কম্পমান পায়ে বিপিএলের অনিশ্চিত আগামী

২০১২ সালে বিপিএলের প্রথম আসর যখন মাঠে গড়ায় তখন পিএসএলের ভাবনাই মাথায় ছিল না পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের, নানা কারণে তাদের সেই বাস্তবতাও ছিল না। বিপিএলের চার বছর পর জন্ম নিয়ে পিএসএলের টিভি সত্ত্ব পাঁচ বছরের জন্য বিক্রি হয়েছে ২ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলারে। একসঙ্গে বিপিএলের টিভি স্বত্বর মূল্য তুলনা করতে গেলে বিব্রত হতে হবে। পিএসএল যেখানে জোর কদমে ছুটছে, বিপিএল পিছু হটতে হটতে খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে কম্পমান পায়ে দেখছে অনিশ্চিত আগামী।

অথচ এক সময় আইপিএলের পরই আসত বিপিএলের নাম।  বিপিএলের যাত্রা যখন শুরু হয় তখন আইপিএলের বাইরে চালু ছিল আর কেবল বিগ ব্যাশ। সেই আসর গুণেমানে ভালো হলেও অস্ট্রেলিয়ার বাইরের আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়দের পাদচারণায় ততটা মুখর ছিল না। বিপিএলের সম্ভাবনা ছিল তাই দুইয়ে জায়গা করে নেওয়ার। সেটা তো হয়নি, চলেছে উল্টো স্রোতের তোড়।

অনেক আগেই আইপিএল সবাইকে ছাড়িয়ে বিপুল উচ্চতায়। পাঁচ বছরের জন্য তারা সত্ত্ব বিক্রি করেছে ৪৮ হাজার ৩৯০ কোটি ৫০ লাখ রুপিতে। অবিশ্বাস্য সেই অঙ্কের কথা বাকিদের কল্পনারও বাইরে। তাদের জায়গা শীর্ষেই থাকবে। এরপরে পিএসএল তো বটেই, বিপিএলকে ছাপিয়ে গেছে সিপিএল, টি২০ ব্লাস্ট। নতুন চালু হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার এসএ টি২০, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আইএলটি২০ কেড়ে নিয়েছে আলো। বিপিএল এখনো অন্ধকারে হালকা ঝিলিকের মাঝে খুঁজে বেড়াচ্ছে সান্ত্বনা।

নবম আসরে এসেও ফ্যান বেইজ তৈরি করতে না পারা, ফাঁকা উইন্ডো হারিয়ে ফেলা,  গুছানো আদল দিতে না পারা, হোম এন্ড অ্যাওয়ে ভেন্যুতে খেলা দিতে না পারা, সম্প্রচারের মানে উন্নতি আনতে না পারার মতো ঘাটতি প্রকট।

এমনিতেই  নানান বিতর্ক চলতে থাকায় বরাবরই বিপিএলের ভিত্তি ছিল নড়বড়ে।  কোন একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা স্বপ্নের জায়গা তৈরি করা হয়নি কখনই। টুর্নামেন্টটি  বড় করার দিকে উদ্যোগের থেকে আয়োজকদের অজুহাত দিতে দেখা গেছে বেশি। ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত রাজশাহী কিংস ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রধান নির্বাহীর দায়িত্বে থাকা তাহমিদ হক বলছিলেন, 'আমি জানি না (কেন বড় করা হয় না), মাঝে মাঝে মনে হয় কীভাবে এটা বড় করতে হয় তারা হয়ত নিজেরাও জানেন না। আবার কিছুটা নিরাপত্তাহীনতার বোধ হয়ত তাদের ভেতর আছে। যে, "আমরা করছি, বড় করলে সেটা অন্যদের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে" । সবাইকে দিয়ে বড় হওয়ার মানসিকতা মনে হয় নাই।'

আইপিএলে যেমন কেকেআর বা সিএসকে বলতে কোন দলগুলোকে বোঝায় ক্রিকেট অনুসারী প্রত্যেকেই জানেন। সেসব দলের সমর্থকদের ভিত্তিও পোক্ত। বিপিএলে সেটা হবে কি করে?  এখন পর্যন্ত হওয়া নয় আসরে আটটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানায় ছিল ২৬টি আলাদা প্রতিষ্ঠান। ৮ আসরে অংশ নিয়ে ছয়বার মালিকানা বদল হয়েছে কেবল সিলেটের ফ্র্যাঞ্চাইজির। মালিকানা বদলের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে বদলে যায় দলের নামও। ঢাকার দলও যেমন খেলেছে চারটি ভিন্ন নামে। কুমিল্লা, রংপুর, বরিশাল সবার বেলাতেই মালিকানা বদলের ঘটনা একাধিক।

কখন কোন নামে এসব দল খেলছে অনেক সময় গণমাধ্যম কর্মীদের মনে রাখা হয়ে পড়ে দুষ্কর। দর্শকরা এত কিছু মাথায় নিয়ে সমর্থনের ঝাণ্ডা উড়াবেন তা ভাবা বাড়াবাড়ি বটে।

তুমুল হাইপ এখন ম্রিয়মাণ

চলমান বিপিএলের সময় প্রথম আসরের একটি ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। শুরুর আসরগুলোতে খেলা দেখাত স্টার স্পোর্টস। ব্রডকাস্টের মান ছিল খুব ভালো। দর্শকদের বিপুল উন্মাদনা নিয়ে মাঠে প্রবেশের একটি দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো। অর্থাৎ বাজার পরিস্থিতি ছিল অনুকূলে। কিন্তু সাংগঠনিক দুর্বলতায় পাতে বেড়ে দেওয়া খাবার মুখে তুলতে পারেনি বিপিএল।

একদম প্রথম আসরের অগোছালো পরিস্থিতিতে মানুষের আস্থা হারাতে থাকে আসরটি। সেবার বরিশাল বার্নাস না চিটাগাং কিংস কারা সেমিফাইনালে খেলবে তা নিয়ে তৈরি হয় তুমুল নাটকীয়তা। বরিশালের অধিনায়ক ব্র্যড হজ বিদায় নিশ্চিত জেনে দেশে ফিরে যাচ্ছিলেন, আচমকা বদলে যায় সিদ্ধান্ত। বিমানবন্দর থেকে তাকে ফিরিয়ে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়। এসব সিদ্ধান্ত হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে, দেখিয়েছে বোর্ড কর্তাদের দুর্বলতা।

খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক ইস্যু

শুরুতে সাড়া জাগানো নিলামে দেখা গিয়েছিল অর্থের ঝনঝনানি। কিন্তু টুর্নামেন্ট শেষেও প্রতিশ্রুত টাকা পাচ্ছিলেন না খেলোয়াড়রা। বিশেষ করে বিদেশী খেলোয়াড়রা পারিশ্রমিক বুঝে না পাওয়ায় দেশের বিজ্ঞাপন হয় নেতিবাচক। বিপিএলের প্রতি বিদেশিদের অবিশ্বাস জন্মাতে থাকে তখনই।

পরের আসরেই বিপিএলে হানা দেয় ফিক্সিংয়ের ভয়াল থাবা। ঢাকা গ্লাডিয়েটর্সের মালিকপক্ষ জড়িয়ে যায় তাতে। ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে নিষিদ্ধ হন মোহাম্মদ আশরাফুল, নিষিদ্ধ হয় গ্লাডিয়েটর্সও। ২০১৪ সালে তাই আর টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারেনি বিসিবি। এই ধাক্কা সামলে নিতে লাগে সময়। রংপুর রাইডার্স ছাড়া বাকি সবগুলো ফ্র্যাঞ্চাইজির বদল হয়ে নতুন করে ২০১৫ সালে আবার টুর্নামেন্ট গড়ায় মাঠে।

২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের চার আসরকে তুলনামূলক বিচারে গুছানো বলা যেতে পারে। খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক প্রদানে নিশ্চয়তার ভার নেয় বিসিবি। পারিশ্রমিক নিয়ে আর সমস্যা তৈরি হচ্ছিল না। কিন্তু টুর্নামেন্টের মাঝে বাইলজ বদলে ফেলা, মানহীন উইকেটে খেলা চালানোর বিষয় কেড়ে নেয় আলো।

ফের ছন্দপতন

২০১৯ সালে এসে আবার উল্টোরথ। আসরের আদল বদলে দল পরিচালনার ভার নিজেদের কাছে নিয়ে আসে বিসিবি। ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সঙ্গে বিসিবির সমঝোতায় না পৌঁছানোর খবর বের হয়। আগের কোন ফ্র্যাঞ্চাইজিই তাতে অংশ নেয়নি কিংবা তাদের রাখা হয়নি। টুর্নামেন্ট হারায় জৌলুস।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিএলের একটি দলের পরিচালক জানান, 'সমস্যাটা তৈরি হয় মূলত ঢাকা ডায়নামাইটস থেকে সাকিব আল হাসানের রংপুর রাইডার্সের যোগ দেওয়ার ঘটনায়। সেবার বেশ ঘটা করেই রংপুরের দলে যোগ দেন বাংলাদেশের সেরা তারকা। ঢাকা ডায়নামাইটস ছিল বেক্সিমকোর মালিকানাধীন দল।  বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান, বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক সহ প্রভাবশালী পরিচালকরা বেক্সিমকোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সাকিবের দলবদল তারা মানতে পারেননি। ফলে ওই আসরের ফরম্যাটটাই বদলে ফেলা হয়।'

বিসিবির পক্ষ থেকে যদিও বলা হচ্ছিল ব্যাংক গ্যারান্টি ও অংশগ্রহণ ফি নিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায়তেই তাদের ভিন্ন পথে হাঁটতে হয়েছে।

বিপিএল থেকে সেবার সরে যাওয়ার পর আর ফেরেনি ঢাকা ডায়নামাইটস। ফেরেনি জেমকন গ্রুপের খুলনা টাইটান্স। রংপুর রাইডার্স দুই আসর বিরতি দিয়ে এবার ফিরলেও রাজশাহী কিংসও আর আগ্রহ দেখায়নি। কিংসের তাহমিদের মতে, আয়ের কোন বিজনেস মডেল না থাকায় স্রেফ চ্যারিটি করতে আসার বাস্তবতা অবস্থা আর থাকছে না।

তবে ঢাকা ডায়নামাইটস তথা বেক্সিমকো গ্রুপের অনাগ্রহের ভিন্ন করণ জানিয়েছেন দলটি প্রধান নির্বাহী ও বিসিবি পরিচালক ওবেদ নিজাম, 'আমরা বিপিএলে নেই কারণ আমাদের অন্য পরিকল্পনা আছে বড় আকারে। আমরা আসলে একটা ক্রিকেট একাডেমি করার দিকে এগুচ্ছি। আমাদের ভূমি নেওয়া হয়ে গেছে। আমরা তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য একটা একাডেমি করব। এটাই একমাত্র কারণ। এছাড়া তো অন্য কোন কারণ নেই।'

তিনি বলেন, 'রংপুর তো ফিরে এসেছে, কুমিল্লা আছে। তারা নিশ্চয়ই কোন একটা লাভ দেখছে বলেই আছে।'

৩ বছরের চুক্তি অন্তত আশার আলো?

এবার থেকে অংশ নেওয়া দলগুলোর সঙ্গে তিন বছরের চুক্তি করেছে বিসিবি। অন্তত তিন বছর নির্দিষ্ট একটা ফ্র্যাঞ্চাইজি টানা কোন দলের ভার নিলে ফ্যান বেইজও তৈরি হতে পারে। তবে প্রতিবছর ক্ষতি পরিমাণ বাড়লে এবং  নিশ্চিত আগামী না দেখলে তীব্র আগ্রহ ক্রমেই চুপসে যাওয়ার শঙ্কাও প্রবল।

Comments

The Daily Star  | English

Specific laws needed to combat cyber harassment

There is an absence of a clear legal framework and proper definitions when it comes to cyber violence against women, speakers said at an event yesterday.They urged for specific legislation to combat such crimes..The roundtable, titled “Scanning the Horizon: Addressing Cyber Violence agains

2h ago