প্রতিরোধযোগ্য দুর্ঘটনার প্রতিকার রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্যেই পড়ে

গত ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাইমারির ভবনের ওপর বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়। দুপুর ১টা ৬ মিনিটে বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই সংবাদটা বিভিন্ন মাধ্যমে আসা শুরু করলে ঘটনাটা কী ঘটেছিল—এটা জানার জন্য সব পড়ে ফেলি। কিন্তু বিকেল গড়াতেই যখন সব অভিভাবকদের হাহাকার আর আহাজারির সংবাদগুলো আসতে শুরু করলো, তখন থেকে আর একটাও সংবাদ পড়িনি! এই সংবাদগুলোর শব্দ, সেখানকার পরিবেশ—আমি ব্যক্তিগতভাবে নিতে পারব না ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
কিন্তু সংবাদপত্রে কাজ করে, সংবাদ নিয়েই নাড়াচাড়া করলে সেটা আর কতটা সম্ভব! চোখ পড়লো অনলাইন সংবাদপত্র বিডিনিউজ২৪.কমের 'মিস, আমার বাচ্চা কই?' শিরোনামে। শুধু এই শিরোনাম আর তার সঙ্গে মায়ের মুখের ছবিটা আমার ভেতরের শ্বাসযন্ত্রকে সাময়িকভাবে যেন বন্ধ করে দিয়েছিল, দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল! যখন শ্বাস নিতে পারলাম, তখন দুই চোখের অশ্রুকে আমি কিছুতেই থামাতে না পেরে নিজের ডেস্ক থেকে উঠে ওয়াশরুমে যেয়ে নিজেকে কিছুটা সামলে নিলাম। আমি সেই সংবাদটা পড়িনি। আমি জানি না, আদৌ সেই সংবাদের ভেতরে কী আছে! কিন্তু আমি সেই মায়ের ওই প্রশ্নটার অর্থ জানি।
রোজ যখন আমি আমার ছেলেকে স্কুলে রেখে আসি, তার শ্রেণি-শিক্ষকের সঙ্গেও একবার দেখা হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। প্রতিদিন যে কথা বলি, এমনটা না। কিন্তু একটা পলক সেই শিক্ষককে দেখি, এটা একটা আশ্বাসের জায়গা, নির্ভরতার জায়গা। এই শিক্ষক একটা প্রতীক। রাষ্ট্রের, সমাজের। কয়েক ঘণ্টার জন্য আমি আমার সন্তানকে সেই নিরাপত্তা বলয়ে রেখে আসি। সেই জায়গা থেকে 'মিস, আমার বাচ্চা কই?' বলা মায়ের শব্দগুলো শিক্ষকের প্রতি, সমাজের প্রতি, সর্বোপরি রাষ্ট্রের প্রতি তার মৌলিক অধিকারের প্রশ্ন। স্কুল ছুটির পর সে তার সন্তানকে সুস্থভাবে বাসায় নিয়ে যাবে—এটাই তার একমাত্র বিশ্বাস।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির পরিত্যক্ত একটা পাইপে পড়ে মারা যাওয়া চার বছর বয়সী জিহাদের কথা আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। এক বিকেলে ছোট্ট জিহাদ বাড়ির সামনে খেলতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। পরে খোঁজ নিয়ে তার পরিবার জানতে পারে, শিশুটি তাদের বাসা সংলগ্ন ওয়াসার পরিত্যক্ত একটা পাইপে পড়ে গেছে। এরপর ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ব্যর্থ হলে দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টা পর সাধারণ মানুষের চেষ্টায় মৃত জিহাদকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। সব মিডিয়া এটা লাইভ দেখিয়েছিল। ভোররাত তিনটা পর্যন্ত সেটা দেখেছিলাম, যদি শিশুটাকে অন্তত জীবিত পাওয়া যায়! কারণ, নিজের বাসার বারান্দার সামনে এ ধরনের একটা ঘটনা আমি নিজে দেখেছিলাম। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে সাড়ে তিন বছরের একটা শিশু তার ঘর লাগোয়া বাবার দোকানে যাওয়ার জন্য বের হলে নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই মা-বাবার আর্তনাদ আমি অবলোকন করেছিলাম। সেই পথ ধরে আমি অফিসের জন্য বের হতে পারিনি! পরদিন তার বাসার সামনের খোলা ড্রেন থেকে মৃত শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়।
সারা বছর ধরে সংবাদ এজেন্সি, প্রতিবেদকরা ডুবে মারা যাওয়া শিশুর সংবাদ পাঠাতে থাকে। জায়গার অভাবে হয়তো সব দেওয়া যায় না, কিন্তু পড়তে হয় সবই! এই সংবাদগুলো হয়তো একটা কাঠামোর মধ্যে বাধা একই রকমের, শুধু ভুক্তভোগী আলাদা, পরিবার আলাদা, জায়গা আলাদা। গত বছর ইউনিসেফের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১৪ হাজারের বেশি শিশু ডুবে মারা যায়। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৪০ শিশু মারা যায়। আবার বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, চলতি বছর জুলাইয়ের প্রথম ছয় দিনে দেশের ১৮ জেলায় অন্তত ৩২ শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। এই সংবাদগুলো যেন আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক হয়ে গেছে! আমরা এগুলো নিয়ে কেউ কোনো কথা বলি না!
কোনো সন্দেহ নেই যে এগুলো সবগুলোই দুর্ঘটনা। কিন্তু এই দুর্ঘটনাগুলো প্রতিরোধযোগ্য। প্রয়োজন শুধু সংঘবদ্ধ ইচ্ছা, সুসংগঠিত পরিকল্পনা আর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন। আমরা এমনই একটা বাংলাদেশের প্রতিফলন দেখেছিলাম গত বছরের জুলাই অভ্যুত্থানে। আর আজকের লেখার হেতুও এটাই।
ফিরে আসি উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের ভবনের ওপর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায়। ঘটনার পর আমরা যা যা জানতে পারি:
প্রথমত: এই বিমান প্রযুক্তিগতভাবে পুরোনো। চীনের তৈরি এই যুদ্ধবিমানগুলোর উৎপাদন বন্ধ হয় ২০১৩ সালে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ এই মডেলের ১৬টি বিমান কিনে এবং তা ২০১৩ সালে বহরে যুক্ত করে। এটা দেশে এই মডেলের যুদ্ধবিমানের চতুর্থ দুর্ঘটনা। এর আগে ২০১৮ সালের নভেম্বরে টাঙ্গাইলের মধুপুরের রসুলপুর ফায়ারিং রেঞ্জে মহড়ার সময় বিমানবাহিনীর এফ-৭ বিজি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়। ২০১৫ সালের জুনে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে উড্ডয়ন করার পর বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ এমবি যুদ্ধবিমান। এরপর ২০২১ সালের নভেম্বরে চট্টগ্রামের জহুরুল হক ঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর বঙ্গোপসাগরে বিধ্বস্ত হয় এফ-৭ এমবি।
দ্বিতীয়ত: দুর্ঘটনার পর সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্ন দুইটা সামনে এসেছে, সেটা হলো: ১। জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ বিমান কেন, ২। একই রানওয়েতে সামরিক ও বেসামরিক বিমানের ওঠানামা কেন। বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা (আইকাও), যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফএএ) আইনে জনবসতিপূর্ণ শহরের উপর দিয়ে প্রশিক্ষণ বিমান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। নিষেধাজ্ঞা আছে একই রানওয়েতে সামরিক ও বেসামরিক বিমানের ওঠানামা করারও।
তৃতীয়ত: ১৯৮০ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এর অপারেশনাল কার্যক্রম তেজগাঁও থেকে কুর্মিটোলায় স্থানান্তর করা হয়। মূল ঢাকা শহর থেকে কুর্মিটোলার দূরত্বও ছিল অনেক। কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে আবাসিক এলাকা উত্তরা মডেল টাউন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানে নতুন নতুন বসতি এবং বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে ওঠে। ঢাকা শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকটা দ্রুত নগরায়নের বিকাশ ঘটে।
গত বছরের ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ নিহত হলে দেশের প্রতিটা শহরে শহরে রাস্তায় মানুষের ঢল নেমে গিয়েছিল। কোটাবিরোধী আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। যৌথ এই চাওয়া নিমিষেই পতন ঘটিয়েছিল সাড়ে ১৫ বছরের শেখ হাসিনার রাজত্বের। এরপর নতুন সরকারের 'রাষ্ট্র সংস্কার' প্রসঙ্গটা জনগণের অন্তরের চাওয়ার সঙ্গেই মিলে গিয়েছিল। বুঝতে বাকি রাখে না যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশ ঘিরে স্বপ্নের, আকাঙ্ক্ষার শেষ ছিল না! সেই অনুভূতি আর ভালো লাগাগুলো ফিকে হয়ে যেতে থাকে যখন মাস গড়াতেই দেখি রঙিন গ্রাফিতিগুলোতে পোস্টার লেগে গেছে! কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন, প্রাইভেটের বিজ্ঞাপন এবং শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দলগুলোও সেঁটে দেয় তাদের মূল্যবান বার্তার পোস্টার! গণঅভ্যুত্থানের শক্তি যোগানো বার্তাগুলো মিশে যেতে থাকে সেই পোস্টারের নিচে। তাহলে কী গণঅভ্যুত্থানও মলিন হতে যাচ্ছে? না, এটা আমার কাম্য না। এটা বাংলাদেশের একটা মানুষও চায় না।
দেয়ালের 'স্বাধীনতা এনেছি, সংস্কারও আনবো'—গ্রাফিতির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। জুলাই ২৪-এর পর থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি যেই শব্দটা শুনেছি এবং এখনো শুনছি সেটা হলো—'রাষ্ট্র সংস্কার'। এ উদ্দেশ্যে সরকার ১০টা কমিশনও গঠন করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের এই সংস্কার বলতে তারা আসলে কী বুঝিয়েছেন?
গত বছর এক অনুষ্ঠানে এ সম্পর্কে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা জানান, সবার মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে পারলেই 'রাষ্ট্র সংস্কার' সম্ভব। সেই অনুষ্ঠানে তৎকালীন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য আরিফুল ইসলাম আদীব বলেন, 'রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো প্রতিটি নাগরিকের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। সবাই যেন যথাযথভাবে বেঁচে থাকার অধিকার পায়। সামাজিক ন্যায়বিচার পায়। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ হলো জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়া।' (সকলের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে পারলেই 'রাষ্ট্রসংস্কার' সম্ভব : আলোচনা সভায় বক্তারা, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বাসস)।
নতুন এই বাংলাদেশের কাছে মা-বাবার কোল খালি হওয়ার যন্ত্রণার তীব্রতাটা অনেক বেশি বোধগম্য। নতুন এই বাংলাদেশের কাছে আমি সবার 'যথাযথভাবে বেঁচে থাকার অধিকার'-টাই দাবি করছি। দাবি করছি:
১। যেসব দুর্ঘটনা আমরা প্রতিরোধ করতে পারি, সেগুলো প্রতিরোধের ব্যবস্থা যেন করা হয়। শহরে এখনো অনেক ঢাকনা ছাড়া পাইপ, ড্রেন, ম্যানহোল আছে, সেগুলো শনাক্ত করা এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।
২। ডুবে মারা যাওয়া শিশুদের রক্ষায় প্রতিটি এলাকায় সচেতনতামূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া। স্কুলগুলোতে শিশুদের পানিতে পড়ে যাওয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত করানো, এনজিওগুলোর মাধ্যমে সচেতনতামূলক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে।
৩। প্রযুক্তিগতভাবে পুরোনো বিমান দিয়ে প্রশিক্ষণ বন্ধ করার ব্যবস্থা করা, প্রশিক্ষণের পথ নিয়ে যেসব আইন আছে, তা মেনে চলার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৪। ঢাকা শহর থেকে দূরে বিমানবন্দরকে স্থানান্তরিত করা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ কাজ। তারপরও জনসাধারণের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়ে এই পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করা। এবং অবশ্যই লক্ষ্য রাখা যেন সেটাও কুর্মিটোলার পরিণতি লাভ না করে। অর্থাৎ, কুর্মিটোলায় বিমানবন্দরও জনশূন্য এলাকাতেই ছিল। কিন্তু সেখানে পরবর্তীতে নগরায়নের অনুমতি দেওয়া হয়।
সর্বোপরি, আমার সন্তানকে স্কুলে রেখে এলে কিংবা পাড়ার গলিতে খেলতে পাঠালে তাকে আবার নিরাপদে আমার কোলে ফিরে পাওয়ার দাবি করছি।
জান্নাতুল রুহী: সাংবাদিক ও লেখক
Comments