সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেন্সরশিপ: কতটা কার্যকর?
আমাদের ভালো লাগুক বা না লাগুক, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেকদিন ধরেই সবার জীবনের একটি বড় অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত এর শুরুটা হয়েছিল মানুষের মতপ্রকাশের একটি মুক্ত পরিসর হিসেবে, বন্ধুবান্ধব-পরিজনদের সঙ্গে যোগাযোগ ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন মানূষের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য। তবে বছরের পর বছর ধরে এর কার্যক্রম আরো বিস্তৃত হয়েছে। দিনে দিনে এর ভূমিকা বদলে সমান্তরাল সংবাদমাধ্যম, অনলাইন বাজার এবং আরো অনেক কিছুতে রূপান্তরিত হয়েছে।
ইন্টারনেট যত সহজলভ্য হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যাও আকাশ ছুঁয়েছে। ফলে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে কনটেন্ট তৈরি ও প্রচারের পরিমাণও। সেইসঙ্গে বহুমুখী কনটেন্টের প্রচার ভাবিয়েছে সামাজিকমাধ্যমের পেছনে থাকা লোকজনকে। কখন কোথায় কী পোস্ট করা হচ্ছে এবং সেগুলো কতটা সংবেদনশীল, এসব বিষয় নজরদারি করার জন্য তারা উদ্যোগও নিয়েছেন। হেটস্পিচ, সাইবার বুলিইংয়ের মতো অপরাধ রোধের জন্য বিভিন্ন সেন্সরশিপ নীতিমালাও চালু করা হয়। কিন্তু এই নিয়ম-নীতি কতটা কার্যকর?
বিভিন্ন ওয়েবসাইটে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের সেন্সরশিপ নীতিমালা এবং এতে ব্যবহারকারীদের সাড়াটাও ভিন্ন। যেমন, অপেক্ষাকৃতভাবে টিকটকের ক্ষেত্রে বেশ কড়াকড়ি রয়েছে। কিছু নির্দিষ্ট শব্দ পোস্টে লিখলেই তা মুছে ফেলা হবে, এমনকি বন্ধ হয়ে যেতে পারে যে কারো টিকটক অ্যাকাউন্টও। সে হিসেবে ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক এবং টাম্বলার এখনো অনেক ছাড় দিয়ে রেখেছে। তবে এসব প্ল্যাটফর্মেও বেশ কিছু শব্দ ব্যবহার নিষিদ্ধ। এসব উদ্যোগের পেছনের ভাবনাটা মূলত নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে মানুষকে কথা বলার বিষয়ে নিরুৎসাহিত করা। সহজ কথায়, অনলাইন পরিসরে মানুষের আলোচনার বিষয়কে সীমাবদ্ধ করে দেয়া।
এমন সব সেন্সরশিপ আইনের কারণে অনেক সমস্যা তৈরি হয়। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে অনেক গুরুগম্ভীর বিষয়ই বিভিন্ন 'ট্যাবু' শব্দ ব্যবহার না করে পরিপূর্ণ হয় না। ভালো করে আলাপের জন্য কখনো কখনো মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার কোনো বিষয়বস্তুতেও সংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ে। এবং সেসব শব্দ জেনেবুঝে এড়িয়ে গেলে আলোচনাটাই যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তবে মানুষজন এরও টোটকা বের করেনি, তা নয়। অনেকেই 'কোড ওয়ার্ড' বা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করছেন, শব্দগুলো থেকে একটা-দুটো অক্ষর বদলে দিচ্ছেন বা হয়তো বাদই দিয়ে দিচ্ছেন।
এসব সংকেতকে শুধু নিজের অস্পষ্টতার মুখোশ ধরে রেখে অ্যালগরিদমের পাঁচিলটা টপকাতে হয়, তবে পাঠক প্রায় সময় বুঝতে পারে। তবে কখনো কখনো সাংকেতিক ভাষার পাঠোদ্ধার জটিল হয়ে দাঁড়ায়। থাকে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনাও।
একটা সময় ছিল যখন মানুষ যৌন হয়রানির মতো বিষয়গুলোকে 'মাসকারা' বা এমন কোনো 'ভদ্র' শব্দের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতো। এবং যারা বিষয়টি সম্পর্কে কিছুই জানতো না, বুঝতো না– তারা এসব সংকেত বুঝতেও পারতো না। তাই তারা এসব পোস্ট আক্ষরিক অর্থেই নিতো। এ থেকে আবার বহু তারকাসহ অনেকেই অসংবেদনশীল তকমা পেয়েছেন। অথচ তারা হয়তো বিষয়টি বুঝতেই পারেননি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সকলেই যে সবসময় সবধরনের 'ট্রেন্ড' জানেন না এবং ভুল করতে পারেন, এ বিষয়টা অনেকেই সদয় দৃষ্টিতে দেখতে পারেননি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা হয়তো এমন সব কনটেন্ট দেখতে চান না যেগুলো তাদেরকে আহত করতে পাড়ে। সেক্ষেত্রে টুইটারের মতো প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন শব্দ 'মিউট' করে দেবার উপায় আছে। মিউট করা শব্দসম্বলিত টুইট বার্তাগুলো সেই নির্দিষ্ট ব্যবহারকারীর টাইমলাইনে আর আসবে না। শব্দ নিষিদ্ধ করে দেয়া যায় ঠিকই, তবে কথা বলার ধরন নিয়ে এমন কোনো বিধিনিষেধের বিকল্প এখনো আসেনি। সেক্ষেত্রে অপছন্দের কনটেন্টগুলো চোখের সামনে পড়তেই পারে– তাই এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো সমাধান নেই।
কিন্তু এত সতর্কতা-সচেতনতার পরও চোরাগলি দিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক আলাপ বা হেটস্পিচ সিঁধ কেটে ঠিকই ঘরে, অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের টাইমলাইনে ঢুকে যেতে পারে। এসব পুরোপুরি বন্ধ করার কোনো উপায় বা সমাধান নেই। কেননা প্রতিদিন ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া লাখো পোস্ট ও কমেন্ট একটি একটি করে দেখে সেগুলোতে নজরদারি করা সম্ভব নয়। তাই বোধহয় কঠোর সেন্সরশিপই এসব সমস্যার মূল সমাধান হতে পারে না। প্রয়োজন অন্য কোনো পথের।
অনুবাদ করেছেন অনিন্দিতা চৌধুরী
মূল লেখা পড়তে ক্লিক করুন The problem with social media censorship
Comments