অমরত্বের জন্য স্টোকসের আর কি চাই?

Ben Stokes
এমন উল্লাস স্টোকসকেই মানায়

স্রেফ পরিসংখ্যান দিয়ে মাপতে গেলে হয়ত তল পাওয়া যাবে না। র্যাঙ্কিং ঘেঁটে দেখতে গেলে মিলবে 'ভুল ছবি'। র্যাঙ্কিং নির্ধারণের সফটওয়্যার যে 'ইম্পেক্ট', পরিস্থিতি আর প্রেক্ষাপটের বিচার করতে জানে না। বেন স্টোকসকে মাপতে হলে দেখতে হবে বড় মঞ্চের আসল সময়। সেই 'সময়ের ডাক' এইসময়ে তারচেয়ে আর কেউ যে বেশি শুনেননি।

প্রথম দল হিসেবে ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন তকমাটা এখন ইংল্যান্ডের। এবং দুটোই পাইয়ে দেওয়ার মূল কারিগরদের একজন হচ্ছেন স্টোকস। টেস্টে ইংল্যান্ডকে পাইয়ে দিয়েছেন সব সময়ের সেরা এক জয়। খেলছেন ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা এক ইনিংস। আর পেস বোলিংয়ে সবগুলোতেই তিনি ভীষণ 'ইম্পেক্ট' পারফর্মার।

২০১৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের তিনি নায়ক। লর্ডসের ময়দানে ৯৮ বলে ৮৪ রানের ইনিংসটা তো রূপকথা। ক্রিকেট ইতিহাস এরকম কোন ম্যাচ কোনদিন দেখেনি।

পরিসংখ্যান কি বোঝাতে পারবে সেদিন স্টোকস কি করেছিলেন? এক পাশে একের পর এক উইকেট পড়ছে। ভরা গ্যালারির তুমুল চাপে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। প্রথমে জস বাটলারকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেন। শেষটার আগে বাটলারও ফিরে গেলেন। স্টোকস ধরে রাখলেন নাটাই, স্টোকস জন্ম দিলেন নাটকীয়তা, স্টোকস কেড়ে নিলেন সব আলো। ম্যাচ টাই হলো, সুপার ওভারে গেল, সেখানেও স্টোকস।

অফিসিয়ালি ম্যাচটা টাই-ই হয়ে আছে। কিন্তু বাউন্ডারি বেশি থাকার নিয়মে প্রথমবার বিশ্বকাপ উঠে ক্রিকেটের জনক দেশ ইংল্যান্ডের হাতে, স্টোকসের হাতে।

বয়স ৩১ পেরিয়েছে। এখনো ভেতরে অনেক খেলা বাকি। কিন্তু স্টোকসের মতো খেলোয়াড়রা কেবল খেলার জন্যই খেলেন না। বড় মঞ্চে, বড় অর্জনের তাড়না তাদের তীব্রভাবে টানে।

চাইলে ওয়ানডের পরিসংখ্যান ভিন্ন ধাপে নিতে পারতেন। কিন্তু হুট করে ওয়ানডেটাই ছেড়ে দিলেন। ১০৫ ওয়ানডের ক্যারিয়ারের পরিসংখ্যান বোঝাতে পারবে না স্টোকসের শ্রেষ্ঠত্ব। তার অমরত্বের কথা জানতে হলে যেতে হবে ঊনিশ সালের জুলাই মাসে লর্ডসের বিকেলে।

ইংলিশ গ্রীষ্মে জুলাই মাসে অমন দুনিয়া তোলপাড় করা ঘটনার পর অগাস্ট মাসেই আরেক কাণ্ড! কে ভেবেছিল হেডিংলিতে অমন পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ড ম্যাচ জিতবে? যুগ যুগ ধরে টেস্ট ক্রিকেট যারা দেখেন তারা জানেন শেষ ইনিংসে রান তাড়ার কি চাপ।

৩৫৯ রানের লক্ষ্য দিয়ে নিশ্চিতই থাকার কথা অস্ট্রেলিয়ার। যখন ২৮৬ রানে ৯  উইকেট পড়ে গেছে তখন ফলাফল নিয়ে কোন সংশয় কারোরই থাকার নয়। শেষ উইকেটে জ্যাক লিচকে পাশে বসিয়ে ৬২ বলে ৭৬ রানের জুটি গড়লেন, যাতে লিচের অবদান কেবল ১ রানের। স্টোকসই নিলেন সবটা। তার আগে পঞ্চম উইকেটে জনি বেয়ারস্টোর সঙ্গে ৮৬ রানের জুটিতে এই রোমাঞ্চের ভিত গড়েছিলেন।

প্যাট কামিন্সের বল কাভার দিয়ে সীমানা ছাড়া করে স্টোকসের উল্লাসের ছবি ইংল্যান্ডের ক্রিকেট রোমাঞ্চের প্রতীক হয়ে থাকবে। স্টোকস অপরাজিত ১৩৫ রান। তার সঙ্গে পড়ুন, বল হাতে দ্বিতীয় ইনিংসে ৫৬ রানে ৩ উইকেট, প্রথম ইনিংসে ৪৫ রানে ১ উইকেট। সেসব উইকেটের সবগুলই ভীষণ দরকারি সময়ে। প্রকৃত অলরাউন্ডার আর কাকে বলে?

টি-টোয়েন্টিতে সত্যিই তার দেনা ছিল ইংলিশ ক্রিকেটে। ২০১৬ সালের ইডেন গার্ডেন স্টোকসকে নিয়ে গিয়েছিল গর্তে, স্টোকসকে দেখিয়ে দিয়েছিল নিষ্ঠুরতম দিন। নিশ্চিতভাবে বিশ্বকাপ জিততে থাকা ইংল্যান্ড হাহাকারে যে পুড়েছিল তার কারণেই। শেষ ওভারে দরকার ১৯ রান। ক্রেইগ ব্র্যাথওয়েট ৪ বলে ৪ ছক্কায় চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে দিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।

সেই রাতের পর সময় পেরিয়েছে অনেক। এরমধ্যেই ইংল্যান্ডকে ওয়ানডে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন স্টোকস। যে বিশ্বকাপের মূল্যই আদতে ক্রিকেটে বেশি। কিন্তু খেদ ছিলই, তীব্রই ছিল।

স্টোকসদের মতো বড় খেলোয়াড়ের তেজ পেতে দরকার বড় মঞ্চ। সেই সঙ্গে দরকার কিছু চাপ। বড় মঞ্চ আর চাপ- এই দুটি মিশে গেলে স্টোকস বুঝে নেন তার কি করতে হবে। রোববার মেলবোর্নে সেটাই করলেন ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার।

পাকিস্তানকে ৫ উইকেটে হারিয়ে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় শিরোপা জেতার মঞ্চে ম্যাচ সেরা স্যাম কারান। ১২ রানে ৩ উইকেট নিয়ে তিনিই তো গড়েছেন ভিত। তবে শেষটা তো করতে হতো।

১৩৮ রান তাড়ায় ৩২ রানে ২ উইকেট পড়ার পর নামলেন স্টোকস। বাটলারের কল্যাণে এক পাশে রান আসছিল। দলের ৪৫ রানে বাটলারও ফিরে গেলে শেষ পর্যন্ত হাল ধরতে হতো একজনকে।

Ben Stokes

হ্যারি ব্রুকের সঙ্গে ৩৯ রানের জুটিতে তা করলেন স্টোকস। ব্রুকস ফিরে যাওয়ার পর চাপ আরও বাড়ছিল। মাঝের ওভারে পাকিস্তানি পেসাররা তেতে উঠেছিলেন। স্টোকসেরও বল ঠিকমতো ব্যাটে লাগছিল না। সহজ সমীকরণ কঠিন হতে থাকল।

এক সময় জমে উঠার আভাসও মিলল। স্টোকস সময়ের দাবি মেটালেন তখনই। মঈন আলিকে নিয়ে ৪৮ রানের জুটি। এবারও ম্যাচ জেতানো শটটা স্টোকসের হাত দিয়েই।

৪৯ বলে অপরাজিত ৫২ রান টি-টোয়েন্টি এমন কিছু ইনিংস মনে হবে না। কিন্তু পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট, মঞ্চ বিচার করলে বোঝা যাবে মাহাত্ম্য । মজার কথা হলো আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে এটি স্টোকসের প্রথম ফিফটি! খেয়ালি চরিত্রের মানুষটি যে এখনো মাত্র ৪৩টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। মানসিকভাবে তৈরি না থাকায় খেলেননি গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।

এবার বিশ্বকাপেও আহামরি কিছু করছিলেন না। দুটি ম্যাচে খেলেছেন, তাতে হয়েছেন মূল নায়ক। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাঁচা মরার লড়াইয়ে এমনই চাপের সময়ে ৩৬ বলে ৪২। সেইসঙ্গে বোলিংয়ে ২৪ রানে পেয়েছিলেন ১ উইকেট।

ফাইনালে ৪ ওভারের কোটা পূরণ করে ৩২ রান দিয়ে আউট করেছেন ইফতেখার আহমেদকে। বোলিংয়ে রাখেন কার্যকর ভূমিকা, ফিল্ডিংয়ে সবটা নিংড়ে দেন, ব্যাট হাতে যখন দলের দাবি সবচেয়ে বেশি তখন কাণ্ডারি হিসেবে হাজির হন তিনি।

ট্রফি জেতার পর অধিনায়ক বাটলার জানান তা জানতেন স্টোকসই পারবেন এমন কিছু করতে,   'সে একজন প্রকৃত ম্যাচ উইনার। এরকম পরিস্থিতিতে সে আগেও করে দেখিয়েছে এবং ম্যাচ জিতেছে। সে জানে এসব পরিস্থিতিতে কি করা লাগে। ইনিংসটা খুব সাবলীল ছিল না, টাইমিং করতে পারেনি ঠিকঠাক কিন্তু সে হাল ছাড়েনি। সে লড়াই ছেড়ে যেতে চায় না।'

মেলবোর্নের বীরত্বের পর সময়ের সেরা অলরাউন্ডার তো বটেই, সব সময়ের সেরা অলরাউন্ডারদের তালিকায় স্টোকস নিয়ে আলোচনা জোরদার হয়েছে। বাটলারও মনে করেন এমন আলোচনায় স্টোকস সব সময় থাকবেন, 'সে অবশ্যই এই আলোচনায় (সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার) থাকবে।'

বাবার মৃত্যু, নিজের চোট মিলিয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, ক্রিকেট থেকে দূরেও সরে গিয়েছিলেন। ৩১ বছরেই ছেড়ে দিয়েছেন ওয়ানডে। হয়ত দেখা যাবে অন্য সংস্করণগুলো খুব বেশি দিন খেলছেন না। তার যে চরিত্র তাতে তাতে পরিসংখ্যান ঋদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু লর্ডস, হেডিংলি আর মেলবোর্নের তিন মঞ্চের কৃতিত্ব যার আছে তার অমরত্বের জন্য আর কি চাই?

Comments

The Daily Star  | English

‘No room for politics under AL name, ideology’

Nahid Islam, adviser to the interim government, spoke with The Daily Star on the nation's key challenges and the way forward.

14h ago