সমাবর্তনে গাউন-টুপি পরার রীতি চালু হলো যেভাবে

সমাবর্তনে গাউন-টুপি পরার রীতি চালু হলো যেভাবে
তাসনিয়া ফারিণ। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অন্যতম আকাঙ্ক্ষিত একটি মুহূর্ত বোধ হয় সমাবর্তন। আর সমাবর্তনের কথা ভাবলেই মাথায় আসে লম্বা আলখেল্লার মতো একটি কালো গাউন, একখানা হুড আর চারকোণা টুপির কথা। 

যে টুপি হাওয়ায় উড়িয়েই স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা জানান দেন নিজেদের প্রাতিষ্ঠানিক বিজয়ের। কিন্তু কীভাবে এই গাউন, গলায় ঝোলানো হুড আর মুকুটের মতো টুপিটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেল সমাবর্তন উদযাপনের রীতির সঙ্গে? তা জানতেই আজকের এই লেখা। 

তবে সে রহস্য বর্তমানের সীমানায় নয়, ভেদ করা যাবে অতীতের ময়দানে গিয়ে। তাও আবার গুনে গুনে প্রায় ৯০০ বছর আগের ইউরোপে। হ্যাঁ, গাউন পরার এই রীতি অন্য অনেক বিষয়ের মতোই পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুকরণ কিংবা অনুসরণ।

গাউন এলো যেভাবে

কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীতে যখন ইউরোপে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন শুরু হয়, তখন ধর্মযাজক বা পাদ্রিরা গাউন পরিধান করতেন। আর পাদ্রিদের বহুলাংশেই অনুসরণ করা ছিল তখনকার শিক্ষিত সমাজের মনোভাব। তাই অনেক শিক্ষার্থী পাদ্রির দেখাদেখি গাউন আর হুড পরতেন। 

ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটির পোশাকের দিকনির্দেশনা থেকে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের এই বিশেষ পোশাক পরার জন্য আরেকটি কারণও ছিল। ঠান্ডায় কাবু হওয়া সময়ে সেইসব শিক্ষা ভবনে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থা ছিল না। এ জন্যও কালো রঙের তাপ শোষণকারী পোশাক শিক্ষার্থীদের কিছুটা কাজে লাগতো, উষ্ণতা ধরে রাখার জন্য। এই মত অনুযায়ী, 'চেরি অন দ্য টপ' সদৃশ টুপিটিও নাকি বিদ্বানদের ঠান্ডা লাগা থেকে বাঁচাতেই যুক্ত হয়েছিল। 

আর আমজনতা থেকে শিক্ষিত সমাজকে আলাদা করে রাখতেও যে এই গাউন ভূমিকা রাখতো, বলাই বাহুল্য। ঠিক যেমন ডাক্তারের সাদা অ্যাপ্রন বা উকিলের কোট দেখলে আমরা তাদের পেশা সম্পর্কে বুঝে যাই, তেমনি তৎকালীন সমাজে নব্য উত্থানকারী শিক্ষিত সমাজকেও আলাদা করা যেত এই কালো গাউন দেখে। তখন অবশ্য কিছু প্রতিষ্ঠানে বাদামি গাউনও পরা হতো। একাধিক রঙের গাউন যেখানে ছিল, সেখানে মূলত শিক্ষার্থীর ধর্ম এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবস্থানের ভিত্তিতে পরিহিত গাউনের রঙ নির্বাচন করা হতো। 

অনেক আগে থেকেই গাউন পরিধানের প্রচলন হলেও এ নিয়ে আরও জল্পনা-কল্পনার রেশ থেকে যায় পরবর্তী সময়েও। সমাবর্তনের পোশাকে ব্যাপক পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে ১৮৯৪ সালের দিকে। আমেরিকান ইন্টারকলেজিয়েট কমিশন এ বিষয়ে একটি সভার আহ্বান করে। সভাটি অনুষ্ঠিত হয় কলম্বিয়াতে। সেখানে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে সমাবর্তনের সব প্রকার পোশাকের রঙ হবে কালো। 

এ ছাড়া স্নাতক ও স্নাতকোত্তরের গাউন তৈরির উপাদানে থাকবে কিছুটা পার্থক্য। হুডের ক্ষেত্রেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে। তবে হুডের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রঙের ব্যবহার বিষয়ে সেখানে শিথিলতা রাখা হয়, যা কিনা একই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীদের আলাদা করতে কাজে লাগে। সে চর্চা আজও বিদ্যমান। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিজ্ঞান, কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন অনুষদের শিক্ষার্থীরা সমাবর্তনের সময় সবাই কালো রঙের গাউন ও টুপি পরিধান করলেও হুডের ক্ষেত্রে লাল, বেগুনি, সবুজ ইত্যাদি রঙের বর্ডার দেওয়া থাকে। 

গ্র্যাজুয়েটদের টুপি

বিদেশ বিভূঁই থেকে এবার একটু দেশের পানে ফেরা যাক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এখন পর্যন্ত সবশেষ সমাবর্তন, অর্থাৎ ৫৩তম সমাবর্তন পর্যন্ত দেখা গিয়েছে, গাউনটি গ্র্যাজুয়েটদের কাছ থেকে ফেরত নিয়ে নেওয়া হলেও স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তারা রাখতে পারেন কালো টুপিটি। এই টুপির ইতিহাসও গাউনের মতোই দীর্ঘ এবং বৈচিত্র্যময়। প্রথমদিকে টুপিটি সম্পূর্ণভাবে গোলাকার ছিল, এখনকার মতো চারকোণা সাজ তাতে ছিল না। 

এখনকার এই প্রচলিত চারকোণা আকৃতিটিকে বলা হয় 'মর্টারবোর্ড ক্যাপ'। এর প্রচলন ঘটে পঞ্চদশ শতকে, উৎপত্তি সেই ক্যাথলিক গির্জার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পরিধান শৈলী থেকেই। মর্টারবোর্ডের পূর্বজ সেই টুপির নাম ছিল 'বিরেটা'। হুডের মতো টুপির ক্ষেত্রেও অনুষদের ভিন্নতা বোঝার জন্য বিভিন্ন রঙের ব্যবহার হয়। প্রতিটি টুপিতে থাকে একগুচ্ছ রঙিন রেশমের সুতো। সমাবর্তনের আগে ও পরে সেই সুতোর অবস্থান পাল্টে যায়। রেশম সুতোর ডান থেকে বায়ে সরে যাওয়া প্রতিনিধিত্ব করে সময়ের পরিবর্তন, আর সেইসঙ্গে পরিধানকারী শিক্ষার্থীর অবস্থানের উন্নয়নও। 

 

তথ্যসূত্র: টাইম.কম, ওয়াশিংটন পোস্ট

 

Comments

The Daily Star  | English

UN chief Guterres meets Prof Yunus in Davos

UAE invites Yunus to attend World Governments Summit in Dubai

1h ago