জীর্ণ ২১৫০০ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঝুঁকিতে শিশুরা
পিলার ও দেয়ালে ফাটল এবং ছাদে ফুটো থাকায় গৌরিচন্না উচ্চ বিদ্যালয়-সংলগ্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনটি প্রায় দুই বছর আগে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু বিপর্যয়ের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ নতুন ভবন নির্মাণ না করায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই শ্রেণী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
শুধু বরগুনা সদর উপজেলার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি নয়, সারা দেশে এমন অবস্থায় রয়েছে ২১ হাজার ৫০০টিরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
প্রাথমিক বিদ্যালয়টির শিক্ষক মইনুল হোসেন বলেন, 'কোনো বিকল্প না থাকায় আমরা এই জরাজীর্ণ ভবনেই ক্লাস দিতে বাধ্য হই। নতুন ভবনের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছি।'
বিদ্যালয়টির পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্র বলে, 'স্কুল ভবনের অনেক জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। যেকোনো সময় বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে। কিন্তু তারপরও আমাদের ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হয়।'
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) জানিয়েছে, আকস্মিক বন্যায় সাম্প্রতিক ধ্বংসযজ্ঞে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলায় প্রায় দুই হাজার ৮০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বাংলাদেশে এক লাখ সাত হাজার প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে ৬৫ হাজার ৫৬৭টি সরকারি। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীর প্রায় এক কোটি ১০ লাখ শিক্ষার্থীকে পড়ান তিন লাখ ৮৪ হাজারের বেশি শিক্ষক।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রায় ২০ শতাংশ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে, যার ফলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের জীবন রয়েছে ঝুঁকির মধ্যে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, আরও ১৬ শতাংশ স্কুল ভবনেরও মেরামত প্রয়োজন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা ও শিক্ষকরা জানান, এসব বিদ্যালয়ের অধিকাংশের ছাদের বেহাল দশা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই বছরের জুলাই পর্যন্ত ৪৯ হাজার ৬৫৬টি স্কুল ভবন নতুন, ভালো ও ব্যবহারযোগ্য, ১৮ হাজার ২৭১টি পুরাতন, ১৬ হাজার ৯৯৮টি মেরামতযোগ্য, ১১ হাজার ৬১৩টি জীর্ণ, পাঁচ হাজার ২৫২টি ঝুঁকিপূর্ণ, তিন হাজার ৩০৭টি পরিত্যক্ত এবং এক হাজার ৩৪৮টি ব্যবহার অযোগ্য। এ ছাড়া বাকি স্কুলের ভবন নির্মাণাধীন ছিল।
তারা বলেন, অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছর। ২০১৩ সালে জাতীয়করণ করা ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে অনেকগুলোও খারাপ অবস্থায় রয়েছে। বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ে আরও কয়েক শতাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে 'পরিত্যক্ত' ঘোষণা করা ভবনেও ক্লাস করাচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুস সামাদ বলেন, 'এসব স্কুল ভবন সংস্কার একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এটি আমাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় রয়েছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের যাতে ভয় নিয়ে ক্লাসে যেতে না হয়, সেজন্য আমরা সব ধরনের ব্যবস্থা নেই।'
পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ পরিচালিত এবং জুন ২০২৩-এ প্রকাশিত তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির ইমপ্যাক্ট ইভালুয়েশন রিপোর্ট অনুসারে, প্রায় ২৭ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন মেরামত করা প্রয়োজন।
৪৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
মূল্যায়ন প্রতিবেদনের জন্য সাক্ষাত্কার নেওয়া এক হাজার ২০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৯ শতাংশ বলেছেন, তাদের শ্রেণীকক্ষ ঝুঁকিপূর্ণ। বৃষ্টির সময় ছাদ দিয়ে পানি পড়ে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ তারিক আহসান বলেন, 'বিদ্যালয়গুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা শিক্ষার পরিবেশে প্রভাব ফেলছে। এটা স্পষ্ট যে ক্লাস চলাকালীন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা ক্রমাগত ভয়ের মধ্যে থাকে। এমন পরিস্থিতি তাদের ওপর বড় মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, যা শেখার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।'
তিনি আরও বলেন, 'বিদ্যালয়ে আনন্দদায়ক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে চলা বিদ্যালয়ে তো এমন পরিবেশ থাকছে না। যার ফলে শিক্ষার্থীরা শ্রেণীকক্ষে একাগ্রতা হারায়, অনুপ্রেরণাও হারায়।'
তার মতে, শিক্ষকরাও কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন। তারা বিরক্ত বোধ করেন, ফলে শিক্ষাদানের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহমেদ জানান, ঢাকার ৩৪২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করছেন তারা।
অধ্যাপক তারিক বলেন, 'এটি একটি ভালো উদ্যোগ যে ঢাকার অনেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিবেশ উন্নয়নের জন্য সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে।'
তবে শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশের সব স্কুলে এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা উচিত।
ফরিদ আহমেদ জানান, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সারা দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংস্কার এবং সারা দেশে এই কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
বন্যার ক্ষতি
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গত ১০ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, আগস্টে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যায় ১১টি জেলার দুই হাজার ৭৯৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো, আসবাবপত্র, বই ও নথিপত্রের ক্ষতি হয়েছে। নোয়াখালীতে ৭৬৩টি, লক্ষ্মীপুরে ৫০১টি, ফেনীতে ৫৫০টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২২টি, কুমিল্লায় ৫২৩টি, চাঁদপুরে ১৬৯টি, চট্টগ্রামে ১৬৪টি, মৌলভীবাজারে ৭৭টি, সিলেটে আটটি এবং হবিগঞ্জে ২২টি বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তারা জানায়, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয় ভবন মেরামত করতে প্রায় ৩৩ কোটি টাকা প্রয়োজন হতে পারে।
Comments