সাকিবের ঝলকে হোয়াইটওয়াশ এড়ালো বাংলাদেশ
শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে দলকে টানলেন মুশফিকুর রহিম আর নাজমুল হোসেন শান্ত। এই দুজনের ফিফটির পর আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে আসল কাজ করলেন সাকিব আল হাসান। খেললেন ৭৫ রানের ইনিংস। মন্থর ও নিচু বাউন্সের উইকেটে পরে বল হাতেও জ্বলে উঠলেন দলের সেরা তারকা। ৩০০ উইকেটের মাইলফলকের দিনে তুললেন ৪ উইকেট। সাকিবের অলরাউন্ড নৈপুণ্যে হোয়াইটওয়াশ এড়াতে পারল বাংলাদেশ।
সোমবার চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে তৃতীয় ওয়ানডে বাংলাদেশ জিতে নিয়েছে ৫০ রানে। আগে ব্যাট করে তিন ফিফটিতে ২৪৬ রানের পুঁজি পেয়েছিল স্বাগতিকরা। ওই রান তাড়ায় ভালো শুরু পেয়েও সাকিবের ছোবলে পথ হারিয়ে ১৯৬ রানে আটকে যায় ইংল্যান্ড। ব্যাট হাতে ৭১ বলে ৭৫ ও বল হাতে ৩৫ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হয়েছেন সাকিব।
মিরপুরে প্রথম দুই ওয়ানডে হেরে সিরিজ আগেই খুইয়ে বসেছিল তামিম ইকবালের দল। চট্টগ্রামে শেষটায় অন্তত সমর্থকদের স্বস্তি দিয়েছেন তারা। ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে এটি বাংলাদেশের পঞ্চম জয়।
দুই ইংলিশ ওপেনারের ব্যাটে শুরুতে বাংলাদেশের অস্বস্তি
২৪৭ রানের লক্ষ্য বিবেচনায় দারুণ শুরু আনেন ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার। ওভারপ্রতি ৬ রান করে আনতে থাকেন তারা। শুরুতে বল করতে আসা মোস্তাফিজুর রহমান আর তাইজুল ইসলামও ছিলেন মলিন। বেশ কিছু আলগা বাউন্ডারি বেরিয়ে যায়।
বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুতে ইনিংসে যতটা আড়ষ্টতা দেখা যাচ্ছিল, ইংল্যান্ডের ইনিংসের শুরুতে তা দেখা যায়নি। অনেকটা সাবলীল গতিতেও আসছিল রান। মাঝারি লক্ষ্যে সফরকারীদের ভালো শুরুটা চিন্তার কারণ হয়ে যায় বাংলাদেশের।
সাকিব-ইবাদতের ঝলকে ফিরে আসা
নবম ওভারে আক্রমণে এসেই উইকেট এনে দেন সাকিব। তার বলে মিড অফে মাহমুদউল্লাহর হাতে সহজ ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান ফিল সল্ট। এরপর প্রথম দুই ম্যাচের দুই সেঞ্চুরিয়ানকে পর পর তুলে নেয় বাংলাদেশ। সিরিজে প্রথমবার নামা ইবাদত হোসেন ছাঁটেন ডাভিড মালানকে। সাকিব তার পরের ওভারে দারুণ আর্ম বলে স্টাম্প ভেঙে ফেলেন জেসন রয়ের। এক রানের মধ্যে তিন উইকেট তুলে ম্যাচে ফেরে বাংলাদেশ।
ভিন্স-কারানের প্রতিরোধ
প্রথম দুই ম্যাচে রান পাননি জেমস ভিন্স। তৃতীয় ম্যাচে এসে দলের প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে যেতে হয় তাকে। দ্রুত তিন উইকেট পড়ায় স্যাম কারানকে পাঁচে পাঠিয়ে দেয় ইংল্যান্ড। চতুর্থ উইকেট জুটিতে দুজনে যোগ করেন ৪৯ রান। তবে এই রান তুলতে তাদের লেগে যায় ৮১ বল। আগ্রাসী ব্যাটার হিসেবে পরিচিত কারানই ছিলেন খোলসবন্দি। মেহেদী হাসান মিরাজের বলে লং অফে সহজ ক্যাচ উঠিয়ে ফেরার আগে ২৩ রান করেন ৪৯ বল খেলে।
সাকিব-ইবাদতের জোড়া আঘাত
থিতু হওয়া ভিন্স বিপদ বাড়াচ্ছিলেন। নিজের ৮ম ওভারে দারুণ এক ডেলিভারিতে তাকে কাবু করেন সাকিব। ৪৪ বলে ৩৮ করা ভিন্স সাকিবের হালকা টার্নে বেরিয়ে যাওয়া বলে ব্যাট লাগিয়ে ক্যাচ দেন কিপার মুশফিকের হাতে। পরের ওভারেই মঈন আলিকে বোল্ড করেন ইবাদত। তার ফুল লেন্থের বল মঈনের পায়ে লেগে ঢুকে যায় স্টাম্পে। ১৩০ রানে ৬ উইকেট খুইয়ে প্রবল চাপে পড়ে যায় ইংলিশরা।
তাইজুলের 'গোল্ডেন উইকেট'
গোটা ম্যাচে খুব একটা ভালো বল করছিলেন না তাইজুল। বেশ খরুচে ছিলেন, তার বল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল মূল্যবান রান। তবে মহাগুরুত্বপূর্ণ সময়ে উইকেট পেয়ে যান তিনি। বাংলাদেশের জেতার মাঝে বাধা ছিলেন জস বাটলার। ইংল্যান্ড অধিনায়ক থিতুও হয়ে গিয়েছিলেন।
সপ্তম উইকেটে ক্রিস ওকসের সঙ্গে জুটিও বাড়ছিল। বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দিতে এই জুটিই হতে পারত টার্নিং পয়েন্ট। তা হতে দেননি তাইজুল। এই বাঁহাতি স্পিনারের সোজা বল রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে ব্যাটে নিতে পারেননি বাটলার। এলবিডব্লিউয়ের আবেদনে সাড়া দিতে কোনো দ্বিধা করেননি আম্পায়ার। ২৪ বলে ২৬ করে বাটলার ফিরে যাওয়ায় ভাঙে ৩৮ বলে ২৮ রানের জুটি। ম্যাচ তখন অনেকটাই হেলে যায় বাংলাদেশের দিকে। তাইজুল তার নিজের স্পেলের শেষ ওভারে বোল্ড করে দেন আদিল রশিদকেও। এই অবস্থা থেকে ম্যাচ জিততে রোমাঞ্চকর গল্প লিখতে হতো ইংল্যান্ডকে।
সাকিবের ৩০০
৩০০ উইকেট স্পর্শ করতে এই ম্যাচের আগে ৪ উইকেটের অপেক্ষা ছিল সাকিবের। সিরিজের প্রথম দুই ম্যাচে বিবর্ণ সাকিব এবার জ্বলে ওঠেন। নবম ওভারে বল হাতে নিয়ে প্রথম ব্রেক থ্রুটা তারই আনা। পরে একে একে নিলেন তিন উইকেট। অভিষেক ওয়ানডেতে নামা রেহান আহমেদকে আউট করে শেষ স্পেলে স্পর্শ করেন মাইলফলক। বাংলাদেশের জেতার কাজটাও তখন অনেকটা নিশ্চিত করে দেন তিনি। ওয়ানডেতে এই নিয়ে দশমবারের মতো চার উইকেটের দেখা পান সাকিব।
শেষটা টানলেন মোস্তাফিজ
পুরো সিরিজে গড়পড়তা বল করা বাঁহাতি পেসার মোস্তাফিজুর রহমান একদম শেষটায় গিয়ে পান উইকেটের দেখা। ক্রিস ওকসকে নিজের বলে দুইবারের চেষ্টায় ফিরতি ক্যাচ বানিয়ে ম্যাচ শেষ করে দেন তিনি।
ব্যাটিংয়েও নায়ক সাকিব
টস জিতে ব্যাট করতে নেমে দুই ওপেনারকে শুরুতেই হারায় বাংলাদেশ। পুরো সিরিজে ব্যর্থতার ধারাবাহিকতা দেখান লিটন দাস। টানা দ্বিতীয় ম্যাচে ফেরেন শূন্য রানে। অধিনায়ক তামিম আগের দিন খেলেছিলেন মন্থর ইনিংস। এদিন থিতুই হতে পারেননি।
১৭ রানে ২ উইকেট হারানোর পরিস্থিতি থেকে প্রতিরোধ গড়েন শান্ত-মুশফিক। দুজনেই শুরুতে নেন বাড়তি সময়। থিতু হয়ে অবশ্য পোষাতে শুরু করেছিলেন। তৃতীয় উইকেটে জমে ওঠে জুটি। প্রথম ম্যাচে ফিফটি পাওয়া শান্ত এবারও পান পঞ্চাশের দেখা। ৬০ বলে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফিফটি পাওয়া শান্তকে বেশ সাবলীল মনে হচ্ছিল। তবে মুশফিকের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউটে অসময়ে বিদায় নিতে হয় তাকে। ৭১ বলে ৫ চারে ৫৩ রানে থামেন তিনি। ভেঙে যায় দুজনের ৯৮ রানের জুটি।
মুশফিক সাত ইনিংস পর ফিফটি পেয়ে ছুটছিলেন আরও বড় কিছুর দিকে। ইনিংস গড়ে নেওয়া, দলের রান বাড়িয়ে নেওয়ার আদর্শ পরিস্থিতিতে তার সামনে সেই সময় ও সুযোগ ছিল বিস্তর। কিন্তু আদিল রশিদের গুগলি পড়তে না পেরে বোল্ড হয়ে যান তিনি। ৯৩ বলে তার ব্যাট থেকে আসে ৭০ রান।
ছয়ে নামা মাহমুদউল্লাহ এদিনও ব্যর্থ। আগের ম্যাচে পরিস্থিতির বিপরীতে খেলেছিলেন বিস্ময়কর মন্থর ইনিংস। এবার থিতু হওয়ার আগেই বিদায়। ৯ বলে ৮ রান করে রশিদের বলে বোল্ড তিনিও।
তবে এই বিপদে কুঁকড়ে না থেকে পাল্টা আক্রমণ চালান সাকিব। ৬ষ্ঠ উইকেট জুটিতে আফিফ হোসেনকে নিয়ে ৪৯ রান যোগ করেন। ৫৪ বলের জুটিতে ৩২ রানই আনেন সাকিব। ধুঁকতে থাকা আফিফ ২৪ বল খুইয়ে করতে পারেন স্রেফ ১৫ রান। ক্রিস ওকসের স্লোয়ার উঠিয়ে মারতে গিয়ে মঈনের দারুণ ক্যাচে পরিণত হয়ে বিদায় নেন তিনি।
খানিক পর লেগ স্পিনার রেহানকে তার স্পেলের শেষ বলে প্রথম উইকেট উপহার দিয়ে যান মেহেদী হাসান মিরাজ। তাইজুল ইসলামও সাকিবকে সঙ্গে দিতে পারেননি। শেষ দিকে ইবাদত হোসেনকে এক পাশে রেখে রান বাড়াতে থাকেন তিনি। ওই জুটিতে ১৩ বলে আসে ১৯ রান। ৪৯তম ওভারে জোফ্রা আর্চারের বলে ক্যাচ উঠিয়ে ফেরার আগে বাংলাদেশকে লড়াইয়ের জায়গায় নিয়ে যান সাকিব।
চট্টগ্রামের বাইশ গজের আচরণ এদিন ছিল স্পিনারদের পক্ষে। বল থেমে আসছিল, টার্ন মিলছিল। বল নিচু হচ্ছিল অনেক। সহায়ক কন্ডিশনে মাঝারি পুঁজি নিয়ে জেতার বাকি কাজ সারতেও মূল ভরসা হন সাকিবই।
Comments