একদিন সাবের বলল, চলেন আমরা টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য আবেদন করি: আশরাফুল

২০০০ সালের ২৬ জুন টেস্ট মর্যাদা লাভ করে বাংলাদেশ। এবার সেই মর্যাদাপ্রাপ্তির ২৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। সেই সময় টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পেছনে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন তাদের একজন তখনকার বোর্ডের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল হক। দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতকারে আশরাফুল শুনিয়েছেন সেই সময়ের গল্প।
টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের প্রক্রিয়া কীভাবে শুরু হয়েছিল?
সৈয়দ আশরাফুল হক: সত্যি বলতে, যখন আমরা টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য আবেদন করি, তখন আমাদের মনে হয়নি যে আমরা এটা পাব। ১৯৯৬ সালে, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) সাবের হোসেন চৌধুরীকে ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে নিয়োগ করে। একদিন সাবের আমাকে বলল, 'আশরাফুল ভাই, চলেন আমরা টেস্ট স্ট্যাটাসের জন্য আবেদন করি।' আমি হেসে তাকে বললাম, 'তুমি কি পাগল? আমরা তো প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটও খেলতে পারি না আর তুমি টেস্টের কথা বলছ।' সে জোর দিয়ে আমাকে আবেদন করতে বলল, এই বলে যে তা করলে অন্তত আমরা সারিতে থাকব। তারপর আমি কাগজপত্র তৈরি করা শুরু করি এবং ১৯৯৬ সালে আমরা আইসিসিতে আবেদন করি।
এরপর আইসিসি বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও জিম্বাবুয়ের একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সফর করে এবং আমাদের পূরণের জন্য একটি চেকলিস্ট দেয়। আমরা আমাদের কাজ শুরু করি এবং তারা এটি দেখার পর আমাদের প্রতিক্রিয়া জানায়। এর মধ্যে, ১৯৯৬-৯৭ সালে জগ্গু দা (জগমোহন ডালমিয়া) আইসিসি সভাপতি হন। এটি আমাদের জন্য অনেক বড় সাহায্য ছিল। ১৯৯৬ সালে আমরা এসিসি ট্রফি জিতি, ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতি এবং ১৯৯৮ সালে আমরা মিনি বিশ্বকাপও আয়োজন করি। এই কারণেই আমরা প্রতিটি পূর্ণ সদস্যকে দৃঢ়ভাবে বলতে পেরেছিলাম যে আমরা সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে সেরা দল।
১৯৯৯ সালে আইসিসি নির্বাহী বোর্ডের এক সভায়, যখন বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাসের বিষয়টি ওঠে, তখন পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাসের প্রস্তাব করে এবং ভারত সেই প্রস্তাব সমর্থন করে। একই বছর, ওয়েস্ট ইন্ডিজ 'এ' দল আমাদের দেশে আসে। ইয়ান বিশপ সেই দলের ম্যানেজার ছিলেন। ভিড়ের সমর্থন দেখে তিনি খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন এবং তার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া আমাদের ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভোট পেতে সাহায্য করে। প্রথম ভোটাভুটিতে ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড আমাদের পক্ষে ভোট দেয়নি, যেখানে আমরা ৫-৪ ব্যবধানে জিতি। তবে আমাদের আইসিসির অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ পূর্ণ সদস্যদের ভোটের প্রয়োজন ছিল।
তারপর আমরা অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে কাজ করা শুরু করি এবং উভয় ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা করি। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এডি বারলোকে আমাদের জাতীয় দলের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়ে আসি এবং তিনি আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনেও সাহায্য করেছিলেন। ২০০০ সালের শুরুতে, আইসিসি আরেকটি পরিদর্শক দল পাঠায় এবং তারা চলে যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিল যে তারা আমাদের সুপারিশ করবে।
২৫ জুন মরক্কোতে নির্বাহী বোর্ডের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাসের বিষয়টি ৮-১ ভোটে নিশ্চিত হয়। মূলত, আমরা ২৫ তারিখ সন্ধ্যায় টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিলাম, তবে পরের দিন লন্ডনের বার্ষিক সম্মেলনে এটি অনুমোদিত হতে হত। ২৬ জুন, আমরা অবশেষে সর্বসম্মতিক্রমে টেস্ট স্ট্যাটাস পাই, কারণ সকল পূর্ণ সদস্য এবং সহযোগী সদস্য আমাদের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।
এই সময়ের মধ্যে আপনার সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত কোনটি?
আশরাফুল: আমার মনে হয় আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়াটাই সবচেয়ে বড় অর্জন। আমি এটিকে আমার সাংগঠনিক সাফল্যের তালিকায় প্রথম স্থানে রাখব।
কোন বিষয়টি আপনাকে সবচেয়ে বেশি হতাশ করেছে?
আশরাফুল: দেশের ক্রিকেটের অগ্রগতি না দেখে আমি হতাশ। আমি চেয়েছিলাম টেস্ট ক্রিকেটে ২৫ বছর পর বাংলাদেশ ৪ বা ৫ নম্বরে থাকুক এবং ওয়ানডেতেও একই অবস্থানে থাকুক। আমি কল্পনা করেছিলাম আমরা অন্তত একটি বিশ্বকাপ জিতব। আমার সবচেয়ে বড় হতাশা হল আমাদের কাছে টাকা ছিল এবং আমরা সারা দেশে আমাদের খেলোয়াড়দের জন্য সমস্ত সুবিধা নিশ্চিত করতে পারতাম। খেলাটি আমাদের দেশের মানুষকে একত্রিত করেছিল কিন্তু আমরা তার সুবিধা নিতে পারিনি।
সেই বছরগুলোতে বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে আপনার কতখানি স্বপ্ন পূরণ হয়েছে?
আশরাফুল: আমার জন্য, বাংলাদেশ টেস্ট খেলছে এটাই যথেষ্ট। তবে আমার মনে হয় আমাদের আরও অনেক বেশি উন্নতি করা উচিত ছিল। আমরা বিশ্বের ৯ নম্বর দল এবং ২৫ বছর এখানে থাকার পর এর মানে হল আমরা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। যদি আমাদের টাকা ও জনপ্রিয়তা না থাকত, তবে তা ভিন্ন কথা হত... শ্রীলঙ্কা ১৯৮১ সালে টেস্ট স্ট্যাটাস পায় এবং ১৯৯৬ সালের মধ্যে তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। আমাদের জন্য এটা লজ্জাজনক যে এখনও ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া আমাদের সিরিজে আমন্ত্রণ জানাতে চায় না। এই বিষয়ে আমি দূরদর্শী পরিকল্পনার অভাব দেখতে পাচ্ছি কারণ আমরা কেবল সিরিজ ধরে ধরে খেলি। আমরা কেবল বর্তমান নিয়ে ভাবছি, শুধু নিজেদের চেয়ার বাঁচানোর জন্য।
আমরা এডি বারলোর একটি মডেলের কথা শুনেছি। কেন সেটি বাস্তবায়ন করা যায়নি?
আশরাফুল: তিনি চলে যাওয়ার পর আমরা সেটি বাস্তবায়ন করিনি। তার একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল কারণ তিনি এমন একটি ক্রিকেট খেলিয়ে দেশ থেকে এসেছিলেন যেখানে তার সময়ে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়রা ছিল। তিনি জানতেন এটি কীভাবে করতে হয় এবং তার একটি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছিল। তিনি একটি কাঠামো তৈরি করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমরা তা গ্রহণ করিনি কারণ আমরা আরও তাৎক্ষণিক সমাধানে বিশ্বাসী ছিলাম। আমরা খুব বেশি উচ্চাভিলাষী হয়েছিলাম এবং যেহেতু টাকা আসছিল, তাই বোর্ডের লোকেরা দুর্নীতিগ্রস্ত হতে শুরু করে।
Comments