কেন এত অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে

স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এক ছাত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে ২ ছাত্রলীগ নেত্রীর বিরুদ্ধে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ৪ শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনায়ও ছাত্রলীগের নাম। গত সেপ্টেম্বরে ইডেন কলেজে যে ঘটনা ঘটল, সেখানেও ছাত্রলীগ। বুয়েটশিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত ছাত্রলীগ।

সব জায়গায় ছাত্রলীগ কেন? তাদের বিরুদ্ধেই কেন সব অভিযোগ? অপরাধের পরেও কেন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? বিষয়গুলো নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে।

ঢাবির ২ অধ্যাপকের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধমূলক এসব কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার পরেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বাড়ছে। তবে, বাহাউদ্দিন নাছিমের দাবি, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে সব সময়ই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন বলেন, 'কেউ যদি জানে, সে কোনো অন্যায় করলে বিচার হবে না, প্রশাসন তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেবে না, যদি কখনো কিছু করে সেটাও হবে লোক দেখানো, কিছুদিন পরে আবার সেটা উঠে যাবে, তখন তো সে যা ইচ্ছে তাই করবে। এরকম বার্তা যখন কোনো সংগঠনের মধ্যে থাকে, তাহলে সেই সংগঠনের সদস্যরাও যা ইচ্ছে তাই করবে। সেজন্যই আজকে সারা বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বা আওয়ামী লীগের ব্যাপার না। যে যখন ক্ষমতায় থাকে, তারা যদি এমন একটা বার্তা পৌঁছে দেয়, তাহলে দিনকে দিন এ ধরনের ঘটনার মাত্রা আরও বাড়তে থাকবে।'

যেসব অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে, এখন পর্যন্ত সেগুলোর দৃষ্টান্তমূলক বিচার হতে দেখা যায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'যদিও মানুষকে দেখানোর জন্য মাঝেমধ্যে বিচার করার চেষ্টা করে, কিন্তু, এটা কেবল চোখে ধুলা দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে তাদের বিচার হয় না। মানুষ যখন ভুলে যায়, সেই বিচার আর হয় না। নানা অপকর্মের একটার বিচারও কি আজ পর্যন্ত হয়েছে? কিছুদিন আগে ইডেন কলেজে যা ঘটল, পত্রিকায় অনবরত সব এসেছে, সেগুলোর কোনো বিচার হয়েছে?'

'এগুলোর বিচার তো হয়ই না, উল্টো শিক্ষকরা চেষ্টা করে কীভাবে ওদের অন্যায়টাকে ঢেকে রাখা যায়। অন্যথায় শিক্ষকরা তো পদ-পদবি পাবে না। এমন পরিস্থিতিতে এ ধরনের অন্যায় তো ঘটতেই থাকবে। বরং দিনকে দিন এর মাত্রা আরও বাড়তেই থাকবে', বলেন তিনি।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না উল্লেখ করে ঢাবির এই অধ্যাপক বলেন, 'ছাত্ররা করবে ছাত্র রাজনীতি। যতদিন পর্যন্ত ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতি না করবে, ততদিন পর্যন্ত এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটবে না। কারণ এখন আমাদের ছাত্ররা জাতীয় রাজনীতি করে। যে যখন ক্ষমতায় থাকে, তাদের প্রহরী হিসেবে তারা কাজ করে। শিক্ষায় বাজেটের বরাদ্দ এত কম কেন, তা নিয়ে তো আমাদের ছাত্র নেতারা দাবি তোলে না। উল্টো তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের গেস্টরুমে নিয়ে অত্যাচার করে। কোন নেতার নাম মনে রাখতে হবে, তাদের এসব শেখানো হয়। বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম ঘটনার উদাহরণ আছে? যতদিন পর্যন্ত না আমাদের সরকার বলবে যে, আমাদের ছাত্ররা ছাত্র রাজনীতি করবে, তারা ভালো কাজের মাধ্যমে নেতৃত্ব শিখবে, ভবিষ্যৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে গড়ে উঠবে, ততদিন পর্যন্ত এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো সুযোগ নেই।'

বিশ্ববিদ্যালয় হলের আসনকে ঘিরে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য শুরু হয় উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, 'এর মধ্যে দিয়েই তারা মূলত ভিন্নমতকে দমন করে। শিক্ষার্থীরা অধিকার বিষয়ে যেন সোচ্চার না থাকে, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন-প্রতিবাদ দমন করা ও ক্ষমতাসীন সরকারকে রক্ষা করাই ছাত্র সংগঠনের অন্যতম কাজে পরিণত হয়েছে।'

'এখন এসব ঘটনার পর ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যে স্বাধীনতা থাকা উচিত, তাতো নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে যারা উচ্চপদে থাকেন, তাদের টিকে থাকাটাও নির্ভর করে ছাত্রলীগের বদান্যতার ওপর। তাদের ওপর যদি ছাত্রলীগ নাখোশ হয়, তাহলে তারা তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের শীর্ষ পদে থাকতে পারবেন না। ফলে ছাত্রলীগকে রক্ষা মানে নিজের পদকে রক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই কাজটাই করছে', বলেন তিনি।

চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে তানজীমউদ্দিন খান বলেন, 'যদি আমাদের জাতীয় রাজনীতির গুণগত মানে পরিবর্তন আসে, একমাত্র তাহলেই এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। কারণ জাতীয় রাজনীতির বৈশিষ্ট্য যা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু হয় না। এটিই চলমান সংকটের মূলে রয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেতৃত্বে যদি প্রজ্ঞাবান ও মেরুদণ্ডসম্পন্ন মানুষ আসত, তাহলে এই পরিস্থিতি ঠেকানো যেত। কিন্তু, সেটা তো হবে না। কারণ, যারা শীর্ষ পদে আসেন, সরকারের বদান্যতাতেই তারা এ পদে আসেন। দুর্বল মানসিকতার মানুষকে শীর্ষ এই পদে নিয়ে আসা হয়। যার ফলে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না।'

ছাত্রলীগের কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ-অভিযোগ থাকলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয় মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, 'যদি কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ-অভিযোগ থাকে, তাহলে সেগুলো আমাদেরকে দেবেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবো। কারণ, অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কেউ ছাত্রলীগ করবে, সেটা আমরা চাই না। তাদেরকে আমরা আশ্রয়-প্রশ্রয় দেই না। প্রচার-অপপ্রচার দুটো দিয়েই এখন বিভিন্নভাবে সংবাদ প্রকাশিত হয়। আমরা যেটা করি, যদি কোথাও এ ধরনের নিউজ আসে, আমরা তখন দলীয়ভাবে আমরা খোঁজ-খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা দলীয়ভাবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেই। আর ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে কেউ সংশ্লিষ্ট থাকলে তো প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে, আইনেই তাদের বিচার হবে। কিন্তু, আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেই।'

তিনি বলেন, 'ছাত্রলীগ একটি বিশাল ছাত্র সংগঠন। লাখো সদস্য এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এত বড় সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ তো কারো কাছেই থাকে না। কিন্তু, যখনই কোনো ঘটনা ঘটে, আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেই। আর ছাত্রলীগ যেহেতু বড়-বিশাল সংগঠন, তাদের দোষ-ত্রুটি থাকলে ধরা পড়ে। কিন্তু, কখনো কখনো আমরা দেখেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যারা দোষী থাকে, তার বাইরেও অন্যের অপরাধের দায়, অন্য কোনো সংগঠনের অপকর্মের দায়, এমনকি যারা কোনোদিন ছাত্রলীগ করেনি, তার অপরাধের দায়ও ছাত্রলীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা হয়।'

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত অপরাধের সবক্ষেত্রেই ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার অভিযোগ আসে কেন? জানতে চাইলে বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, 'সবক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নাম আসে কারণ বাংলাদেশে এখন আছেই কেবল ছাত্রলীগ। আর সংগঠন যারা আছে, তাদের অস্তিত্ব কতটুকু আছে? লেখাপড়ার সঙ্গেও তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায় না, সাংগঠনিকভাবে ছাত্রদের অধিকার নিয়েও তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনে কোনো ভূমিকা নেই। ছাত্রলীগের সবাই যে খুব ভালো, সেটা বলছি না। কিন্তু, যদি খারাপ ধরা পড়ে, আমরা ব্যবস্থা নেই।'

কিন্তু, ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন উল্লেখযোগ্য কোনো দৃষ্টান্ত তো নেই- প্রতিবেদকের এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ এই নেতা বলেন, 'এমন ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। চোখ থাকতে অন্ধ হলে তো তাকে আমি দেখাতে পারব না। যখনই তাদের নাম আসে, অপকর্মের সঙ্গে কেউ থাকলে আমরা ব্যবস্থা নেই। দায়বদ্ধতার জায়গায় দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ এ দেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করছে। এই জায়গায় আমরা কোনো আপস করি না।'

Comments

The Daily Star  | English

Not for kidney patient, they tried to rob bank for iPhones

Police say three robbers fabricated a story claiming that the robbery was to save a kidney patient

1h ago