সত্তর দশকের চোখে আধুনিক ক্রিকেট

বিশ্বকাপ উপলক্ষে দুই দফা পুনেতে এসে বোর্দের সঙ্গে দেখা না করে গেলে একটা আক্ষেপ থেকে যেত। ভারতের এই অঞ্চল থেকে যেসব ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আলো ছড়িয়েছেন তাদের মধ্যে বোর্দেই সবচেয়ে বড় নাম।

পুনে থেকে

সত্তর দশকের চোখে আধুনিক ক্রিকেট

বিশ্বকাপ উপলক্ষে দুই দফা পুনেতে এসে বোর্দের সঙ্গে দেখা না করে গেলে একটা আক্ষেপ থেকে যেত। ভারতের এই অঞ্চল থেকে যেসব ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আলো ছড়িয়েছেন তাদের মধ্যে বোর্দেই সবচেয়ে বড় নাম।
সত্তর দশকের চোখে আধুনিক ক্রিকেট
ভারতের সাবেক টেস্ট ক্রিকেটার চান্দু বোর্দে। ছবি: একুশ তাপাদার

ফোন করে পরিচয় দিতেই জিজ্ঞেস করলেন কোথায় আছি, অবস্থান জানার পর বললেন, 'আরে আপনি তো আমার বাড়ির কাছেই আছেন, চলে আসুন।' আজকের সময়ে চান্দু বোর্দেকে হয়ত অনেকেরই চেনার কথা না। কিন্তু সত্তরের দশকে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার ছিলেন তিনি। সেই সময় ভারতের হয়ে ৫৫ টেস্ট খেলেছেন। অলরাউন্ড নৈপুণ্যে অবদান রেখেছেন অনেক। ১৯৬১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের প্রথম টেস্ট জয়েও ছিল তার অবদান। প্রথম শ্রেনীতেও বোর্দের রেকর্ড ঋদ্ধ। ৩০ সেঞ্চুরিতে আছে ১২ হাজারের বেশি রান, তিনশোর বেশি উইকেট। 

বিশ্বকাপ উপলক্ষে দুই দফা পুনেতে এসে বোর্দের সঙ্গে দেখা না করে গেলে একটা আক্ষেপ থেকে যেত। ভারতের এই অঞ্চল থেকে যেসব ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আলো ছড়িয়েছেন তাদের মধ্যে বোর্দেই সবচেয়ে বড় নাম। পুনের তুলনামূলক নীরব জনপদে বোর্দের মতন সত্তর দশকের টেস্ট ক্রিকেটারের কাছে আলাপ করে সময়টাকে জানারও একটা ব্যাপার থাকে। স্রেফ গল্প করার ইচ্ছাতেই তার ঠিকানায় হাজির। তিনি গল্পের মোড় নিয়ে গেলেন আধুনিক ক্রিকেটের জয়যাত্রায়।

খেলা ছাড়ার পর ক্রিকেট প্রশাসক হয়েছেন, জাতীয় নির্বাচক, জাতীয় দলের ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করছেন। ৯০ ছুঁইছুঁই বয়সে এখন বাড়িতে বসে খেলা দেখেই কাটে তার অবসর সময়। সেই সঙ্গে চলে স্মৃতিচারণ, নিজেদের সময়ের সঙ্গে আজকের সময়ের ছবির উল্টেপাল্টে দেখা। দুই ভিন্ন সময়ের ছবি মেলাতে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যান বোর্দে। খেলাটা ক্রিকেটই তো? মাঝেমাঝে তার মনে হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই খেলা। 

আগের রাতে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের অবিশ্বাস্য ইনিংস দেখে ঘোর যেন কাটাতেই পারছেন না, আলাপ শুরু হলো সেখান থেকেই,  'অনেক কিছু বদলে গেছে জানেন। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি এসব এসেছেই। বোলিং, ব্যাটিং, ফিল্ডিং সব দিকে বিপুল বদল। স্রেফ চিন্তা করুন যেভাবে এখন পুরো শরীর ঘুরিয়ে পেছনের দিকে মারছে, ভাবাই যায় না। আমাদের সময়ে উপরের দিকে বল তেমন মারা হতো না, বেশিরভাগ শট হতো গ্রাউন্ডে।'

বোর্দে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন ১১ বছর। ক্রিকেট দেখছেন পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে। ম্যাক্সওয়েলের মতন এমন ইনিংস তার চোখে আর কখনই ধরা দেয়নি, 'গতকাল (৭ নভেম্বর) আমি অস্ট্রেলিয়ার খেলা দেখছিলাম। ওদের ব্যাটসম্যান গ্লেন ম্যাক্সওয়েল যেমন খেলল, এমন কাউকে কোনদিন আমি খেলতে দেখিনি। ১০টার মতো ছক্কা মেরেছে, আর কী সব শট। দুইশো করে একা ম্যাচ বের করে নিলো। হাঁটতে পারছিল না, জায়গায় দাঁড়িয়ে খেলল। তার হেড পজিশন, তার ব্যাট স্পিড, কব্জির জোর অসাধারণ, অতুলনীয়। সময়ের সঙ্গে মানুষের ক্ষমতা কতখানি বেড়েছে এই প্রমাণ আমরা পেলাম।'

সব বিভাগে যে বৈপ্লবিক বদল এসেছে তার পেছনে অবকাঠামো, সামগ্রিক সুবিধাও জড়িত। খুব স্বাভাবিকভাবে সময় বদলে দিয়েছে সব কিছু। বোর্দের অবশ্য এই নিয়ে আক্ষেপ নেই, বরং মানুষের এগিয়ে যাওয়াতে আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন তিনি,  'বোলিংয়েও অনেক বদল। অনেক বৈচিত্র্য এসেছে। ফিল্ডিংয়েও অনেক উন্নতি এসেছে। এখন মাঠও খুব চমৎকার। আউটফিল্ড এত সুন্দর থাকে যে ফিল্ডাররা ইচ্ছামত ঝাঁপাতে পারে। আমাদের সময়ে এরকম ছিল না। অনেক এবড়ো-খেবড়ো মাঠে খেলতে হয়েছে।'

'ইকুইপমেন্ট কত আধুনিক হয়েছে। এখন কত সুন্দর সব গেজেট, সুরক্ষা বলয় তো আছেই। এটাকে আমি একদম ভিন্ন ধরণের খেলা বলব। আমাদের সময়ের সঙ্গে কোনভাবেই মেলানো যায় না।'

সেই সময়ে খেলা হতো স্রেফ প্যাশনের জায়গা থেকে। এখন এটা প্যাশনের সঙ্গে পুরোপুরি প্রফেশন। বোর্দের মতে সব কিছু ভিন্ন না হয়ে উপায় কি, 'ক্রিকেটারদের অনেক যত্ন করেও কিন্তু প্রস্তুত করা হচ্ছে। এখন বোলিং কোচ, ব্যাটিং কোচ, ফিল্ডিং কোচ, এনালিস্ট, পারসোনাল মেন্টর কত কিছু আছে। ভুল ত্রুটি ফুটেজ দেখে সংশোধন করছে।'

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন সংস্করণের পাশাপাশি এখন প্রবল দাপট ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের। ভোক্তার কাছে পণ্য ক্রিকেট হাজির হচ্ছে নানান মোড়কে। তবে এসবের ভিড়েও টেস্ট ক্রিকেটকে আলাদা উচ্চতায় রাখলেন তিনি। ওয়ানডে ক্রিকেট কখনো বিলীন হয়ে যেতে পারে, তবে টেস্ট নিয়ে এমন কোন শঙ্কা নেই সাবেক এই টেস্ট ক্রিকেটারের, 'আমি বাড়িতে বসে সবই দেখি, দেখতে ভালো লাগে। তবে যাই বলেন টেস্ট ক্রিকেটের উচ্চতাই আলাদা। হয়ত পছন্দ, অভ্যস্ততার কারণও বলতে পারেন।  সঙ্গীতের মতন আরকি। যারা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শুনে অভ্যস্ত তাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতই সব সময় বেশি ভালো লাগবে। মানুষেরও টেস্ট ভালো লাগবে আরও অনেকদিন। কারণ ওখানে গ্রেটনেস প্রমাণের সুযোগ অনেক বেশি। দারুণ স্পেল, স্ট্রোক মেকিং তো আছেই, পুরো খেলাটার মধ্যেও অন্য ধরণের লাবণ্য আছে যা অন্য কোথাও পাবেন না। আমি নিশ্চিত ওয়ানডে হারিয়ে গেলেও টেস্ট চলতে থাকবে।'

১৯৬১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ইডেন গার্ডেন্সে প্রথমবার টেস্ট জিতেছিল ভারত। সেই টেস্ট দুই ইনিংসে ৬৮ ও ৬১ করার পর লেগ স্পিনে চার উইকেট নিয়েছিলেন বোর্দে। মনে করিয়ে দিতে বললেন,  'হ্যাঁ, ওই টেস্টে নারি কন্ট্রাক্টর আমাদের অধিনায়ক ছিলেন। আমি আর সেলিম দুরানি ছিলাম স্পিন আক্রমণে। আমাদের ডাকা হতো স্পিন টুইনস বলে। আমরা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ওই সময়ে সিরিজ জিতেছিলাম।'

পরে বললেন ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার আরেক সাফল্যের কথা,  '২০০৭ সালে রাহুল দ্রাবিড় যখন অধিনায়ক, আমি ম্যানেজার হিসেবে গিয়েছিলাম ইংল্যান্ডে। আমরা কিন্তু ৩০ বছর পর সেবার ইংল্যান্ডে টেস্ট সিরিজ জিতেছিলাম। সবাই মনে রাখে ওই বছর ভারত টি-টোয়েন্টি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। কিন্তু ইংল্যান্ডে ৩০ বছর পর আমরা জিতেছিলাম। ওটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলো কিন্তু।'

মহারাষ্ট্রে রাজ্যে তিনটি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। প্রভাবশালী মুম্বাই আর বিদর্ভ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন থেকে কিছুটা পিছিয়ে মহারাষ্ট্র ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন। বোর্দে জানালেন, অবকাঠামোগতভাবে তাও এখানেও ঘাটতি কিছু নেই, 'পুনের ক্রিকেট খুব ভালো চলছে। পুরো ভারতের মতই এখানে ক্রিকেট নিয়ে ক্রেজ প্রবল। এবং সেই ক্রেজটা কাজেও লাগানো হচ্ছে। পুনে কিন্তু খুব ভালো আবহাওয়া ক্রিকেটের জন্য। খুব গরম না, খুব ঠান্ডাও না। এখন তো নতুন স্টেডিয়ামে খেলা হয়। অসংখ্য একাডেমি হয়েছে, আমি সংখ্যাটা বলতে পারব না, তবে অনেক। অন্তত ১০-১২টা মাঠ আছে যেখানে ছেলে-মেয়েরা খেলছে।'

আলাপ শেষ হলো বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে খুব একটা জানা না থাকলেও দুই সংস্করণে বাংলাদেশের দুটো ম্যাচ মাঠে বসেই দেখার সুযোগ হয়েছে তার, 'আমি ২০১৯ সালে কলকাতায় গোলাপি বলের টেস্ট দেখতে গিয়েছিলাম। দারুণ আয়োজন করা হয়েছিলো। বাংলাদেশের খেলা দেখেছি, কিন্তু তারা ভালো করতে পারেনি। আমার মনে হয় টেস্ট ক্রিকেটে ভালো করা এত সহজ না, তাদের অনেক বেশি কাজ করতে হবে। নিশ্চয়ই তারা সেটা করবে। এবার বিশ্বকাপে এখানে যেটা হলো ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ। ওটাও মাঠে গিয়ে দেখেছি। বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে আমার গভীর ধারণা নেই। তবে বাংলাদেশের মানুষ চমৎকার, খেলাটাকে ভালোবাসে। এইটুকু জানি। বাঙালিরাই খেলাটার প্রতি বেশি অনুরক্ত, বেশি বোধহয় ফুটবল ভালোবাসে। ইডেনে খেলায় অনেক বাঙালিদের সঙ্গেই আমার আলাপ আছে। '

Comments

The Daily Star  | English

Bangladeshi students terrified over attack on foreigners in Kyrgyzstan

Mobs attacked medical students, including Bangladeshis and Indians, in Kyrgyzstani capital Bishkek on Friday and now they are staying indoors fearing further attacks

1h ago