তাপপ্রবাহ: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা-বন্ধ নিয়ে যা বললেন শিক্ষাবিদরা

স্কুল থেকে মেয়েকে নিয়ে ফেরার পথে প্রখর রোদের তাপ থেকে মেয়েকে বাঁচাতে ওড়না দিয়ে তার মাথা ঢেকে রাখার চেষ্টা করছেন এক মা। গতকাল রোববার ঢাকার কাকরাইল এলাকা থেকে ছবিটি তোলা হয়েছে। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

চলমান তাপপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, কলেজ ও মাদ্রাসার ক্লাস আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে শিক্ষকসহ কয়েকজনের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমে আসা বিভিন্ন প্রতিবেদন নজরে আনা হলে শুনানি নিয়ে আজ সোমবার বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত এ আদেশ দেন।

ঈদুল ফিতরের ছুটির পর ২১ এপ্রিল থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা থাকলেও সারাদেশে তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হলে ছুটি এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়।

গরম না কমলেও সন্তানদের নিয়ে অভিভাবকদের উদ্বেগের মধ্যেই গত রোববার খুলে যায় সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এদিন বিভিন্ন স্থানে ক্লাস চলাকালে শিক্ষার্থীদের অসুস্থ হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটে, স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রচণ্ড গরমে দুই শিক্ষকের মৃত্যুর খবরও আসে।

এমন পরিস্থিতিতে চলতি মৌসুমের সামনের দিনগুলোতেও যদি এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে করণীয় প্রসঙ্গে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, রাশেদা কে চৌধুরী ও অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বক্তব্য, 'আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। যেসব অঞ্চলে বিপদটা আছে, সেখানে অবশ্যই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ রাখতে হবে। আবার যেমন সিলেটের অবস্থা এখন একটু ভালো। সেখানে স্কুল চলতে পারে।'

এই অধ্যাপকের ভাষ্য, 'যেখানে যেখানে অবস্থা সহনীয়, সেটা স্থানীয়ভাবে নির্ধারণ করতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। যেসব স্কুলে ফ্যান আছে, তারা হয়তো কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে আছে। কিন্তু অনেক স্কুলে তো সেটা নেই। সেখানে কোনোক্রমেই ক্লাস হওয়া উচিত না।'

অধ্যাপক মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, 'উপজেলা শিক্ষা অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের একটা নিবিড় তত্ত্বাবধান থাকতে হবে। এটা আবার অফিসে বসে নির্ধারণ করলে চলবে না। ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে কোন স্কুলে কী সমস্যা। যেখানে পানি নেই, ফ্যান নেই, অনেক দূর থেকে ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে, সেই স্কুল অবশ্যই বন্ধ থাকবে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে।'

'অনেক চিন্তা-ভাবনা করে এটা করতে হবে। দেখলাম দুজন শিক্ষক হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন। এটা বিরাট ট্রাজেডি। এটা হবে কেন? এটার জন্য গাফিলতিই দায়ী।'

মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকবে কি থাকবে না—সেটা ঢাকায় বসে নির্ধারণ করা যাবে না। তিনি বলেন, 'দায়িত্বটা এলাকাভিত্তিক হওয়া উচিত। শিক্ষকরাই বোঝেন তাদের সমস্যাগুলো। প্রধান শিক্ষক বোঝেন। তাদের সঙ্গে যারা আছেন—স্কুল কর্তৃপক্ষ, পরিচালনা পর্ষদ—তারা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবেন। এটা মনে রাখতে হবে, একটা শিশু যদি কোনো কারণে মারা যায়, এর পুরো দায়ভার জাতির ওপর এসে বর্তায়।'

বিষয়টি নিয়ে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, 'এটা একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এ ধরনের ক্ষেত্রে আমরা সবসময়ই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ রাখি। ঠিক যেমন ঘূর্ণিঝড়ের সময় সবাই সাইক্লোন সেন্টারে আশ্রয় নেয়, স্কুল বন্ধ থাকে। এভাবেই এখানে বন্ধ রাখা হয়েছিল। সেটা মূলত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে। এটা দীর্ঘমেয়াদী হতে পারে না। এসএসসি, এইচএসসিসহ অনেক পরীক্ষাও সামনে।'

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টার পর্যবেক্ষণ হলো, 'আপনি চান আর না চান, শিক্ষার্থীরা ঠিকই কোচিংয়ে যাচ্ছে। তাহলে কী দাঁড়ালো? স্কুল বন্ধ থাকার কারণে কোচিংবাণিজ্য আরও বাড়ছে। এমনিতেই কোচিংয়ের লাগাম আমরা টানতে পারছি না। মোহাম্মদপুর-লালমাটিয়া এলাকায় কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের ভিড়ে বিকেলে রাস্তায় হাঁটা যায় না। স্কুলে লেখাপড়া নাই, অতএব কোচিংয়ে পাঠাও। এটা কি ভালো হলো?'

তিনি আরও বলেন, 'এতদিন আমরা শিক্ষা পরিবারের লোকেরা বলে আসছি যে সব স্কুল এক শিফট করা উচিত। কিন্তু সেটা আমরা করতে পারিনি। প্রাথমিকে মাত্র নয় শতাংশ স্কুল এক শিফটের—৬৫ হাজার স্কুলের কথা বলছি মূলধারার। এগুলো সব এক শিফটের হলে এর একটা ভালো ফল আমরা পেতে পারতাম।'

এ ছাড়া, সামনের দিনগুলোর কথা মাথায় রেখে একটা বিকল্প ভাবনার তাগিদ দিয়ে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক বলেন, 'এমন দুর্যোগ যদি দেশব্যাপী হয়, তাহলে এর আগামীর ভাবনাটা আমাদের ভাবতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন অনেক করেছি আমরা। কিন্তু এটা ভাবিনি যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। মহানগরীর বড় বড় স্কুলগুলোর তিন-চারটা করে সেকশন। তাদের ফ্যানসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাগুলো আছে।'

'কিন্তু গ্রামের বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কারণ, লোডশেডিং হচ্ছে। খাবার পানি, লোডশেডিংয়ের মতো বিষয়গুলো মাথায় রেখেই স্কুল-কলেজ খোলা রাখার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। নাহলে কেবল লেখাপড়ার ক্ষতি না; কোচিংবাণিজ্যও লাগামহীন হয়ে যাবে,' যোগ করেন তিনি।

অবশ্য অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমানের ভাষ্য, তাপমাত্রা অসহনীয় হয়ে উঠলে স্কুল-কলেজ বন্ধই রাখা উচিত। পরবর্তীতে সাপ্তাহিক ছুটি একদিন কমিয়ে তা অন্যভাবে পুষিয়ে নিতে হবে।

আইইআরের সাবেক এই পরিচালক বলেন, 'আগে শিশুদের বাঁচাতে হবে। তারপর লেখাপড়া, চলাফেরা, খাওয়া-দাওয়া সবকিছু। শিক্ষক মারা গেলেন স্কুল থেকে আসার পথে—এ অবস্থায় স্কুল কী করে খোলে? এটা কোনো অবস্থাতেই যুক্তিসঙ্গত না।'

এই শিক্ষাবিদ মনে করেন, 'এই গরমে স্কুলে আসলে লেখাপড়া হয় না। শিক্ষকও পড়াতে পারেন না, শিক্ষার্থীরাও মনোযোগ দিতে পারে না। বরং তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। শিশুদের বিষয় এটা। বড়দের ব্যাপার না যে কোনোরকমে সইয়ে নেবে।'

Comments

The Daily Star  | English

Admin officers protest plan for more non-admin deputy secretaries

Non-admin officers announce strike tomorrow, demanding exam-based promotions

1h ago