জেন্ডার বৈষম্য ভেঙে ফটোগ্রাফি যাদের পেশা

জেন্ডার বৈষম্য ভেঙে ফটোগ্রাফি যাদের পেশা
ছবিতে বামে নায়লা নূর ও ডানে সাবিনা ইয়াসমিন

আধুনিক জীবনের একেবারে কেন্দ্রে কয়েকটি বিষয়ের মধ্যে অন্যতম ফটোগ্রাফি। প্রতিদিনের কাজকর্মকে সংবাদ, স্মৃতি বা ডিজিটাল কনটেন্ট– যে রূপেই হোক না কেন, ধরে রাখতে ফটোগ্রাফির ভূমিকা অনেক। তবে এই পেশায় জেন্ডার গ্যাপটা বেশ চোখের পড়ার মতো। 

নারীকে যেন বেশিরভাগ সময় দেখা যায় ক্যামেরার সামনেই। কিন্তু ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, নারী সংখ্যাগরিষ্ঠ একটি দেশে কেন বেশিরভাগ কনটেন্ট এখনো পুরুষের দৃষ্টিতেই দেখা হয়? অবশ্য এ ক্ষেত্রে অনেকে এ তর্কও জুড়ে দিতে পারেন যে এ পেশার কঠিন সব 'চাহিদা' ধরে রাখতে নারীর সংখ্যা কম। কিন্তু আরও অনেক বিষয়ই রয়েছে, যার কারণে পেশাদারি ফটোগ্রাফিতে নারীদের অংশগ্রহণ ও অবদান এখনো অনেক বেশি সীমাবদ্ধ। 

সবকিছুর আগে বলতে হয়, ফটোগ্রাফি বেশ কঠিন একটি পেশা। এ বিষয়ে ফটোসাংবাদিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফার ফাবিহা মনির দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রায় সময় মাঠপর্যায়ে থাকা, ছবি তোলার তাগিদে একেকদিন একেক জায়গায় যাওয়া যেকোনো নারী ফটোগ্রাফারের জন্যই আলাদা একটা অভিজ্ঞতা।' যদিও এ ধরনের কঠিন পরিস্থিতি নারী ও পুরুষ, উভয়কেই ভোগায়– কিন্তু নারীদের ক্ষেত্রে সামাজিক ও পারিবারিক প্রত্যাশার চাপটা সব সময় বেশিই থাকে। তরুণ নারী ফটোগ্রাফারদের জন্য পরিবারের সঙ্গে সময় ও ঘোরাঘুরি সংক্রান্ত এসব সমস্যার সম্মুখীন হওয়াটা খুব একটা সহজ হয় না। 

ছবি: ফাবিহা মনির

ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার নায়লা নূর বলেন, 'আমার পরিবার, বন্ধু-পরিজন প্রায়ই আমাকে নিরাপত্তা কারনেই ফটোশুটের জন্য অনেক জায়গায় যেতে মানা করে।' যদিও এসব দুশ্চিন্তা বাস্তব পরিস্থিতিতে অনুপযোগী নয়, কিন্তু তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে কাজ আর প্রোডাকটিভিটির জন্য বাধা ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। বিভিন্ন আউটডোর লোকেশনে শুটে যাবার জন্য নারী ফটোগ্রাফারদের তাদের পোশাক-আশাক এবং সরঞ্জাম সে অনুযায়ী প্রস্তুত করতে হয়। নায়লা আক্ষেপ করেন যে, পুরুষ ফটোগ্রাফারদের এই বাড়তি ঝক্কি পোহাতে হয় না। আপাতদৃষ্টিতে এসব বাধা-বিপত্তি ছোটখাটো বলে মনে হলেও নিয়মিত যারা এসব ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যান, তাদের জন্য বিষয়টা অত্যন্ত কষ্টকর। 

কাজের অ্যাসাইনমেন্ট দেবার সময়ও নারীদের এমন সব কাজই দেওয়া হয়, যাতে কর্মদাতাকে তেমন একটা 'ঝামেলা' পোহাতে হয় না। 

সাবিনা ইয়াসমিন যখন প্রথম আলোতে ফটোসাংবাদিকের কাজ শুরু করেন, তাকে বেশিরভাগ সময় শুধু সাংস্কৃতিক বিটেই পাঠানো হতো– যেমন নারী-শিশু সংক্রান্ত ক্ষেত্রে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তিনি নিজেকে বারবার প্রমাণ করেছেন, মূল সংবাদের দায়িত্ব হাতে নিয়েছেন। এক যুগব্যাপী ক্যারিয়ারে সাবিনা ইয়াসমিন দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং আন্দোলনের মতো ইস্যুতেও কাজ করেছেন। এমনকি বর্তমানে পুরুষ সংখ্যাগরিষ্ঠ এই নির্দিষ্ট পেশাটিতে থাকার পরও তার তোলা ছবিগুলো বহুল পরিসরে ছড়িয়ে গেছে এবং সমাদৃত হয়েছে।

ছবি: নায়লা নূর

সাবিনা বলেন, 'নারীর জন্য তার ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন আলাদা করাটা বেশ কঠিন। যখনই কোনো কর্মক্ষেত্রে একজন নারী কাজ করতে আসেন, তাকে আগে নিজের ওপর থাকা বহু পারিবারিক ও সামাজিক প্রত্যাশার দায়ের মুখোমুখি হতে হয়।'

তার মতে, ফটোগ্রাফি, বিশেষত ফটোসাংবাদিকতাকে এখনো নারীর জন্য মানানসই ক্যারিয়ার হিসেবে দেখা হয় না। বরং কাজের জায়গায় অবিরত বৈষম্য আর লিঙ্গবাদী আচরণের কারণে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বাজে প্রভাব পড়ে। 

সাবিনা আরও বলেন, সামাজিক ও পারিবারিক চাপের পাশাপাশি এসব বাড়তি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পেরে এ পেশায় থাকা অনেক নারী নিজে থেকেই চাকরি ছেড়ে দেন। 

এ ছাড়া নারী ফটোগ্রাফারদের জন্য বেতন বা পারিশ্রমিকের বিষয়টি আরেক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু তাদের অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে পারিশ্রমিকও গোনা হয় কম। এমনকি ফ্রিল্যান্সিং বা স্বাধীন কাজের ক্ষেত্রেও নারী ফটোগ্রাফাররা কম টাকা পান। অনেক ক্লায়েন্ট তো শুধু তখনই নারীদের নিয়োগ দেন, যখন তাদের বাজেট কম থাকে। এ ছাড়া এ পেশায় নারীর সংখ্যা কম হওয়ায় সেরকম উদাহরণও সৃষ্টি হচ্ছে না। এ দেশে সামনের সারির অনেক গণমাধ্যম ও সংবাদপত্রেই এখনো পর্যন্ত কোনো নারী ফটোগ্রাফার বা ফটোসাংবাদিক নেই। 

প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন নারী ফটোগ্রাফারের কাজকে ছাড়িয়ে যায় তার নিরাপত্তার বিষয়টি। অন্যদিকে পুরুষ নিজেদের নিরাপত্তার কথা না ভেবেই যেন গল্প খোঁজার উদ্দেশ্যে যেকোনো অজানা স্থানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তবে নারীদের ভাগ্য এ ক্ষেত্রে অতটা সুপ্রসন্ন নয়। নারী ফটোগ্রাফারের ছবি তোলায় তো দেশের মানুষও খুব একটা সাড়া দিতে চায় না। 'বনের দিঘি' নামের লোকাল সিনেমাটোগ্রাফি ও ভিজ্যুয়াল স্টাইলিং ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী ফৌজিয়া জাহান জানান, 'আউটডোর শুটগুলোতে আমাকে প্রায়ই পথচারীদের কটু কথা শুনতে হয়।' 

ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

তিনি আরও বলেন, 'নারী ফটোগ্রাফারদের ক্ষেত্রে সমাজে একটি ধারণা বজায় আছে– তারা ঠিক যান্ত্রিক কারিগরি বুঝতে পারে না ও বড় দায়িত্ব সামলানো নারীর কম্মো নয়।' 

নায়লা নূর যখন তার প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি ব্র্যান্ড 'আলো প্রোডাকশনস' শুরু করেন, তখন তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে ব্র্যান্ডটির সঙ্গে 'নারী ফটোগ্রাফার' তকমাটা খুব স্বাভাবিকভাবেই এঁটে দেওয়া হয়েছে। নায়লা এও বলেন, 'শুধু আমার জেন্ডারের কারণে সম্ভাব্য ক্লায়েন্টরা প্রায়ই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান যে আমি আসলে কাজটা ঠিকঠাক করে দিতে পারব কি না।'

এ ধরনের চলমান বৈষম্য আর জেন্ডার বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে নারী ফটোগ্রাফাররা এমনিতেই হতোদ্যম হয়ে পড়েন। কাজের জায়গায় এভাবে কোনো সুযোগ না পেয়েই বাদ পড়ে যাবার মতো দুঃখজনক বিষয় আর হয় না।

নারী ফটোগ্রাফারদের অন্যতম একটি উপলব্ধি হচ্ছে, এ পেশায় নারীদের অপেক্ষাকৃত কম উপস্থাপন করার বিষয়টি। এমনকি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত, অত্যন্ত সক্রিয় নারী ফটোগ্রাফাররাও ডিজিটাল পরিসরে তাদের প্রাপ্য স্থানটি পান না। সম্প্রতি একটি প্রধান সারির সংবাদপত্রে বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি দুনিয়া ও এর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি নিয়ে একটি লেখা ছাপা হয়। কিন্তু তাতে একজনও নারীর নাম নেই। ভাবলে অবাকই লাগে!

সে যাই হোক, এসবের পরও নারী ফটোগ্রাফাররা নিজেদের নিয়ে গর্ব করার মতো কাজ করে যাচ্ছেন। ফৌজিয়া মূলত আমাদের দেশে নারী উদ্যোক্তাদের উন্নতির যাত্রাকে নারী ফটোগ্রাফারদের জন্যও অন্যতম মাইলফলক বলে মনে করেন। যদিও সব ক্ষেত্রে তাদেরকে বৈষম্যমূলক আচরণের সম্মুখীন হতে হয়; তারপরও ফাবিহা বিশ্বাস করেন, 'আমাদের মনোযোগের মূল কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত শিল্প এবং শৈল্পিক উৎসাহ। কেন না দিনশেষে, আমাদের কাজই আমাদের অবস্থান জানান দেবে।' 

তিনি বলেন, 'যে ফটোগ্রাফারদের নিয়মিত শিল্প, সাহিত্য, মুদ্রণ, নকশা ও ইলাস্ট্রেশনের মতো বিষয়গুলোতে নজর দেওয়া দরকার।'

'এভাবেই তারা আরও বৃহৎ পরিসরে সৃজনশীল জগতে প্রবেশের জন্য নিজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রস্তুত করতে পারবেন।' 

এ লেখায় উঠে আসা সব ফটোগ্রাফারই বিশ্বাস করেন, তরুণ ফটোগ্রাফারদের উচিত নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন কোর্স ও ডিগ্রিতে অংশ নেওয়া। আমাদের দেশেও এমন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে ফটোগ্রাফি কোর্স শিক্ষা দেওয়া হয়। ফাবিহা মনে করেন, নতুন ফটোগ্রাফারদের একেকজন মেন্টর বা গুরুর অধীনে কাজ করা উচিত। এতে করে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতা আরও বেশি সমৃদ্ধ হবে। 

ছবি: ফৌজিয়া জাহান

এ পেশার মেঘাচ্ছন্ন আকাশে ভালো করে তাকালে এখনো ঝিকিমিকি রোদ খেলা করে। অনেকেই নিজেদের কাজের ধরনের ভিত্তিতে নারী ফটোগ্রাফারদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। ফৌজিয়া বিশ্বাস রাখেন, যেকোনো বিষয়গত ধারণা উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীরা অনেক বেশি এগিয়ে, যার ফলে তারা তাদের সহকর্মীদের চেয়ে এগিয়ে থাকেন। সংখ্যায় কম হলেও তারা আছেন এবং মূলধারার ফটোগ্রাফিতে বৈচিত্র্য যোগ করাই তাদের লক্ষ্য। 

এ বিষয়ে সাবিনা বলেন, 'আমাদের তোলা ছবিগুলো কিন্তু জেন্ডার দেখে না। আমরা মানুষেরাই জেন্ডারভিত্তিক শিল্পকেও আলাদা করে ফেলি।' নারী ফটোগ্রাফাররা নিজেদের জায়গায় বেশ ভালোভাবেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে গত দশকে এ সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাধা-বিপত্তি, বৈষম্য থাকার পরও নারী ফটোগ্রাফারদের নিজেদের তাগিদে কাজ করে যেতে হবে। 

সাবিনা মনে করেন, নারীদের এ পেশায় ধৈর্য ধরে রাখতে হবে এবং নির্ভীকভাবে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ে তুলতে হবে। 

সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতে নারী ফটোগ্রাফাররা জয়ের হাসি হাসুক– অতিক্রম করে যাক যেকোনো বাধা-বিপত্তি বা পক্ষপাতের দেয়াল। 

অনুবাদ: অনিন্দিতা চৌধুরী

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhoury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands.

3h ago