘেঁটে আধুনিক কৃষি কলাকৌশল ব্যবহারের পাশাপাশি সেগুলো শিখিয়ে দিচ্ছেন গ্রামের অন্য কৃষকদেরও।  

অবাক বিস্ময়ে বৃদ্ধ শফিকুলের এসব কাণ্ড-কারখানা দেখেন গ্রামের মানুষ।

তিনি বলেন, 'শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে দেশে ফিরেছিলাম। দেশে ফিরে আমার অসুস্থতা অর্ধেক কমে গেছে। এখন সকাল হলে গ্রামের রাস্তায় হাঁটি। কী যে ভাল লাগে বলে বোঝাতে পারব না।'  

'বাবা-মা অনেক আগেই মারা গেছেন। আট ভাইবোনের মধ্যে এখন বেঁচে আছি চারজন। তারা সবাই দেশ-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে থাকেন। এখানে তাই আমি একাই থাকি। কম্পিউটার-ইন্টারনেট সব কিছু আছে। এখানে বসেই যোগাযোগ করতে পারি স্ত্রী, কন্যাসহ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে,' বলছিলেন তিনি।

ছবি তোলার শখ আছে শফিকুলের। আছে আধুনিক মডেলের দুটি ডিএসএলআর ক্যামেরা। অবসরে ঘুরে ঘুরে ছবি তোলেন তিনি।

তার সঙ্গে কাজ করেন গ্রামের দিনমজুর সাইফুল। শফিকুল সম্পর্কে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'তিনি অনেক ভালো একজন মানুষ। ব্যবহারও অনেক অমায়িক। কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আমাদের মজুরি পরিশোধ করে দেন। তাই তার সঙ্গে কাজ করে আমরাও অনেক খুশি।'

ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, 'আর ৫ বছর যদি বাঁচি, তবে গ্রামকে ঘিরে আমার সব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে পারব। আমি চাই ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে। কারণ এখানেই তো তাদের শেকড়। পেশাগত জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও আমার মেয়েরা এখনো বিয়ে করেনি। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে আমার স্ত্রী এখানে চলে আসবে। এখানে আমার জীবন তখন আরো ভালো কাটবে আশা করি।'

যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে যেতে আমাদের মতো দেশের মানুষ পাগল, আর আপনি সেখান থেকে একেবারে চলে এলেন, এ কথা বলতে স্মিত হেসে শফিকুলের জবাব, 'শুধু আমি ফিরে এসেছি বলেই নয়, সবারই ফিরে আসা উচিত। নিজের দেশে ফিরে এখানেই তাদের কিছু করা উচিত।' 

'এ দেশের মাটি অনেক উর্বর। পরিকল্পনা করে চাষবাস করতে পারলেও অনেক লাভজনক হয়। অযথাই এত টাকা খরচ করে বিদেশে পাড়ি জমাবার দরকার কী। ওই টাকা দিয়ে এখানেই আরো ভালো কিছু করা সম্ভব,' বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Drafting new constitution can take a long time: Asif Nazrul

He proposed that the next parliament can act as constitutional authority and amend the 1972 constitution until a new one is enacted

48m ago