২ ব্যক্তির মৃত্যু হলে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে যে ভাষা

ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা। ছবি: স্টার

ভাষাটির নাম 'খাড়িয়া'। বর্তমানে ভাষাটি পুরোপুরি জানেন মাত্র দুজন ব্যক্তি। তারা দুই বোন; নাম ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা। বয়স ৭০-এর উপরে। তাদের মৃত্যু হলে খাড়িয়া নামের ভাষাটিরও মৃত্যু ঘটবে। বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে একটি ভাষা ও একটি সংস্কৃতি।

৮০ বছর বয়সী ভেরোনিকা কেরকেটা। খ্রিস্টিনা কেরকেটার বড় বোন। তাদের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার বর্মাছড়া বস্তিতে।

ভেরোনিকা খাড়িয়া জনগোষ্ঠির ভাষায় কথা বলতে পারেন। কিন্তু কথা বলার সঙ্গী পান না। নিজেদের ভাষার চর্চা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'পরিবারের মধ্যেও কেউ এই ভাষায় কথা বলতে পারেন না। আজকাল অনেকে এ ভাষাকে উড়িয়া বা চা বাগানের ভাষার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। আমাদের তাই কথা বলতে হয় বাংলা ভাষায়। ইচ্ছে তো করে রাঁচিতে গিয়ে নিজের ভাষায় প্রাণ খুলে কথা বলি।'

তিনি বলেন, 'গ্রামে আমার ছোট বোন ছাড়া কেউ এই ভাষা পারে না। তাই তার সঙ্গে দেখা না হলে এই ভাষা বলার সুযোগ নেই। আমাদের ছেলে-মেয়েদের বা নাতি-নাতনিদের এই ভাষায় কথা বললে তারা হাসাহাসি করে, ঠাট্টা করে। আমি নিজেও প্রায় অসুস্থ থাকি। তাই বোনের সঙ্গে দেখাও হয় না, কথাও হয় না।'

তিনি বলেন, 'আমরা বলতে পারলেও লিখতে পারি না। খাড়িয়া সমাজে মাত্র ১৫-২০ জন হবে যারা খাড়িয়া ভাষার কয়েকটা মাত্র শব্দ জানে।'

শ্রীমঙ্গল উপজেলার মংরাবস্তির ৬৫ বছর বয়সী দয়াময় খাড়িয়া। তিনি জানান, এই এলাকার ১১০টি খাড়িয়া পরিবারের বসবাস। অথচ মাত্র ২ জন এই ভাষায় কথা বলতে পারে।

হবিগঞ্জ জেলার চুনারগাট উপজেলার কৃষ্ণচূড়া গ্রামের মানিক খাড়িয়া জানান, ভাষা যেন হারিয়ে না যায় সেজন্য অন্তত মুখে মুখে ভাষাটি টিকিয়ে রাখতে চান।

৭০ বছর বয়সী জহরলাল পান্ডে জানান, যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলেন তখনও নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মুখে পড়তে হয়।

পিউস নানোয়ার। একজন খাড়িয়া সমাজকর্মী। তিনি খাড়িয়া ভাষা রক্ষার উদোক্তা। যিনি ২০২০ সালের গোড়ার দিকে খাড়িয়া জনসংখ্যার ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করেছেন। তিনি এই প্রতিবেদককে জানান, বাংলাদেশে ৪১টি গ্রামে প্রায় ৫ হাজার ৭০০ জন খাড়িয়া জনগোষ্টির মানুষের খোঁজ পেয়েছেন।

তিনি বলেন, 'নতুন প্রজন্ম এই ভাষায় কথা বলে না; তারা খুব কমই একটি বা দুটি শব্দ জানে।'

তিনি আরও বলেন, '৯০ দশকে স্কুল ছাত্র থাকাকালীন আমি দাদীর কাছ থেকে কিছু শব্দ শিখেছিলাম।'

তার দাদি প্রতি সন্ধ্যায় অনানুষ্ঠানিকভাবে ক্লাস নিতেন, খাড়িয়াদের বীরত্বের গল্প, মিথ, ধাঁধা, ছড়া, একক গান, ফসল কাটার গল্প, করম (একটি ফসল কাটার উৎসব) এবং অন্যান্য উৎসব, শিকার এবং লোক ঐতিহ্যের গল্প বলতেন।

২০১৭ সালে, 'বীর তেলেঙ্গা খারঢ়য়া ল্যাঙ্গুয়েজ লার্নিং সেন্টার' নামে একটি যুব সংগঠনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে ভাষা শেখানোর একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু চেষ্টার কোন সফলতা পায়নি। বাংলাদেশে খাড়িয়াদের নিজস্ব বর্ণমালা নেই।'

শ্রীমঙ্গলের কালিঘাট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান প্রানেশ গোয়ালা জানান, খাড়িয়া ভাষায় কথা বলে এমন লোক খোঁজে পাওয়া কঠিন। খাড়িয়ারা নিজেদের মধ্যে সাদ্রিবাংলা, হিন্দি, খাড়িয়া ও দেশোয়ালি ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলায় প্রকৃত খাড়িয়া ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে।এখন খাড়িয়া ভাষার চর্চা একেবারে নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী  অধ্যাপক মাশরুর ইমতিয়াজ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, খাড়িয়া অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাপরিবারের মুণ্ডা শাখার অন্তর্গত একটি ভাষা। খাড়িয়া ভাষা বাংলাদেশে বিপন্নভাষাগুলোর অন্যতম। জর্জ গ্রিয়ারসন তার 'লিঙ্গুস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া' গ্রন্থে খাড়িয়া ভাষাকে একটি 'মৃতপ্রায়' ভাষা আখ্যায়িত করেন।

বাংলাদেশে এ ভাষার লিখিত কোনো রূপ নেই। বাংলাদেশে ভাষী সংখ্যা এত কম যে তা মৌখিক রূপইে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা প্রায় ৪০০০-৫০০০-এর মতো। তবে বাংলাদেশে এই ভাষায় কথা বলতে পারেন এমন সংখ্যা ২০-২৫ জনের বেশি নয়। এসব ভাষীদের বয়স ষাটেরও বেশি। বাংলাদেশে খাড়িয়া ভাষা হারিয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে, কেন না নতুন প্রজন্মের কেউই এই ভাষায় কথা বলতে পারেন না। সুতরাং শিক্ষার মাধ্যমেও এই ভাষাটি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে টিকিয়ে রাখার উদ্যোগ দেখা যায়নি।

তিনি জানান, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে এই ভাষার সংরক্ষণে যদি অতি জরুরি ভিত্তিতে ভাষার প্রামাণ্যকরণ করা না যায়, তাহলে এই খাড়িয়ে ভাষার টিকে থাকার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক এ এফ এম জাকারিয়া এই প্রতিবেদককে বলেন, the earth is one, but there are innumerable words. দার্শনিক সাপির-উরফ বলেছিলেন একটি ভাষা হারিয়ে ফেলা মানে একটা সভ্যতা, একটা সাংস্কৃতিক-সম্পদের ভাণ্ডারের প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। 

১৯৯৩ সালে ইউনেস্কো বিপদাপন্ন ভাষা প্রকল্পের আওতায় বিলুপ্তপ্রায় ভাষার শেষ মানুষটি মারা যাওয়ার আগেই তার সেই ভাষার নমুনা সংরক্ষণের একটা কর্মসূচি গ্রহণ করে। কিন্তু এই কর্মসূচির ফলপ্রসু উদ্যোগ নিয়ে খুব একটা শোনা যায়নি। খাড়িয়া ভাষার শেষ মানুষগুলো মারা যাবে এই দুই এক বছরের ভিতর। খাড়িয়া ভাষায় এখনো যারা কথা বলছেন, তাদের মুখ থেকে গল্প, গানগুলো রেকর্ড করে সেগুলো যথাযথ সংরক্ষণ করতে হবে। নয়তো খুব অল্পদিনেই হারিয়ে যাবে এই ভাষাটি।

ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, 'যেসব ভাষায় ২০-৩০ হাজারের নিচে মানুষ কথা বলে, সেসব ভাষা টিকিয়ে রাখা কষ্টকর। ভাষার উৎস খুঁজে পাওয়া তখন বড় মুশকিল হয়ে যায়। আমরা তখন খুঁজে পাই না, সেসব ভাষার মৌখিক রূপটি কেমন ছিল।'

'তবে আমরা বিলুপ্তপ্রায় ভাষাগুলো উদ্ধারে ব্যাকরণ বা অভিধান প্রণয়ণের জন্য কমিটি গঠন করেছি।'

নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলো যেন হারিয়ে না যায়, সেজন্য ভাষা সমীক্ষা কমিটি কাজ শুরু করবে বলে জানান তিনি। 

'তবে এই কাজটি হবে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার। নানা যাচাই-বাছাই করতে হবে, প্রকৃত উৎসও খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।'

২০১০ সালের শিক্ষা নীতিতে আদিবাসী শিশুদের নিজেদের ভাষা শেখার সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে তাদের জন্য আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছিল। আদিবাসী অধ্যুষিত যে সব এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কথাও বলা হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে এখন ৪০টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১৪টি ভাষাকে বিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা। তাদের মধ্যে খাড়িয়া একটি।

 

Comments

The Daily Star  | English

The constitution: Reforms only after a strong consensus

Constitutional reforms should be done after taking people’s opinions into account, said Dr Kamal Hossain, one of the framers of the constitution.

2h ago