চাকরির বাজারে প্রার্থীদের পিছিয়ে দিচ্ছে সেশনজট
২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন নূর জাহান শাওন। এখান থেকে ২০১৫ সালে অনার্স ও ২০১৬ সালে মাস্টার্স শেষ হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু শাওনের অনার্স পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে এবং মাস্টার্সের ফল ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ করতে তার প্রায় ৯ বছর লেগে যায়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ বছরে অনার্স-মাস্টার্স করার পর শাওনের বয়স দাঁড়ায় ২৮ বছর। আর বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ বছর। এ হিসাবে শাওনের জন্য সরকারি চাকরিতে আবেদন করার বয়স শেষ হতে বাকি ছিল মাত্র ২ বছর। কিন্তু করোনা মহামারিতেই তা কেটে যায়।
শাওনের ভাষ্য, ইংরেজির বাইরে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো বিভাগের শিক্ষার্থীরাও একই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন।
শাওনের বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী মো. জাহাঙ্গীর ভর্তি হয়েছিলেন ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে। চলতি বছরের ৭ জুন তার মাস্টার্সের ফল বের হয়। সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করতে তার লেগে যায় সাড়ে ৮ বছর।
এটা কেবল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র নয়।
স্বাভাবিক নিয়মে ৬ বছরে একজন শিশু স্কুলে ভর্তি হলে ১১ বছরে প্রাথমিক শিক্ষা, ৫ বছরের মাধ্যমিক, ২ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক, ৪ বছরে অনার্স ও ১ বছরে মাস্টার্স শেষ করতে তার ২৩ বছর লাগার কথা। সেখানে সেশনজটের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করতে শিক্ষার্থীদের ৮ থেকে ৯ বছর পর্যন্ত লেগে যাচ্ছে। একই অবস্থা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোর।
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে 'চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্ম' নামের একটি প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্মের সদস্যরা বয়সসীমা বাড়ানোর দাবিতে গত ৯ আগস্ট রাজধানীর শাহবাগ মোড় অবরোধ করলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এতে ১০ জন আহত হন এবং ১ জনকে আটক করা হয় বলে অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাওন ও জাহাঙ্গীরের পাশাপাশি এই প্ল্যাটফর্মের সদস্যদের ভাষ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর যে ২-৩ বছর সময় থাকছে, তা এই তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে যথেষ্ট না। যথাসময়ে ২৩-২৪ বছরের মধ্যে মাস্টার্স শেষ করতে পারলে ক্যারিয়ার গঠনের প্রস্তুতির জন্য ৬-৭ বছর সময় পাওয়া যেত। কিন্তু একদিকে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেশনজট দূর করতে পারছে না, অন্যদিকে সরকারও চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বাড়াচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ছেন তারা।
বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার দেশের ৮টি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা ও বক্তব্য মোটামুটি একই রকম।
এদিকে সেশনজটের কারণ সম্পর্কে জানতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শিরীণ আখতার ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেণু কুমার দে'র সঙ্গে কথা বলার জন্য গত ২ দিনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু প্রতিবারই তারা ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে এড়িয়ে যান।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সুকান্ত ভট্টাচার্য দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের সেশনজট আগে ছিল। আমি চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ৭-৮ মাসে পরীক্ষা শেষ করছি। কোভিডের মধ্যেও পরীক্ষা নিয়েছি।'
আগামী দুই এক বছরের মধ্যে বিভাগে আর কোনো সেশনজট থাকবে না- এমন আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, 'আমাদের এত ভালো একটা ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু সেশনজটের কারণে সেটা কলঙ্কিত।'
একই চিত্র অন্যখানেও
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটের খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, আড়াই থেকে ৩ বছরের সেশনজট সেখানকার স্বাভাবিক ঘটনা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের একজন শিক্ষার্থী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি কোনো বছর ড্রপআউট হইনি, ফেল করিনি, নিয়মিত শিক্ষার্থী। তারপরও ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হয়ে ৯ বছরেও পাশ করে বের হতে পারিনি। আমার আগের ব্যাচের শিক্ষার্থীদেরও ২-৩ বছর করে সেশনজট ছিল, পরের ব্যাচের শিক্ষার্থীদের অবস্থাও একই।'
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফরহাদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের একটু সেশনজট আছে। আমি গত ৬ মাসে প্রায় ৩ মাসের মতো কমিয়ে এনেছি। আগামী ৬ মাসে আরও ৩ মাস কমিয়ে ফেলব। তা ছাড়া আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে খারাপ অভ্যাস হলো, ছাত্ররা নিজেরাই ইয়ার লস করে।'
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হওয়া বেশ কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা এমএসসি প্রোজেক্টের ভাইভা শেষ করলেও তাদের ফল এখনো ফল প্রকাশ হয়নি। তাদের প্রত্যেকের বয়স এখন ২৭-২৮ এর কোঠায়।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী জহুরুল ইসলাম জনি জানান, তার ৪ বছরের বিএসসি শেষ করতে সময় লেগেছে ৭ বছর।
জনি বলেন, 'অন্য বিভাগগুলোতেও প্রায় একই সময় লাগে। এর সঙ্গে যারা মাস্টার্স বা এমএসসি করেন তাদের ক্ষেত্রে আরও এক থেকে দেড় বছর যোগ হয়।'
এদিকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করতে ৯ বছর সময় লাগার কথা জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি তিতুমীর কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাজির উদ্দিন বলেন, 'ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত অন্য ৬ কলেজের অবস্থাও একই রকম। কলেজগুলোর পরীক্ষা-রেজাল্ট একই সময়ে হয়। ফলে সবারই একই সময় লাগে।'
সেশনজটের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য ও চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগমের ভাষ্য, এতে তাদের করণীয় কিছু নেই। তিনি বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের (শিক্ষার্থী) বয়স বাড়িয়ে দিলে আমরা কি করব? কোভিডের কারণে সেশনজট আরও বেড়ে গেছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বার বার চিঠি দিচ্ছি যেন কোনো সেশনজট না থাকে। প্রতিটি বিষয়ে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর পুলিশিং করা যায় না। আমাদের নির্দেশনা বিশ্ববিদ্যালয় না মানলে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার আমাদের নেই।'
Comments