ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়: ভিসি নিজেই যেখানে আইন

যখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের বিষয় আসে, তখনই আইন লঙ্ঘন করা যেন ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (ভিসি) অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

আইনগতভাবে ভিসি নিজে থেকে কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন না। কিন্তু, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী যত জনের নিয়োগ পাওয়ার কথা, গত ৭ বছরের মেয়াদে ভিসি অধ্যাপক মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ তারচেয়ে বেশিজনকে নিয়োগ দিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির নিয়োগ সংক্রান্ত অনেক কাগজপত্রে 'জালিয়াতি' করা হয়েছে।

সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে তদন্ত কমিটি মাদ্রাসার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সের তত্ত্বাবধানকারী এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি পদ থেকে আহসান উল্লাহকে অপসারণের সুপারিশ করে।

একইসঙ্গে তারা বেশ কয়েকটি নিয়োগ বাতিল করার পরামর্শ দেয়, যেগুলোকে 'ভয়েড অ্যাব ইনিশিও' বলে অভিহিত করে, যার অর্থ শুরু থেকেই বাতিল।

দ্য ডেইলি স্টারকে ইউজিসি সদস্য ও তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, 'আমরা আমাদের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি।'

এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব আবু বকর সিদ্দিক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা প্রতিবেদনটি বিশ্লেষণ করছি এবং সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।'

তিনিও এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি।

২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়টি ১ হাজার ৩০০টিরও বেশি ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসা তত্ত্বাবধান করে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আহসান উল্লাহ ২০১৫ সালের ৪ জানুয়ারি ভিসি হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পান এবং এরপর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে পুনরায় নিয়োগ পান।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ব্যবস্থাপনায় অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ার পর গত বছর প্রথম দফায় তা নিয়ে তদন্ত শুরু করে ইউজিসি।

এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধিকতর তদন্তের জন্য বিশ্বজিৎ চন্দের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি গঠন করে।

তদন্ত প্রতিবেদনের একটি কপি হাতে পেয়েছে দ্য ডেইলি স্টার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যের অবৈধ-অনৈতিক কর্মকাণ্ড ও দুর্নীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে, তাকে উপাচার্য পদে বহাল রেখে সুষ্ঠুভাবে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বজায় রাখা সম্ভব নয়।'

'সুতরাং, অধ্যাপক আহসান উল্লাহকে অবিলম্বে পদ থেকে অপসারণ করা উচিত...'

ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১৩ অনুযায়ী, উপাচার্যের সাময়িকভাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার না থাকলেও আহসান উল্লাহ ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাকির হোসেনকে সাময়িক ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ দেন।

এরপর ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তিনি নিজের ইচ্ছায় নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জাকিরকে এই পদে স্থায়ী নিয়োগ দেন।

তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অনুমোদন ছাড়াই এসব কাজ করেছেন।

যদিও, এই পদের জন্য জাকির হোসেনের প্রয়োজনীয় কাজের অভিজ্ঞতাও ছিল না এবং তার শিক্ষাগত ডিগ্রিতে তৃতীয় বিভাগ ছিল।

প্রতিবেদনে বলা হয়, 'নিয়োগটি ভয়েড অ্যাব ইনিশিও এবং তাই জাকির হোসেনকে এই পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করা হচ্ছে।'

উপাচার্য একইভাবে আবু হানিফাকে ডেপুটি রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন।

তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, নিয়োগের জন্য সিলেকশন বোর্ডের সুপারিশের ফটোকপিতে কারচুপি করা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে এবং নথিগুলোর কোনো মূল কপিও ছিল না।

এতে আরও বলা হয়, হানিফা বেশ কয়েকবার ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং একজন সাবেক রেজিস্ট্রারের সাক্ষ্য অনুযায়ী আহসান উল্লাহ তার কাছে সব গোপন ও গুরুত্বপূর্ণ সরকারি নথি রাখতেন।

'সুতরাং, উল্লেখিত কারচুপির দায়িত্বও হানিফার ওপরেও বর্তায়। সুতরাং, এ ধরনের অসাধু ব্যক্তি, যাকে অবৈধভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তাকে অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত বলে আমরা সুপারিশ করছি।'

তদন্ত প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ২৪ মে দেওয়া সংশোধিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি এবং ১২ ডিসেম্বরের দশম সিন্ডিকেট সভার মাধ্যমে সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে ফাহাদ আহমদ মোমতাজী এবং পরিকল্পনা ও উন্নয়নের সহকারী পরিচালক হিসেবে জিয়াউর রহমানকে নিয়োগ এবং ২০১৮ সালে সেকশন অফিসার, সহকারী প্রোগ্রামার ও অন্যান্য নিয়োগ ছিল অবৈধ।

'নিয়োগ বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত ৪১টি পদের বিপরীতে ৫৮ জন প্রার্থীকে সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল', বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

১৬টি পদের বিজ্ঞাপন দিয়ে এর বিপরীতে ২৯ জন অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট-কাম-কম্পিউটার অপারেটর নিয়োগ করা হয়। আবার ২টি পদের বিপরীতে ৪ জন সহকারী প্রোগ্রামার নিয়োগ করা হয় এবং একটি মাত্র পদের বিপরীতে ২ জন অডিট অফিসার নিয়োগ করা হয়।

এদিকে, ২৪টি অফিস সহকারী পদের বিজ্ঞাপন দিয়ে ৩১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

ইউজিসির অনুমোদন না পাওয়ায় শিক্ষকদের অস্থায়ী নিয়োগ বাতিলের সুপারিশও করে তদন্ত কমিটি। তবে প্রতিবেদনে শিক্ষকের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।

তদন্ত কমিটির এক সদস্য জানান, অন্তত ৫ জন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অ্যাকাডেমিক বিভাগ নেই।

একইসঙ্গে আর্থিক অনিয়ম থেকে শুরু করে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে ভিসির সম্পৃক্ততাসহ সব অভিযোগ নিয়ে সরকারের বিশেষ বাহিনী কর্তৃক অধিকতর তদন্তের জন্য সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আহসান উল্লাহ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ইউজিসির প্রতিবেদন আমি দেখিনি এবং এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।'

'আমি শুধু বলতে চাই যে, আমি সব কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী করেছি', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Project stalled amid bureaucratic hurdles

The construction of Jagannath University’s long-awaited second campus in Keraniganj has stalled due to bureaucratic delays.

1h ago