ছাত্রলীগের সন্ত্রাস বন্ধের দাবিতে ঢাবি উপাচার্যকে শিক্ষক নেটওয়ার্কের স্মারকলিপি

ঢাবিতে স্যার এ এফ রহমান হলের সামনে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২২। ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের ধারবাহিক হামলা মামলা এবং তাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক।

গত কয়েক মাসে ঢাবি ক্যাম্পাসে বিরোধী মত দমন ও শিক্ষার্থী নির্যাতনের বেশ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরে সংগঠনটি আজ উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামানকে স্বারকলিপি দিয়েছে।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, 'ছাত্রলীগের ইচ্ছে মতন  বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো চলছে। সেখানে ছাত্রদের নামে সন্ত্রাসীদের লালন পালন করা হচ্ছে এবং যখন প্রয়োজন তখন এই সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের  দমন করা হচ্ছে। কিছু কিছু হলের প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা হয় এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন অথবা সক্রিয় ভাবে সহযোগিতা করছেন।'

সংগঠনের পক্ষে এই স্মারকলিপি দেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক তাসনিম সিরাজ মাহবুব, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সামিনা লুৎফা এবং অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক রুশাদ ফরিদী।

এতে তারা বলেন, হামলায় জড়িতদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রশাসনকে দোষীদের পক্ষ অবলম্বন করতে দেখা যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গত ছয় মাসে তিনটি বড় সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি ঘটনাতেই দেখা গেছে বিরোধী মতের ছাত্রসংগঠনগুলোকে লাঠিসোটা, লোহার পাইপ, রড জাতীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নির্বিচারে এবং নির্মম ভাবে পিটিয়েছে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

এই বছরের মে মাসে ছাত্রদলের এক সমাবেশে ছাত্রদলের নেতা কর্মীদের দুই দফায় পিটিয়ে রক্তাক্ত করে দেওয়া হয়। এই ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দোষী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নেয়নি উল্টো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের করা এক মামলায় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। মে মাসের ওই ঘটনার পর ছাত্রদলকে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করে দেওয়া হয়। এরপর ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নতুন কমিটির নেতারা ২৭ সেপ্টেম্বর আপনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে ফুল ও মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে আসেন। উপাচার্যের কার্যালয়ে যাওয়ার পথে নীলক্ষেতের মুক্তি ও গনতন্ত্র তোরণের সামনে তাদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। যথারীতি এই ঘটনাতেও এখনো পর্যন্ত দায়ী ছাত্রদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এরপর, মাত্র কয়েকদিন আগে, ৭ অক্টোবর বুয়েট ছাত্র আবরার হত্যার তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে ছাত্র অধিকার পরিষদ আয়োজিত স্মরণসভায় নির্মম হামলা চালায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। আহত ছাত্ররা ঢাকা মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও পুলিশের উপস্থিতিতেই তাদের মারধর করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। পুলিশ এরপর অবিশ্বাস্যভাবে ছাত্র অধিকার পরিষদের প্রায় ২০ জন নেতা-কর্মীকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় আর ছাত্রলীগই আবার ছাত্র অধিকার পরিষদের ২৫ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে। মাত্র কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া এই ভয়াবহ নিপীড়নমূলক ঘটনার বিচার বা দোষীদের শাস্তি দেবার বিষয়ে আপনার অধীনস্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ এখনো আমাদের নজরে আসেনি।

উল্লিখিত সংঘাতমূলক ঘটনার নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের যেই ব্যক্তিটির সবচেয়ে কার্যকরী ভূমিকা রাখার কথা সেই ব্যক্তিটি হলেন প্রক্টর এবং তার টিম। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই প্রক্টরের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় থেকেই দেখা গেছে যে ছাত্রলীগ সংঘটিত নিপীড়ন আর নির্মম অত্যাচারের সব ঘটনাতেই নিপীড়নকারী ছাত্র নামধারী গুন্ডাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ তিনি কখনো নেননি। উল্টো নির্যাতিত শিক্ষার্থীদেরকে বিভিন্ন ধরনের হয়রানিতে ছাত্রলীগের সহযোগী হয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। গত কয়েকমাসের ঘটনাতেও আমরা এর কোনো ব্যতিক্রম দেখিনি।

শুধু প্রক্টর নন, বর্তমানের সব ঘটনা পরম্পরা দেখে মনে হচ্ছে যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রিত কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থাই এখন আর নেই। এখানে নামে মাত্র আছেন উপাচার্য, নামে মাত্র আছেন প্রভোস্ট, নামে মাত্র আছেন প্রক্টর। মূল দায়িত্বে আছে ছাত্রলীগ।

গত অগাস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের এক শিক্ষার্থীকে তার মেসেঞ্জার গ্রুপে দেওয়া এক মেসেজকে কেন্দ্র করে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ এনে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করেন জিয়া হলের প্রাধ্যক্ষ। পরে পুলিশ তদন্ত করে কোনো অভিযোগের পক্ষে প্রমান না পেয়ে তাকে ছেড়ে দেয়। একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একজন ছাত্রের সবচেয়ে বড় অভিভাবক। সেই অভিভাবক একজন নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ক্যাম্পাসে কি বিন্দুমাত্র নিরাপদ বোধ করবে?

আর গত কয়েকমাসের এইসব ঘটনা প্রবাহ পুরো দেশের সামগ্রিক রাজনীতি থেকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেও মনে হচ্ছে না। পুরো দেশ জুড়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচীর উপর যেরকম নির্বিচারে আক্রমন চালানো হচ্ছে তারই ধারাবাহিকতায় এই ঘটনাগুলো ঘটতে পারে। সেইক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য এই ক্যাম্পাসে বিরোধী মতের শিক্ষার্থীদের উপর এই নিপীড়ন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে আমাদের জন্য খুবই লজ্জ্বার আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা আপনাদের মতন শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত মানহানিকর।

শিক্ষক নেটওয়ার্কের ৪ দাবি

হামলার ঘটনাগুলোর পূর্ণ এবং সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িত ছাত্রদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা। ভবিষ্যতে এই ধরনের সহিংস ঘটনা যাতে আর সংঘটিত না হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। প্রক্টোরিয়াল দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ শিক্ষক গোলাম রাব্বানীকে অবিলম্বে অপসারণ করে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একজন নিরপেক্ষ শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া। হলগুলোকে রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের দখল মুক্ত করে শিক্ষকদের দায়িত্বে নিয়ে আসার ব্যবস্থা গ্রহণ। 

Comments

The Daily Star  | English

India, Pakistan agree ceasefire: Trump

US President Donald Trump on Saturday said that India and Pakistan have agreed to a "full and immediate ceasefire," amid both countries launching strikes and counter-strikes against each other's military installations

9m ago