বদলি নেমে নায়ক লাউতারো, কোপার শিরোপা আর্জেন্টিনারই
নির্ধারিত ৯০ মিনিটের খেলা শেষে ম্যাচ গড়াল অতিরিক্ত সময়ে। কোনো দলই জালের খোঁজ না পাওয়ায় লড়াই যাচ্ছিল টাইব্রেকারের দিকে। তখনই ব্যবধান গড়ে দিলেন বদলি নামা লাউতারো মার্তিনেজ। আরেক বদলি খেলোয়াড় জিওভান্নি লো সেলসোর পাস পেয়ে নিখুঁত ফিনিশিংয়ে লক্ষ্যভেদ করলেন তিনি। তার কল্যাণে কোপা আমেরিকার শিরোপা নিজেদের ঘরেই রাখল আর্জেন্টিনা।
সোমবার মায়ামির হার্ডরক স্টেডিয়ামে এবারের আসরের স্নায়ুক্ষয়ী ফাইনালে ১-০ গোলে কলম্বিয়াকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লিওনেল স্কালোনির শিষ্যরা। ম্যাচের ১১২তম মিনিটে জয়সূচক গোলটি আসে লাউতারোর পা থেকে।
দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ ফুটবল আসরে আর্জেন্টিনার এটি টানা দ্বিতীয় ও রেকর্ড ১৬তম শিরোপা। ১৫ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়া উরুগুয়েকে টপকে তারা উঠে গেল এককভাবে শীর্ষে। স্পেনের পর দ্বিতীয় এবং প্রথম লাতিন দল হিসেবে টানা তিনটি মেজর টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলো আলবিসেলেস্তেরা। ২০২২ সালে বিশ্বকাপ উঁচিয়ে ধরার আগের বছর কোপা জিতেছিল দলটি।
আর্জেন্টাইন অধিনায়ক লিওনেল মেসি এদিন পুরোটা সময় থাকতে পারেননি মাঠে। পায়ের চোট নিয়ে দুর্ভাগ্যজনকভাবে দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি সময় মাঠ ছেড়ে যেতে হয় তাকে। তার অনুপস্থিতিতেও ঘাবড়ে যাননি সতীর্থরা। তাই আর্জেন্টিনার জার্সিতে শেষ ম্যাচ খেলতে নামা আনহেল দি মারিয়ার বিদায়টা হয়ে থাকল স্মরণীয়। ১১৭তম মিনিটে বদলি হওয়ার আগে দারুণ উজ্জ্বল ছিলেন তিনি।
এই হার দিয়ে থামল নিজেদের ইতিহাসে কলম্বিয়ার টানা ২৮ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড। মজার ব্যাপার হলো, ২০২২ সালে তাদের সবশেষ হারটিও ছিল আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। তবে নেস্তর লরেঞ্জোর শিষ্যদের আক্ষেপ হতে পারে সীমাহীন। কারণ, নির্ধারিত সময়ে তারা সুযোগ তৈরিতে এগিয়ে থাকলেও কাঙ্ক্ষিত গোল আদায় করতে পারেনি।
প্রথমার্ধে কলম্বিয়াই বেশি ভীতি ছড়ায় আর্জেন্টিনার রক্ষণে। তারা গোলমুখে আটটি শট নেয়। এর মধ্যে লক্ষ্যে ছিল চারটি। অন্যদিকে, আর্জেন্টিনার তিনটি শটের কেবল একটি থাকে লক্ষ্যে।
ম্যাচের প্রথম মিনিটেই আক্রমণে ওঠে আর্জেন্টিনা। ডানপ্রান্ত থেকে গঞ্জালো মন্তিয়েল ক্রস করেন ডি-বক্সে। তবে বলে-পায়ে কাঙ্ক্ষিত সংযোগ ঘটাতে পারেননি হুলিয়ান আলভারেজ। তার শট হয় লক্ষ্যভ্রষ্ট।
আর্জেন্টিনার উজ্জ্বল শুরু মিলিয়ে যেতে সময় লাগেনি। কলম্বিয়া দ্রুতই নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে একের পর আক্রমণ শানিয়ে সুযোগ তৈরি করতে থাকে। পঞ্চম মিনিটে প্রথমবারের মতো কোনো শট থাকে লক্ষ্যে। তবে ডি-বক্সের বাইরে থেকে লুইস দিয়াজের দুর্বল শট সহজেই লুফে নেন আর্জেন্টাইন গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ।
দুই মিনিট পর ভাগ্যের ফেরে গোল পায়নি কলম্বিয়ানরা। সান্তিয়াগো আরিয়াসের পাসে ডি-বক্সের ভেতর থেকে জন কর্দোবার শট জালে প্রায় ঢুকেই যাচ্ছিল। কিন্তু পোস্টে লেগে বল বাইরে চলে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে আর্জেন্টিনা।
১৩তম মিনিটে ফের এমিলিয়ানোকে পরীক্ষা দিতে হয়। হামেস রদ্রিগেজের কর্নারে শুরুতে হেড করেন জেফারসন লার্মা। সেখান থেকে বল পেয়ে আরেকটি হেড করলেও জালে পাঠাতে ব্যর্থ হন কার্লোস কুয়েস্তা।
সাত মিনিট পর সুযোগ আসে মেসির সামনে। আনহেল দি মারিয়ার ক্রসে বাঁ পায়ে শট নেন তিনি। কিন্তু বল আলভারেজের গায়ে লেগে পৌঁছে যায় গোলরক্ষক কামিলো ভারগাসের গ্লাভসে।
বিরতির আগে বাকি সময়েও আর্জেন্টিনার ধীরগতির ফুটবলের বিপরীতে কলম্বিয়া দেখায় দাপট। ৩৩তম প্রায় ৩৫ গজ দূর থেকে নেওয়া লার্মার শট ঝাঁপিয়ে রক্ষা করেন এমিলিয়ানো। সাত মিনিট পর জন আরিয়াসের হেড লক্ষ্যে থাকেনি। পরের মিনিটে রিচার্ড রিওসের শটও বিপদের কারণ হতে পারেনি।
প্রথমার্ধ শেষ হওয়ার ঠিক আগে একবার কলম্বিয়ার রক্ষণে হানা দেয় আর্জেন্টাইনরা। ৪৪তম মিনিটে মেসির ফ্রি-কিক হেড করেন নিকোলাস তাগলিয়াফিকো। বল চলে যায় ক্রসবারের অনেক ওপর দিয়ে।
পরের অর্ধেও কলম্বিয়া প্রাধান্য দেখায় আক্রমণে। তবে নির্ধারিত ৯০ মিনিট শেষ হওয়ার আগে তারা গোলমুখে আরও ছয়টি শট নিলেও বল রাখতে পারেনি লক্ষ্যে। বিপরীতে, আর্জেন্টিনার নেওয়া চারটি শটের দুটি ছিল লক্ষ্য।
দ্বিতীয়ার্ধের তৃতীয় মিনিটেই দারুণ একটি সুযোগ তৈরি করে কলম্বিয়া। ডি-বক্সের ডানদিকে ফাঁকায় বল পেয়ে যান সান্তিয়াগো। তবে দূরের পোস্টে তার মারা শট ম্যাচের স্কোরলাইনে বদল ঘটাতে পারেনি।
পরের মিনিটে দি মারিয়ার প্রচেষ্টা বিফল হয় ভারগাসের নৈপুণ্যে। ৫৭তম মিনিটে তার পাসে অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্তারের হেড ব্লকড হয়। পরের মিনিটে ফের হতাশায় পুড়তে হয় দি মারিয়াকে। ডি-বক্সের বামদিক থেকে তার বাঁ পায়ের নিচু কোণাকুণি শট রুখে দেন কলম্বিয়ান গোলরক্ষক।
৬৪তম মিনিটে বড় ধাক্কা খায় আর্জেন্টিনা। দৌড়ানোর সময় পিছলে পড়ে যান মেসি। ব্যথা পান ডান পায়ের ঊরুতে। কোপার শুরুর দিকেও চিলির বিপক্ষে একই জায়গায় চোট পেয়েছিলেন তিনি।
তীব্র ব্যথায় কাতর মেসির পক্ষে আর খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে বদলি হিসেবে মাঠ ছাড়ার পর আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি তিনি। অঝোর ধারার কাঁদতে থাকেন বেঞ্চে বসে। তার জায়গায় নামেন নিকোলাস গঞ্জালেজ।
৭৯তম মিনিটে কুয়েস্তার হেড লক্ষ্য খুঁজে পায়নি। এর কিছুক্ষণ আগে নিকোলাস জাল খুঁজে নিলে উল্লাসে মাতে আর্জেন্টিনা। কিন্তু তাদের উল্লাস স্থায়ী হয়নি একটুও। সহকারী রেফারি উঁচিয়ে ধরেন অফসাইডের পতাকা। যোগ করা সময়ের তৃতীয় মিনিটে নিকোলাসে শট চলে যায় ক্রসবারের ওপর দিয়ে।
অতিরিক্ত সময়ে জমাট রক্ষণে কলম্বিয়ার আক্রমণ রুখে আর্জেন্টিনাই বারবার হানা দিতে থাকে। অপেক্ষার পালা ঘুচিয়ে কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত আসে মাত্র আট মিনিট বাকি থাকতে। এবারের কোপার সর্বোচ্চ গোলদাতা লাউতারো করেন নিজের পঞ্চম গোল। প্রবল আনন্দের জোয়ারে ভেসে যায় স্টেডিয়ামে উপস্থিত সব আর্জেন্টাইন খেলোয়াড় থেকে ভক্ত। শেষ বাঁশির বাজার পর সেই উল্লাস হলো আরও জোরালো।
Comments