ডেইলি স্টারে সংবাদ প্রকাশের পর মেয়েদের জন্য নতুন ভবন পেল ‘মোনঘর’

ফিতা কেটে মোনঘরের জন্য নির্মিত রেজাউর রহমান গার্লস হোস্টেল উদ্বোধন করছেন এ এফ মুজিবুর রহমান ট্রাস্টি ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। ছবি: স্টার

পার্বত্য ৩ জেলার অন্যতম আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'মোনঘর', যেখানে বেশিরভাগ দুর্গম, অভাব এবং সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পড়াশোনা করে। ২০১৭ সালের ১৮ আগস্টে 'দ্য মোনঘর' শিরোনামে দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত সংবাদে প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক টানাপড়েন ও আবাসন সংকটের বিষয়টি এ এফ মুজিবুর রহমান ট্রাস্টি ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। এর পরের বছরই মোনঘরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানে রেজাউর রহমান গার্লস হোস্টেল নির্মাণকাজ শুরু হয়, যা গতকাল শনিবার বিকাল ৩টার দিকে উদ্বোধন করেন ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি সদস্যরা।

সেসময় মোনঘরের শিশুরা ফুল দিয়ে বরণ করেন ট্রাস্টির অন্যতম সদস্য খুশী কবির ও নুরুল ইসলামকে। এসময় উপস্থিত ছিলেন চাকমা সার্কেল রাজা দেবাশীষ রায়, মানবাধিকারকর্মী নিরুপা দেওয়ান এবং মোনঘর পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কৃতি নিশান চাকমা।

মোনঘরের জন্য নির্মিত রেজাউর রহমান গার্লস হোস্টেল। ছবি: স্টার

ট্রাস্টি সদস্য খুশী কবির শিশুদের উদ্দেশে বলেন, 'তোমরা সবাই এক একটা তারা, তোমাদের আলো সমাজে ছড়াতে হবে, যেখানে এখনো শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। তোমরা ভেবে দেখ, কত দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে এখানে চলে এসেছ। আমি চাই তোমরা শিক্ষাগ্রহণ করে মানুষের মতো মানুষ হও। আমি জেনেছি পাহাড়ে এখনো অনেক দুর্গম এলাকা রয়েছে, যেখানে স্কুল-কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। এখানে তোমরা অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আছো। মানুষ মানেই তার চেতনা আছে এবং অপরকে শ্রদ্ধা করতে জানতে হবে।'

ট্রাস্টি সদস্য নুরুল ইসলাম বলেন, 'আমি আপনাদের কাজে সন্তুষ্ট। আমরা যতটুকু পেরেছি সাপোর্ট করেছি। আমাদের ভবিষ্যতে আরও অনেক দূর এগুতে হবে। আমরা সবসময় আপনাদের পাশে আছি। মনে রাখতে হবে- আমাদের স্বপ্ন উচ্চাকাঙ্ক্ষী হতে হবে, স্বপ্ন পূরণে লক্ষ্য স্থির রাখতে হবে।'

মোনঘরের সাবেক শিক্ষার্থীদের সংগঠন দ্য মোনঘরিয়ান্সের সাধারণ সম্পাদক নন্দন কিশোর চাকমা বলেন, 'আমাদের কার্যক্রম শুধু এখানেই শেষ নয়, পার্বত্য এলাকায় যারা আর্থিক সংকটে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে বা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করতে পারছে না, প্রকৃতপক্ষে যাদেরকে পরিবার সহায়তা করতে পারছে না, এমন শতাধিক শিক্ষার্থীকে আমরা প্রতিমাসে ২ হাজার টাকা করে খাবার লোন হিসেবে দিয়ে থাকি। তবে শর্ত থাকে যে তারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর যেন আবার এভাবে মোনঘরে কন্ট্রিবিউট করতে পারে।'

মোনঘর পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক কৃতি নিশান চাকমা বলেন, 'আমরা এই কল্যাণ তহবিলটা পেয়েছি মূলত ২০১৭ সালে দ্য ডেইলি স্টারে আমাদের আবাসন এবং বিভিন্ন আনুষঙ্গিক অর্থনৈতিক সংকট তুলে ধরলে বিষয়টি এ এফ মুজিবুর রহমান ট্রাস্টের নজরে আসে। এরপর তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় এবং কোভিড-১৯ মহামারি চলাকালে নির্মাণকাজ শেষ হয়। মোট ৯১ লাখ ১৮ হাজার টাকা ব্যয়ে ৩ তলা ফাউন্ডেশন ভবন নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে ৭টি শয়ন কক্ষ, ৫টি টয়লেট ও ৫টি গোসলখানা রয়েছে। এ ছাড়াও, আসবাবপত্র, বৈদ্যুতিক পাকা, বাতি এবং মেয়েদের জন্য পড়ার টেবিল ও চৌকি রয়েছে। এ ভবনে ৭০ জন মেয়ে থাকতে পারবে।'

করোনাকালে মোনঘরের ৪০ জন মেয়ে এবং ১০ জন ছেলের পড়াশোনার যাবতীয় খরচ এ এফ মুজিবুর রহমান ফাউন্ডেশন বহন করেছে বলেও জানান তিনি।

হোস্টেল ফলকের সামনে এ এফ মুজিবুর রহমান ট্রাস্টি ফাউন্ডেশনের সদস্যরা। ছবি: স্টার

কৃতি নিশান চাকমা বলেন, 'আমাদের এখনো আবাসন সংকট রয়েছে, মেয়েরা সিঙ্গেল চৌকিতে দুজন করে ঘুমায়। আমাদের ছেলেরা জেলা পর্যায়ে হ্যান্ডবল খেলায় চ্যাম্পিয়ন। সামনে তারা অঞ্চল পর্যায়ে খেলতে যাবে, সেখানে জিতলে জাতীয় পর্যায়ে খেলবে, আমরা সবাই আশাবাদী। কিন্তু তাদেরকে আমরা ভালো খাবার দিতে পারি না, ফলে খেলার জন্য যে শক্তি দরকার তা তারা কোথায় পাবে। আমাদের মেয়েরাও হ্যান্ডবল অনুশীলন করছে, আগামী বছর বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করবে, তবে তাদের জন্য যে কোচ রাখা হয়েছে তাকে আমরা কিছুই দিতে পারছি না, সকাল-বিকাল অনুশীলন করাচ্ছেন তিনি, তাকে আমরা কোনো সম্মানী পর্যন্ত দিতে পারছি না। আমাদের ৮০০ ছেলে-মেয়ের জন্য যারা প্রতিদিন রান্না করেছেন, তারাও অনেকটা স্বেচ্ছামূলক শ্রম দিচ্ছেন। কেননা এই যুগে এসে ৩-৪ হাজার টাকা বেতনে কেই-বা কাজ করেন। তারপরও আমাদের ছেলে-মেয়েদের প্রতি মহানুভবতা দেখিয়ে তারা নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন।'

এ এফ মুজিবুর রহমান ব্রিটিশ আমলে মুসলিম এবং বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে প্রথম ইম্পেরিয়াল সিভিল সার্ভিসের (আইসিএস) কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর ছেলে রেজাউর রহমান পিতার সম্পত্তির অংশ নিয়ে একটি ট্রাস্ট গঠন করেন। এ ট্রাস্ট দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা উন্নয়নে বেশিরভাগ অনুদান দেয়। দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ভবন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ফাউন্ডেশনের কর্মকাণ্ড রয়েছে।

১৯৬১ সালে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার বোয়ালখালীতে জ্ঞানশ্রী বৌদ্ধ ভিক্ষুর হাত ধরে মোনঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন কেবল বৌদ্ধ আশ্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য হলেও পরে ৪ ভিক্ষু বিমল তিষ্য মহাথেরো, শ্রদ্ধালংকার মহাথেরো, প্রিয় তিষ্য ভিক্ষু এবং প্রজ্ঞানন্দ মহাথেরোর প্রচেষ্টায় ১৯৭৪ সালে রাঙ্গামাটি শহরে রাঙ্গাপানি এলাকায় স্থানান্তরিত হয় মোনঘর আশ্রম।

বর্তমানে প্রায় ৮০০ ছাত্র-ছাত্রী আবাসিক হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে। তারা সবাই পার্বত্য ৩ জেলায় বসবাসরত চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, লুসাই, পাংখোয়া এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী।

প্রতিষ্ঠানের সচ্ছলতা এবং শিশুদের প্রতিদিন খাবার নিশ্চিতে আয়ের উৎস হিসেবে স্টেশনারী দোকান, বেকারি, সেলাই মেশিন এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণে সেন্টার চালু করা হয়েছে। তবুও সময়ের পরিক্রমায় এখন সব কিছুর দাম বাড়তি, তাই প্রতিষ্ঠান চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানায় মোনঘর কর্তৃপক্ষ।

Comments

The Daily Star  | English

Protests disrupt city life, again

Protests blocking major thoroughfares in Karwan Bazar and Shahbagh left the capital largely paralysed

1h ago