যে কারণে রোলেক্স ঘড়ি এত দামি
যাদের ঘড়ির প্রতি শখ আছে, তাদের কাছে রোলেক্স একটি স্বপ্নের নাম। ঘড়ি প্রেমিকের পছন্দের তালিকায় রোলেক্স নেই এমনটা হতেই পারে না। অসাধারণ এই ঘড়ির দামও ঠিক তেমনি আকাশচুম্বী।
সাধারণত সেলিব্রেটি ও বিভিন্ন স্পোর্টসম্যানদের রোলেক্স ঘড়ি পড়তে দেখা যায়। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকা এই ঘড়ির বিভিন্ন মডেলের মূল্যও লাখের উপরে। বিভিন্ন সিনেমা ও সিরিজে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের হাতে থাকা রোলেক্স ঘড়ি বিশেষভাবে মানুষের নজর কাড়ে। বিশেষ করে জেমস বন্ডের বিভিন্ন গয়েন্দা সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্যে রোলেক্স ঘড়ির ব্যবহার সময়ের একটি আলাদা তাৎপর্যই যেন বহন করে চলেছে।
১৯০৫-এর দিকে ইংল্যান্ডে শুরু হয় এই ঘড়ির যাত্রা। শুরুটা ইংল্যান্ডে হলেও পরে তা সুইজারল্যান্ডে স্থানান্তর করা হয়। তবে শুরুতেই এই ঘড়ির দাম এতটা হয়নি। ধীরে ধীরে ঘড়ির দাম তাদের উচ্চ মানের জন্যই বাড়তে থাকে। ঘড়ির ডিজাইনের কার্যক্ষমতার সঙ্গে এই ঘড়ির জীবনকালও প্রশংসনীয়। যত্নের সঙ্গে ব্যবহার করলে কোনো কোনো ঘড়ি টিকে যায় প্রায় শত বছর যা কোনো মানুষের আয়ুষ্কালের চেয়েও বেশি সময়।
এতটা শক্তিশালী ও দৃষ্টিনন্দন ঘড়ির দামও তাই সেরকমই হবে, সেটাই স্বাভাবিক বিষয়। এগুলো ছাড়াও রোলেক্স ঘড়ির রয়েছে এমন কিছু বিশেষ দিক যা অন্য অনেক ব্র্যান্ডের ঘড়িতে নেই। রোলেক্স কেন অন্য ঘড়ি থেকে আলাদা সে বিষয়ে আজকের আলোচনা।
সুচিন্তিত ও নান্দনিক ডিজাইন
রোলেক্স ঘড়ির এত বেশি দাম হবার অন্যতম কারণ হলো এই ঘড়ির ডিজাইনের নান্দনিকতা। ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই ঘড়িগুলো অনেক বেশি নানন্দনিক। খেলোয়াড় থেকে শুরু করে সাঁতারু কিংবা কোনো ফ্যাশন আইকোন; যেই হোক না কেন তাদের জন্য রোলেক্সের রয়েছে কোনো না কোনো বিষেশ আয়োজন। অর্থাৎ গ্রাহকের পেশার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই তৈরি করা হয় রোলেক্স ঘড়ি। বিভিন্ন পেশার মানুষের উপযোগী করে এই ঘড়ির ডিজাইন করা হয়।
৯০৪এল স্টেইনলেস স্টিলের ব্যবহার
সাধারণ যেসব ঘড়ি পাওয়া যায়, সেগুলোর তুলনায় রোলেক্স ঘড়ির ভিন্ন হবার অন্যতম কারণ এতে বিশেষ ধরনের স্টেইনলেস স্টিলের ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য ব্র্যান্ডের ঘড়িতে যেখানে ৩১৬এল স্টেইনলেস স্টিল ব্যবহার করে সেখানে রোলেক্স ঘড়িতে ব্যবহার করা হয় ৯০৪এল স্টেইনলেস স্টিল। এই স্টিল অন্য যেকোনো স্টিল থেকে অনেক বেশি চকচকে ও অনেক বেশি শক্তিশালী। ২০০৩ সাল থেকে মূলত রোলেক্স এই স্টিলের ব্যবহার শুরু করে।
বর্তমানে রোলেক্স ঘড়ির ভেতরের প্রায় সব মেশিনই এই স্টিলের তৈরি। এ ধরনের স্টিল বানানোর জন্য কর্মীদের অতিরিক্ত শ্রম দিতে হয়, কাজটিও করতে হয় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গ। সেই সঙ্গে এই স্টিলের খুঁটিনাটি যন্ত্রপাতি তৈরির কাজটিও বেশ কষ্টসাধ্য।
পানিপ্রতিরোধ ক্ষমতা
রোলেক্স ঘড়িতে পানি প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক বেশি। অনেক ধরনের রোলেক্স ঘড়ি আছে যেগুলো পানির প্রায় ৩০০ মিটার নিচে থেকেও পানি অভেদ্য থাকে। প্রতিটি ঘড়ি তৈরির সময় সেগুলো বিভিন্ন উচ্চতার পানির পরীক্ষার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। প্রথমে পরীক্ষার জন্য ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন চাপযুক্ত ট্যাংক, তার পরে বাইরের আবহাওয়াতে সেগুলোকে পরীক্ষা করা হয়। রোলেক্স সাবমেরিন মডেলের ঘড়িগুলো পরীক্ষা করার জন্য তারা কমেক্সের তৈরি বিশেষ ধরনের চাপযুক্ত ট্যাংক ব্যবহার করে থাকেন। এমন পরীক্ষা করা ও পানি থেকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠাও রোলেক্স ঘড়ির দাম বেশি হওয়ার অন্যতম একটি কারণ।
ব্যয়বহুল ডিজাইন
রোলেক্স ঘড়ির ডিজাইনের দিক থেকে একেবারে ইউনিক। এ ঘড়ির ডিজাইন তৈরিতে নেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি সময়। কাজ করেন অভিজ্ঞ সব ডিজাইনাররা। তাদের দক্ষতা ও নানা ধরনের পারদর্শিতার জন্য গুনতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। তাই প্রতিটি ঘড়ির ডিজাইনের ওপরও নির্ভর করে দাম।
রোলেক্স কোম্পানি চেষ্টা করে, তাদের ঘড়ি প্রায় সব ধরনের পেশার মানুষের জন্যই তৈরি করতে কিন্তু ব্র্যান্ড ভ্যালুর কারণে অনেক ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না।
সম্পূর্ণ হাতের সাহায্যে অ্যাসেম্বেল
রোলেক্স ঘড়ির তৈরির জন্য বিশেষ এক ধরনের রোবট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ওই রোবটের সাহায্যে বিভিন্ন পার্টস তৈরি করা হয়ে থাকলেও বিভিন্ন পার্টস অ্যাসেম্বল করা হয় হাতের সাহায্যে। এত সূক্ষ্ম ধরনের কাজের জন্য যেমন দিতে হয় অনেক বেশি সময়, ঠিক তেমনিভাবে হাতের স্পর্শ রোলেক্স ঘড়িকে আরও বেশি মূল্যবান বানিয়ে তোলে।
দক্ষ ও অভিজ্ঞ জেমোলজিস্ট বা রত্নবিদ
রোলেক্স ঘড়ি মূলত একটি আভিজাত্যের প্রতীক। ঘড়িটি বিলাসবহুল হিসেবে তৈরি করতে ঘড়ির মধ্যেই যুক্ত করা হয় নানা রকমের মূল্যবান ধাতব। মুক্তা, হীরা কিংবা স্বর্ণের এই বিশেষ কাজের জন্য রোলেক্স কোম্পানির রয়েছে নিজস্ব কিছু জেমোলজিস্ট বা রত্নবিদ। তারা ঘড়ির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ধাতব ও মূল্যবান সব মণিমুক্তা সংযোজন করে থাকেন।
সেই সঙ্গে অনেক জুয়েলারি কোম্পানির সঙ্গেও রোলেক্সের আলাদা সম্পর্ক রয়েছে। তাদের কারিগর দিয়ে সূক্ষ্ম হীরা বা স্বর্ণের পাত বাসানোর কাজগুলো অতি সূক্ষ্মতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হয়। এই কারিগরী ব্যয় ঘড়ির ব্যয়ের সঙ্গেই যুক্ত। যার ফলে দাম বাড়ে ঘড়ির।
বিভিন্ন ধরনের গবেষণা
প্রতিটি নতুন ডিজাইনের নেপথ্যে থাকে অনেক বেশি গবেষণা। সেই সঙ্গে এই গবেষণার কাজে যুক্ত থাকেন অনেকগুলো বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক। রোলেক্স ঘড়ির উন্নত ধরন নিয়ে গবেষণা ও পরীক্ষণের জন্য রয়েছে আলাদা গবেষণাগার ও ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট। যা এই ঘড়ির সার্বিক উন্নয়নের জন্য সারাক্ষণ কাজ করে যাচ্ছে।
এ ছাড়া রোলেক্সের রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ল্যাবরেটরি, যেখানে ঘড়ি ম্যানুফ্যাকচার সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরিক্ষা চলে। রোলেক্সের ল্যাবগুলোতে রয়েছে নানা ধরনের বিশ্বসেরা সুযোগ সুবিধা। গবেষক দলে থাকেন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সব বিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ, যারা ঘড়িতে ব্যবহারযোগ্য তেল ও লুব্রিক্যান্ট নিয়েও গবেষণা করেন।
ঘড়ির অন্যান্য অংশগুলোর জন্যও রয়েছে আলাদা সব ল্যাব রুম ও টেস্ট সেন্টার। একটি ঘড়ি এতটা দীর্ঘস্থায়ী হবার পেছনে এসব গবেষণা প্রক্রিয়ার কোনো বিকল্প নেই।
ঘড়িতে সংযুক্ত হয় মূল্যবান ধাতব
রোলেক্স একমাত্র ব্র্যান্ড যারা নিজেদের ঘড়িতে ব্যবহারের জন্য আলাদাভাবে স্বর্ণ উৎপাদন করে থাকে। এ জন্য ২৪ ক্যারেট গোল্ডকে বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে ১৮ ক্যারেটের হলুদ, সাদা ও সোনালি রংয়ে রূপান্তরিত করা হয়। আর রোলেক্সের বিভিন্ন মডেলের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে বেশি দামি সেগুলোতে নানা ধরনের ডায়মন্ড ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হয়।
রোলেক্সের গুণগতমান
বিভিন্ন ধরনের ঘড়ির মধ্যে কোয়ালিটি মেইনটেইনের দিক দিয়ে এগিয়ে রয়েছে রোলেক্স। প্রতিটি ফিচার যুক্ত হওয়ার পরই ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়। যার ফলে একটি ঘড়ি বানাতেই প্রায় বছরের মতো সময় লেগে যায়। তাই ঘড়িগুলোর দাম বেশি হওয়ার পেছনে এর কোয়ালিটিও অনেকটা দায়ী। একটি ঘড়ি অনায়েসে অর্ধশতাব্দী টিকে যায়। সেজন্য দরকার প্রতিটি কারিগরি কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে হয়।
এইগুলো বাদেও বর্তমানে রোলস রয়েসের রয়েছে অন্যতম ব্র্যান্ড ভ্যালু। আর এই ব্র্যান্ড ভ্যালুর জন্যই ঘড়ির দামও বেশি।
রোলেক্স ঘড়ির দাম
বেশিরভাগ মডেলের রোলেক্স ঘড়ির দাম ১০ থেকে ২০ হাজার ডলারের মধ্যে হলেও ঘড়ি বিষয়ক ওয়েবসাইট আওয়ারস্ট্রাপসডটকমের তথ্যমতে, ১৯৭০ সালের ভিনটেজ রোলেক্স ডেটজাস্ট মডেলের ঘড়িটির মূল্য শুরু হয়েছে ৩ হাজার ডলার থেকে। তবে এটির ১৯৯০ সালের মডেলগুলোর দাম ৪ হাজার ডলার থেকে শুরু। এটি রোলেক্সের সবচেয়ে কমদামি মডেলগুলোর মধ্যে অন্যতম।
অন্যদিকে সবেচেয়ে দামি হিসেবে নিলামে ১ কোটি ৭৭ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারে বিক্রি হয় একটি রোলেক্স ঘড়ি।
তথ্যসূত্র: ওয়াচশপিংডটকম, স্যামুয়েলসনডায়ামন্ড ও দ্যওয়াচকোম্পানি
গ্রন্থনা: আরউইন আহমেদ মিতু
Comments