সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য অপসারণ: সরকার যা করতে পারে, যা পারে না

২৮ আগস্ট হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ পলাতক অবস্থায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেওয়া বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরানোর আদেশ দেন।

আইনের দৃষ্টিতে পলাতক অবস্থায় তারেক রহমানের বক্তব্য ও বিবৃতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে সরাতে বিটিআরসির কার্যকর পদক্ষেপ চেয়ে করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেওয়া হয়।

ওইদিন এই আদেশকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থক আইনজীবীদের তর্ক, হইচই ও হট্টগোলের মধ্যে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চের ২ বিচারপতির এজলাস ত্যাগের ঘটনাও ঘটে।

পরে এই আদেশ দেওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এখন দেখা যেতে পারে—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে তথ্য অপসারণের ক্ষেত্রে কোনো দেশের সরকার কী করতে পারে আর কী পারে না-

সরাসরি যা করতে পারে সরকার

সরাসরি কারও কোনো পোস্ট বা কনটেন্ট অপসারণের সুযোগ কোনো দেশের সরকার বা কর্তৃপক্ষের নেই। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে, আইন বা নিয়ম লঙ্ঘন করলে নির্দিষ্ট পোস্ট বা বিষয়বস্তু অপসারণের জন্যে সরকারি কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করতে পারে।

তবে বিটিআরসির মতো নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো দেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থা কিংবা নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির কনটেন্ট, পোস্ট বা তথ্য সরিয়ে ফেলার জন্যে তাদের সেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কাছে আবেদন জানাতে হয়।

সাধারণত সরকারি সংস্থাগুলো কিছু নির্দিষ্ট পরিস্থিতি, যেমন আইনি কারণে, জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কোনো উদ্বেগ তৈরি হলে কিংবা স্থানীয় আইন ও নীতিমালা অনুসারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে নির্দিষ্ট বিষয়বস্তু বা ডেটা অপসারণের জন্যে অনুরোধ করতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা

এক্ষেত্রে সরাসরি কোনো ব্যক্তির ডেটা মুছে ফেলার ক্ষমতা কোনো দেশের ক্ষেত্রে সীমিত। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সাধারণত ডেটা পরিচালনা ও বিষয়বস্তু অপসারণের জন্য তাদের নিজস্ব নীতিমালা এবং প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। সেগুলোও আবার দেশ ও অঞ্চলভেদে ভিন্ন হতে পারে।

এছাড়া একটি দেশের সরকার কারও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে কতটুকু ডেটা মুছে ফেলার জন্যে আবেদন করতে পারবে তা-ও নির্ভর করে দেশটির আইন, প্ল্যাটফর্মের পরিষেবার শর্তাবলী এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতির উপর।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সাধারণত কিছু অপসারণের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব অপসারণের নীতি এবং প্রক্রিয়া অনুসারে নির্দিষ্ট দেশের আইনি বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করার পর সরকারি অনুরোধ অনুযায়ী সহযোগিতা করতে পারে।

বিভিন্ন দেশের আইন যা বলছে

তবে কোনো কোনো দেশের সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে তাদের দেশের আইন অনুযায়ী অবৈধ, ক্ষতিকারক বা দেশটির পরিষেবার শর্তাবলী লঙ্ঘন করে এমন কিছু অপসারণের আইন করেছে। এক্ষেত্রে জার্মানির নেটজডিজি আইন উল্লেখযোগ্য, যেখানে 'স্পষ্টভাবে বেআইনি' কিছু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ করার বিধান রয়েছে। এই আইনের অধীনে ২০১৯ সালে ফেসবুককে ২ মিলিয়ন ইউরো জরিমানা করা হয়।

অন্যদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের জেনারেল ডেটা প্রোটেকশন রেগুলেশন-এর অধীনে এরকম বিধানও রয়েছে, যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো যদি তাদের সাইট থেকে এক ঘন্টার মধ্যে 'উগ্রবাদ সংক্রান্ত' কোনো কনটেন্ট মুছে না ফেলে, তাহলে তাদের জরিমানা গুনতে হবে।

ভারতেও সম্প্রতি এ ধরনের কিছু ঘটনা ঘটেছে। টুইটারকে (বর্তমানে এক্স) কিছু ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ও তথ্য মুছে দিতে বলা সত্ত্বেও তা মানেনি প্রতিষ্ঠানটি, যার ফলে তাদের মোটা অংকের জরিমানা করে মোদি সরকার। এর কারণ হিসেবে ভারতীয় আইন অমান্যের কথা বলা হয়েছে। 

তবে, এই আইনগুলো কোনো দেশের সরকারকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে সরাসরি অন্য কারও ডেটা সরানোর ক্ষমতা দেয় না। যখন কনটেন্টগুলো বেআইনি বা ক্ষতিকারক বিষয়বস্তুর শ্রেণীভুক্ত হয় তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমই কাজটি করে থাকে।

তাই সরকার সাধারণত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে অন্য কারও ডেটা সরাসরি অপসারণ করতে সক্ষম হবে না; তবে যদি সেটি করার কোনো আইনগত ভিত্তি এবং বৈধ কারণ থাকে তাহলে তারা সেটি আবেদনের মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মটির সঙ্গে একটি বোঝাপড়ায় আসতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভেদে কনটেন্ট অপসারণের উপায়

একেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষয়বস্তু অপসারণের জন্য সরকারি অনুরোধে সাড়া দেওয়ার একেক উপায় আছে।

ফেসবুকের ক্ষেত্রে তাদের একটি 'কনটেন্ট রিকোয়েস্ট সিস্টেম' নামে পোর্টাল রয়েছে, যেখানে সরকারি কর্মকর্তারা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সরাসরি এমন কনটেন্ট সম্পর্কে অভিযোগ জমা দিতে পারেন। স্থানীয় আইন বা ফেসবুকের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন করলে ফেসবুক সেই অনুরোধগুলো পর্যালোচনা করে। তারপর তারা তাদের নিজস্ব নীতি এবং দেশটির আইনি প্রেক্ষাপটের ওপর ভিত্তি করে বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ বা অপসারণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

টুইটারও কোনো কনটেন্ট বা বিষয়বস্তু অপসারণের জন্য সরকারি অনুরোধগুলো পর্যালোচনা করে। সেখান থেকে তারা তাদের নিজস্ব নিয়ম এবং স্থানীয় আইনের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয়। সরকারি কর্তৃপক্ষ যদি কোনো বৈধ এবং যুক্তিসঙ্গত আবেদন করে সেক্ষেত্রে টুইটার সেই কনটেন্টগুলো আটকে দিতে পারে।

গুগলও কোনো কনটেন্ট অপসারণের জন্য সরকারি অনুরোধগুলোকে মূল্যায়ন করে এবং তার নিজস্ব নীতি ও স্থানীয় আইনগুলোর উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেয়৷ এক্ষেত্রে, কিছু নির্দিষ্ট দেশে স্থানীয় আইন লঙ্ঘন করে এমন বিষয়বস্তুতে গুগল অ্যাক্সেস সীমাবদ্ধ করে দিতে পারে।

 

তথ্যসূত্র: বিবিসি, আলজাজিরা, বিজনেস ইনসাইডার, নিউ স্টেটসম্যান

Comments