‘৯ নম্বর’ সমস্যা: বাংলাদেশের স্ট্রাইকার সংকটের এক হতাশাজনক চিত্র

ছবি: বাফুফে

তপু বর্মণ ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকেই হয়তো কথাগুলো বলেছিলেন। কিন্তু তার আশাবাদী হওয়াটা বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই নয়।

গত সপ্তাহে ফেডারেশন কাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর বসুন্ধরা কিংসের অধিনায়ক ও বাংলাদেশ দলের ডিফেন্ডার তপু দ্য ডেইলি স্টারকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। তিনি বলেন, 'গত বছরের চেয়ে এখনকার অবস্থা ভালো', কারণ এবারের টুর্নামেন্টে গোলদাতাদের তালিকায় দেশি ফরোয়ার্ডদের উপস্থিতি ছিল বেশি।

কাগজে-কলমে এটা ভালো খবর মনে হতে পারে। যৌথভাবে সাতজন খেলোয়াড় সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। কিন্তু ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, বাস্তব চিত্র আসলে ততটা আশাবাদী হওয়ার মতো নয়।

প্রথমত, একজন সেন্টারব্যাক হয়েও তপু যদি সর্বোচ্চ গোলদাতাদের মধ্যে থাকেন, তা কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

উদ্বেগের বিষয় হলো, সর্বোচ্চ গোলদাতা যারা হয়েছেন, তাদের গোলের সংখ্যা মাত্র তিনটি করে। অথচ কিছুদিন আগে শেষ হওয়া ফেডারেশন কাপে ১০টি দল অন্তত চারটি করে ম্যাচ খেলেছে। আর চ্যাম্পিয়ন হওয়া বসুন্ধরা খেলেছে সর্বোচ্চ সাতটি ম্যাচ।

তাছাড়া, এই সাতজনের মধ্যে স্যামুয়েল বোয়াটেং ও মুস্তাফা দ্রামেহ বিদেশি খেলোয়াড়। আর তপুকে একপাশে সরিয়ে রাখলে বাকি চারজন হলেন দেশি ফরোয়ার্ড— আরিফ হোসেন (মোহামেডান), নাবিব নেওয়াজ জীবন (রহমতগঞ্জ), সাজ্জাদ হোসেন (ব্রাদার্স ইউনিয়ন) ও মোহাম্মদ ইব্রাহিম (আবাহনী)।

এদের মধ্যে কেবল ইব্রাহিমই সেই অর্থে দারুণ পারফরম্যান্স করেছেন। তার গোল শুধু পরিসংখ্যানই ভারী করেনি, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে দলের কাজেও লেগেছে। গ্রুপ পর্বে মোহামেডানের বিপক্ষে তিনি জয়সূচক গোলটি করেন। এরপর ফাইনালে তার গোলের কারণে অতিরিক্ত সময়ে গড়ায় লড়াই, যেখানে শেষমেশ টাইব্রেকারে আবাহনীকে হারিয়ে শিরোপা ধরে রাখে বসুন্ধরা।

বাকিদের গোল তুলনামূলক বিচারে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আরিফের দুটি গোল ছিল ফকিরেরপুলের বিপক্ষে ৫-২ ব্যবধানে জেতা ম্যাচে। জীবন হ্যাটট্রিক করেন ফকিরেরপুল ইয়ংমেন্সের বিপক্ষে ৪-০ গোলে জেতা ম্যাচে। একইভাবে সাজ্জাদ হ্যাটট্রিক করেন ওয়ান্ডারার্সের বিপক্ষে ৮-০ ব্যবধানে জেতা ম্যাচে।

এগুলো খবরে আসার মতো হলেও জাতীয় দলের কোচের চোখে পড়ার মতো নয়। ইব্রাহিম ছাড়া আর কোনো দেশি ফরোয়ার্ডই হাভিয়ের কাবরেরাকে আসলে প্রভাবিত করতে পারেননি।

এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে ভারতের বিপক্ষে গত ২৫ মার্চের ম্যাচটির দিকে ঘুরে তাকালে এটা স্পষ্ট হয়। শিলংয়ে সফরকারী লাল-সবুজ জার্সিধারীরা সুনীল ছেত্রীর নেতৃত্বাধীন স্বাগতিকদের আক্রমণভাগকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ফুটবলাররা অন্তত চারটি ভালো সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হওয়ায় গোলশূন্যভাবে শেষ হয় লড়াই।

অনুমিতভাবেই স্প্যানিশ কোচ কাবরেরার শুরুর একাদশে সেদিন কোনো ভালো সেন্টার ফরোয়ার্ড ছিল না। মাঠে নামা শাহরিয়ার ইমন, শেখ মোরসালিন ও রাকিব হোসেন মূলত উইঙ্গার বা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার। ইব্রাহিম ছিলেন বেঞ্চে, যিনি নিজেও আসলে উইঙ্গার।

বদলি খেলোয়াড় নামানোর ক্ষেত্রে কাবরেরা সেদিন আক্রমণভাগকে আরও ক্ষুরধার করার পরিবর্তে রক্ষণভাগকে শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব ও র‍্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থাকা ভারতের বিপক্ষে খেলা বিবেচনায় সেটা বাস্তবসম্মত মনে হলেও ছিল রক্ষণশীল চিন্তা।

তবে সত্যি কথা হলো, ৯ নম্বর পজিশনে উপযুক্ত খেলোয়াড় পাওয়া নিয়ে সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বজুড়েই চলছে। এখন দলগুলো বেশি সময় বল দখলে রেখে খেলার চেষ্টা করে। তাই আগে যেমন সেন্টার ফরোয়ার্ডদের অনেক বেশি জায়গা মিলত মাঠে, এখন তা কমে গেছে। হ্যারি কেইন, আর্লিং হালান্ড ও হুলিয়ান আলভারেজরা এখানে ব্যতিক্রম— তারা বিরল হলেও যে কোনো দলের জন্য অমূল্য।

অবশ্যই, বাংলাদেশ দল গত কয়েক বছরে কিছুটা উন্নতি করেছে। তারা রক্ষণে জমাট থাকার চেষ্টা করে এবং বল দখলে রেখে আক্রমণে ওঠার ক্ষেত্রে নিজস্বতা তৈরির চেষ্টায় আছে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে, যেখানে একটি গোলই ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে, সেখানে শুরুর একাদশে কিংবা বেঞ্চে একজন ভালো স্ট্রাইকার না থাকা মানে বিরাট দুর্বলতা।

ফাহামিদুল ইসলাম, শমিত সোম ও কিউবা মিচেলের মতো তরুণ ও প্রবাসী খেলোয়াড়রা জামাল ভূঁইয়া, তারিক কাজী ও হামজা চৌধুরীর পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশের জার্সিতে খেলার অপেক্ষায় আছেন। তারা দলের শক্তি ও বিকল্পের গভীরতা বাড়ালেও স্ট্রাইকারের অভাব পূরণ করতে পারবেন না।

মূল বিষয় হলো, বাংলাদেশের ঘরোয়া লিগ এমন ফরোয়ার্ড তৈরি করতে পারছে না, যারা বড় ম্যাচে একাই সব আলো কেড়ে নিতে পারেন। দর্শকবিহীন মাঠে, দুর্বল দলের বিপক্ষে গোল আসলে আন্তর্জাতিক ফুটবলের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে খেলোয়াড়দের প্রস্তুত করতে পারে না।

অন্য আরও অনেক কিছুর মতো এর সমাধান বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) হাতে। ক্লাবগুলোকে নিখুঁত ফরোয়ার্ড তৈরি করার জন্য তাগাদা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। নতুন শেখ আসলাম, আলফাজ আহমেদ বা জাহিদ হাসান এমিলি হঠাৎ করে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে না।

বাংলাদেশের একজন স্ট্রাইকার প্রয়োজন এবং খুব দ্রুত। বিশেষ করে, এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে সিঙ্গাপুরের বিপক্ষে আগামী ১০ জুন ঘরের মাঠে অনুষ্ঠেয় গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে।

Comments

The Daily Star  | English

South Africa win World Test Championship to end trophy drought

South Africa won the World Test Championship on Saturday, completing a remarkable turnaround to beat Australia by five wickets as they successfully chased down an imposing 282-run target.

2h ago