‘অ্যাপল’ কোম্পানির নামকরণ ও কয়েকটি গল্প
গল্পটা আপেলের। না, 'ওয়ান অ্যাপল আ ডে কিপস দ্য ডক্টর অ্যাওয়ে' অথবা পদার্থবিজ্ঞানের বহুবার শোনা, নিউটনের মাথায় টুপ করে পড়া সেই আপেল নয়– এটি আরও বহু বছর পরের যান্ত্রিক সব মলাটে ছাপা, একটা আধখাওয়া আপেলের গল্প। যে আপেলের ছবিওলা যেকোনো পণ্যই এখন মানুষের উইশলিস্টে থাকে।
নামকরণের পেছনে একটি নয় বরং একাধিক কারণ রয়েছে। কিছু তার অনুমান, কিছু মতামত। কিছু সত্য, কিছু গল্প।
স্যার নিউটন
যদিও গল্পটা স্যার আইজ্যাক নিউটনের নয়, তবে এ গল্পে কোথাও না কোথাও নিউটনও আছেন। কেন না অ্যাপলের লোগোর প্রাথমিক অবস্থায়, আপেল গাছের নিচে বসে থাকা নিউটনের অবয়বও যুক্ত ছিল– পরে সরল রূপ আনার জন্য হয়তো তা সরানো হয়। তবে এই প্রাথমিক লোগোটি ডিজাইন করেছিলেন খোদ স্টিভ জবস। নিউটনের প্রতি জবসের শ্রদ্ধাবোধ ও আকর্ষণটা বেশ স্পষ্ট, তাই কোম্পানির নামটিও নিউটনের গল্প থেকে ধার করা হলে অবাক হবার কিছু নেই।
অ্যালান টিউরিং
ব্রিটিশ গণিতবিদ অ্যালান টিউরিংয়ের মৃত্যুর সঙ্গেও এর পরোক্ষ সংযোগ থাকতে পারে বলে অনেকেই মনে করেন। 'এনিগমা কোড-ব্রেকার' খ্যাত এই ক্ষণজন্মাকে তাত্ত্বিক কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক মনে করা হয়। মাত্র ৪২ বছর বয়সে তার মৃত্যুর কারণ দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা, এ নিয়েও বহু মতভেদ আছে।
তবে গৃহপরিচারিকা তাকে যখন বিছানায় মৃত অবস্থায় পেয়েছিলেন, একটি আধখাওয়া আপেল পড়ে ছিল পাশের টেবিলে। জানা যায়, সায়ানাইডের বিষক্রিয়াই ছিল অ্যালানের মৃত্যুর কারণ। তাই অনেকের ধারণা, এই প্রতিভাধরকে সম্মান জানাতে বহু বছর পর স্টিভ ওজনিয়াক ও স্টিভ জবস তাদের কোম্পানির লোগো হিসেবে বেছে নেন একটি আধখাওয়া আপেলকেই। যদিও তা সত্য নয়।
হয়তো উপকথা
মানবজাতির সৃষ্টির গল্প নিয়ে যেসব উপকথা সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, এর মধ্যে অ্যাডাম-ইভের গল্প অন্যতম। যে ফলটি খেয়ে নিষিদ্ধ কৌতূহলের বশে শেষমেশ স্বর্গচ্যুত হন তারা, সেটি কী ফল ছিল বলতে পারেন? হ্যাঁ, আজকের এ লেখার মূল বিষয়– অর্থাৎ, আপেল। তাদের এই কৌতূহলকে কেউ কেউ ধরেন জ্ঞানের তৃষ্ণা হিসেবেও, আর কম্পিউটার প্রযুক্তির অন্যতম উদ্দেশ্য জ্ঞানেরই চর্চা। বেশ মাথা খাটিয়ে দুয়ে দুয়ে ৪ মিলিয়ে তাই মনে করাই যায়, অ্যাপল কোম্পানির নামটা এসেছে অ্যাডাম-ইভের গল্প থেকে।
কিংবা রূপকথা
যে কথাটা খুব একটা 'থিওরি' হয়ে উঠে আসেনি অ্যাপলের নামকরণে, তবে আসতে পারতো– তা হচ্ছে রূপকথা। স্টিভ জবস রূপকথা ভালোবাসেন বলে সেভাবে কোথাও বলেননি ঠিকই, কিন্তু তার ম্যাক ডিজাইনের সময় একটি প্রজেক্টের কোডনেম ছিল 'স্নো-হোয়াইট'। আর রূপকথার স্নো হোয়াইট যে সৎমায়ের বিষাক্ত আপেল খেয়ে গভীর নিদ্রায় ঢলে পড়েছিল, তা কে না জানে? এমন হতেই পারে যে রূপকথার এই চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে স্টিভ জবস নাম আর লোগোর জন্য আপেলের দিকে ঝুঁকে পড়েন। হয়তো অ্যালান টিউরিং নয়, আধখাওয়া আপেলটা স্নো হোয়াইটের হাত থেকে খসে পড়ে। এ ধারণা সত্য কি না, তা কখনো যাচাই করা হয়নি যেহেতু 'অনুমান' হিসেবেই ধরা থাক।
নিছক পছন্দের বশে
সব গল্পকথা ছাড়িয়ে ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা জীবনীতে উঠে আসে স্টিভ জবস ও অ্যাপলের নামকরণের সত্যটা। জবস নাকি সে সময় এক আপেল খামারে বেড়াতে গিয়েছিলেন। এরপর কোম্পানির নাম রাখতে গিয়ে এমন সহজ, আকর্ষণীয় আর ঘরোয়া নামটাই বেছে নিলেন। নামকরণের বিষয়ে এ যাত্রায় জবসের সহনায়ক স্টিভ ওজনিয়াক বলেন, ''আমার মনে আছে, সেদিন স্টিভ জবসকে নিয়ে হাইওয়ে এইটি ফাইভের রাস্তাটা দিয়ে বিমানবন্দর থেকে ফিরছিলাম। তখন সে অরিগোনে অ্যাপল অর্চার্ড নামের এক জায়গা থেকে ফিরছিল। তখনই সে এই নামের কথা বললো– 'অ্যাপল কম্পিউটার।'
জাফর ইকবালের 'প্রজেক্ট নেবুলা' নামের একটি সায়েন্স ফিকশনের দুটো কথা এখানে বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। নিশীতা রিয়াজ হাসানকে জিজ্ঞেস করেছিল, তার বানানো কথোপকথন সফটওয়্যারের নাম 'এপসিলন' কেন? উত্তরে রিয়াজ যা বলে, তাই হয়তো এ আলাপেরও শেষ কথা– 'যদি এর নাম হতো তেতাল্লিশ, আপনি তবুও জিজ্ঞেস করতেন এর তেতাল্লিশ কেন; যদি এর নাম হতো বকুল ফুল, আপনি জিজ্ঞেস করতেন বকুল ফুল কেন হলো?'
ধরে নেওয়া যায়, নিছক পছন্দ ছাড়া তেমন কোনো কারণ ছিল না এই নামকরণের, ঠিক যেমনটা হয় বেশিরভাগ বিষয়েই। যদিও অ্যাপলকে আর এর নামকে ঘিরে তৈরি হওয়া গল্পগুলো বেশ মজার, তাতে সন্দেহ নেই।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, ম্যাকওয়ার্ল্ডডটকম, এমইউও
Comments