ভোট কিনে বিসিবিতে আসার সামর্থ্য নেই: আশরাফুল হক

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) থেকে শুরু করে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) পর্যন্ত, সৈয়দ আশরাফুল হক তার দীর্ঘ প্রশাসনিক ক্যারিয়ারে যেখানেই কাজ করেছেন, সেখানেই রেখেছেন তার সফলতার স্বাক্ষর। বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদার পেছনের অন্যতম রূপকার আশরাফুল গত এক দশকের বেশি দেশের ক্রিকেট থেকে উপেক্ষিতই ছিলেন। এখন জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে সবচেয়ে প্রিয় খেলাটিকে সময় দিতে চান এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটে তার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করতে চান। সম্প্রতি আশরাফুল এসব বিষয়ে এবং আরও নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন দ্য ডেইলি স্টারের সামসুল আরেফীন খানের সঙ্গে। সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো:

দ্য ডেইলি স্টার: আপনি সম্প্রতি বিসিবি সভাপতির পদে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন...

সৈয়দ আশরাফুল হক: আমি আগ্রহী, তবে শর্ত রয়েছে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ বা প্রভাব যেন না থাকে। যদি থাকে, তাহলে আমার পক্ষে এই পদে যাওয়া সম্ভব না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনটা হতে হবে একেবারে অবাধ ও সুষ্ঠু। আমি বিসিবিতে একটি সিন্ডিকেটের কথা শুনেছি, যাদের নিজস্ব ২০-৩০টি ক্লাব রয়েছে। আমার অর্থ দিয়ে ভোট কেনার সামর্থ্য নেই। ফলে আমি মনে করি না, সে পথে আমি সফল হতে পারবো। আর যদি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু না হয়, তাহলে সে নির্বাচন করারই বা দরকার কী?

ডেইলি স্টার: আপনি এই আগ্রহ এক মাস আগে প্রকাশ করেছেন। এরপর কী কোনো অগ্রগতি হয়েছে?

আশরাফুল: এখনো কোনো আপডেট নেই। কয়েকজন মানুষ দেখা করতে এসেছেন, তারা সত্যিই ভালো মানুষ। আমি তাদের বলেছি, 'তোমরাও বোর্ডের পরিচালক হও।' ওরা সবাই ক্লাব সংশ্লিষ্ট মানুষ। তবে কেউ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বলেনি যে তারা আমাকে কাউন্সিলর করবে।

আমি জানি কাউন্সিলর হওয়া সবচেয়ে বড় কিছু না। আমি জানি আমি হতে পারবো। কিন্তু যদি কোনো ধরনের সিন্ডিকেট থাকে, তাহলে আমার পক্ষে সম্ভব হবে না, কারণ তারা জানে আমি যদি বিসিবি সভাপতি হই, তাহলে পুরো পরিস্থিতি বদলে যাবে। আমি অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। ১৯৮৩ সালে ক্রিকেট বোর্ডে যোগ দিয়েছিলাম, তখন আমাদের কোনো অর্থ ছিল না। তবুও আমরা এশিয়া কাপ, মিনি ওয়ার্ল্ড কাপ, এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মতো অনেক বড় বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন করেছি। এখন আমাদের কাছে অর্থ আছে, ফলে আমরাও আরও ভালো কিছু করতে পারি। ক্রিকেটের মান বাড়াতে পারি।

এখন প্রায় সব কিছু নির্ধারিত, ম্যাচগুলো হয় এফটিপি (ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম)-এর অধীনে। এফটিপির পাশাপাশি বছরে এক-দুইটি দ্বিপাক্ষিক সিরিজ করা যায়। সুতরাং, এখন মনোযোগ দেওয়া উচিত ক্রিকেটের মান, অবকাঠামো এবং সুবিধাগুলোর উন্নয়নের দিকে। যদি সেগুলোর মান উন্নয়ন করতে পারি, তাহলে ফলাফল আপনা-আপনিই আসবে।

ডেইলি স্টার: আপনি ২০১৫ সালে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল (এসিসি) ছাড়ার পর থেকে অনেকদিন ধরেই ক্রিকেট বোর্ডে যোগ দেওয়ার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। এখন কেন আপনি এই পদে আগ্রহী হলেন?

আশরাফুল: ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি আমি জীবনের শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছি। আমি এখন জীবনের পড়ন্ত বেলায় আছি। আমার যে অভিজ্ঞতা রয়েছে, আর আমি আগে যেভাবে দায়িত্ব পালন করেছি, আমি মনে করি আমি তা যথেষ্ট ভালোভাবে করেছি। ভারতের মতো শক্তিশালী দেশ ও পাকিস্তানকে সামলে ১৪ বছর এসিসির শীর্ষ পদে কাজ করা সহজ কিছু নয়। এই আগ্রহ ও অভিজ্ঞতার কারণে আমি শেষ চার-পাঁচ বছর বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য দিতে চাই। যদি আমি এটা করতে পারি, অথবা কমপক্ষে পরিকল্পনা শুরু করতে পারি, তাহলে আমি হাসিমুখে মরতে পারবো। ভাবতে পারবো, জীবনে এটা করে যেতে পেরেছি।

ডেইলি স্টার: অনেক পরিচালকই ১০-১৫ বা তারও বেশি বছর ধরে বোর্ডে আছেন। অনেকে আবারও নির্বাচনে দাঁড়াবেন। আপনি কী ভাবছেন এ বিষয়ে?

আশরাফুল: আপনি তাদের জিজ্ঞেস করুন, তারা ২৫ বছরে ক্রিকেট বোর্ডে কী অর্জন করেছে? আমি ক্রিকেটের জন্য কাজ করি কারণ আমি খেলাটি ভালোবাসি, নিজে খেলেছি এবং সংগঠক হিসেবেও কাজ করেছি। আমি আমার পুরো জীবন এই খেলায় কাটিয়েছি। আমি এই খেলার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছি। তাই কিছু ফিরিয়ে দিতে চাই। আপনি যদি পেছনে তাকান, আমি অনেক বড় বড় ইভেন্টের সঙ্গে জড়িত ছিলাম দেশে ও দেশের বাইরে। তারা কী করেছে?

ডেইলি স্টার: অনেকে বলছে আপনি গত ১০ বছরে ক্রিকেটে ছিলেন না...

আশরাফুল: আমাকে আসতেই দেওয়া হয়নি। এখন সবাই বলছে আমার আসার সুযোগ আছে, এবং আমি সত্যিই এই সুযোগ নিতে চাই। আগের মতো কোনো সুযোগ ছিল না, এমনকি একবারও কেউ যোগাযোগ করেনি। ওদের আমার অভিজ্ঞতা নেওয়া উচিত ছিল, আমার সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। এমনকি ম্যাচ দেখার জন্য টিকিটও পাঠায়নি, যা আমি প্রাপ্য ছিলাম। বোর্ডের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমি সেই টিকিট পাওয়ার অধিকার রাখি, কিন্তু তারা কোনোদিনই দেয়নি।

ডেইলি স্টার: আপনি যদি বিসিবি সভাপতি নির্বাচিত হন, তাহলে আপনার অগ্রাধিকার কী হবে?

আশরাফুল: প্রথমত, আমি আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করবো। বিসিবির আর্থিক প্রতিবেদন ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবো। দ্বিতীয়ত, বিসিবির গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনবো। তৃতীয়ত, অবকাঠামোর উন্নয়ন করবো। আমি চেষ্টা করবো বিসিবির নিজস্ব মাঠ কেনার, যাতে অন্য কারো উপর নির্ভর করতে না হয়। শেষত, সভাপতির মেয়াদ দুইবারের বেশি ও পরিচালকদের মেয়াদ তিনবারের বেশি যেন না হয়, সেই বিধান করবো।

ডেইলি স্টার: আপনি বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেননি...

আশরাফুল: দুঃখিত, আমি সেটা বলতে ভুলে গেছি। বিকেন্দ্রীকরণ হবে আমার প্রধান অগ্রাধিকার। এটা আমি আর্থিক স্বচ্ছতার আগে রাখবো। ২০০০ সালের এজিএমেই আলোচনা হয়েছিল যে আঞ্চলিক সংগঠন গঠন করা হবে।

ডেইলি স্টার: সবাই বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলেছে, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি কেন?

আশরাফুল: আসলে কেউই চায় না এটা বাস্তবায়ন হোক। সবাই চায় ঢাকাকেন্দ্রিক থাকতে। কেউ চায় না ক্ষমতা ভাগ করে দিতে। আপনি সময় পেলে বুলবুলকে (আমিনুল ইসলাম বুলবুল) জিজ্ঞেস করুন, আশরাফুল ভাই কি এসিসির জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে এককভাবে সব কিছু করতেন, নাকি সবাইকে ক্ষমতা দিতেন? আপনাকে ক্ষমতা ভাগ করে দিতে হবে। সব কিছু নিজের হাতে রাখতে পারবেন না। আপনি ডিক্টেটর হতে পারবেন না। বোর্ড সভাপতি হলো দলের অধিনায়ক। কিন্তু তিনি ডিক্টেটর নন। তাকে ক্ষমতা ভাগ করে দিতে হবে, না হলে প্রতিষ্ঠান চলবে না। আপনি শুধু ক্লাব চালান না, দেশের পুরো ক্রিকেট পরিচালনা করেন। এটা কারো পক্ষে একা করা সম্ভব নয়।

আগে আমরা পুরোপুরি এনএসসি (ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিল)-এর ওপর নির্ভর করতাম। তারা যে পরিমাণ অর্থ দিত, সেই অর্থ দিয়েই আমাদের বছরজুড়ে সারা দেশে ক্রিকেট আয়োজন করতে হতো। সেটা কীভাবে করতাম? এখন বলতে হবে, 'তুমি যদি প্রতি বছর লিগ আয়োজন করো, তাহলে টাকা পাবে', কিন্তু সাথে সাথে তা যথাযথভাবে ব্যয়ের হিসাবও কর্তৃপক্ষকে দিতে হবে। এখন স্থানীয় সংগঠকদের আগ্রহ নেই, কারণ তারা জানে কিছু উন্নতি করতে পারবে না। তাদের হাতে না অর্থ আছে, না কর্তৃত্ব। তাহলে তারা কেন সময় ব্যয় করবে?

ডেইলি স্টার: ফারুক আহমেদ যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখন গঠনতন্ত্র সংস্কারের আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু ঢাকার ক্লাবগুলোর কঠোর বিরোধিতার কারণে সেটা বাস্তবায়িত হয়নি। আপনি কী এ ধরনের কিছু ভাবছেন?

আশরাফুল: ক্লাবগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। যদি ঢাকার ক্লাবগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে রাজশাহী বা চট্টগ্রামের ক্লাবগুলোও রাখতে পারে। আমরা ঢাকার ক্লাবগুলো নিয়ে কথা বলি কারণ বেশিরভাগ খেলোয়াড় এখানেই খেলে এবং এখান থেকেই বেশি আয় করে। আমিও একটি ক্লাব থেকে উঠে এসেছি—আজাদ বয়েজ ক্লাবের। খেলোয়াড় হিসেবেও, সংগঠক হিসেবেও। আমি মনে করি বিসিবি ও ক্লাবগুলোর সম্পর্ক এমন হওয়া উচিত, যেখানে উভয় পক্ষই লাভবান হবে। একটা ফর্মুলা থাকা দরকার যাতে দুই পক্ষই লাভ পায়। তবে ক্লাবগুলো হতে হবে প্রকৃত। শুধু ভোটের জন্য গড়া ক্লাব নয়। ক্লাবের অবদানকে আমি অস্বীকার করি না, তবে তারা যেন সত্যিকারের ক্লাব হয়। এখন খেলোয়াড়দের বেতন নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠে, যা দেশের ক্রীড়ার ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করে। এসব ঠিক করতে হবে। আমি বুঝতে পারি না কেন আমরা অন্য দেশের ক্রিকেট মডেল অনুসরণ করতে পারি না।

ডেইলি স্টার: আপনি বিসিবিতে কী করতে চান, যা গত কয়েক বছরে হয়নি?

আশরাফুল: বিকেন্দ্রীকরণ হবে আমার প্রথম অগ্রাধিকার। আমি অবকাঠামো উন্নয়ন করতে চাই। আমাদের মাঠ খুবই অপ্রতুল। আমাদের অন্তত ৫০টি মাঠ প্রয়োজন যেখানে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা যাবে। আমাদের স্টেডিয়াম না হলেও চলবে—শুধু মাঠ, ড্রেসিং রুম ও ন্যূনতম সুবিধা। যত বেশি মাঠ থাকবে, তত বেশি খেলোয়াড় তৈরি হবে। আমাদের কোচ, আম্পায়ার, কিউরেটর, ফিজিও, স্কোরারসহ সকল সহায়ক স্টাফের মানও উন্নয়ন করতে হবে।

Comments

The Daily Star  | English

Reforms, justice must come before election: Nahid

He also said, "This generation promises a new democratic constitution for Bangladesh."

4h ago