জন্মশতবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

তাজউদ্দীন আহমদ: মুক্তিযুদ্ধের এক বিস্মৃত নেতা

যুদ্ধাঞ্চলগুলোতে গিয়ে গিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ফাইল ছবি

তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন অনেক দিক থেকেই ব্যতিক্রমধর্মী এক নেতা। অবহেলিত মানুষের প্রতি তার অঙ্গীকার, ব্যক্তিজীবনে মিতব্যয়িতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, কাজের প্রতি একাগ্রতা, নিঃস্বার্থতা, দৃঢ় সংকল্প ও নির্ভীকতা—এসব কিছু তাকে বিশ্বের বিরল নেতাদের একজন করে তুলেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যেখানে রাজনীতিকদের নৈতিক মানদণ্ড এবং ব্যক্তি-স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মানসিকতা প্রায় বিরল, সেখানে তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, তাজউদ্দীন আহমদের মতো একজন ব্যক্তিত্বের জন্মশতবার্ষিকী জাতীয় পর্যায়ে কিংবা বেসরকারি, বুদ্ধিজীবী বা একাডেমিক পর্যায়ে উদযাপিত হচ্ছে না। এটি আমাদের ইতিহাসবোধের অভাব, বীরদের সম্মান না দেওয়ার করুণ চিত্র এবং তারচেয়েও বেশি দুঃখজনকভাবে—আমরা যে এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়াত্ব ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংকীর্ণতার মধ্যে বসবাস করছি, তার প্রমাণ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজ বাড়িতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত ও পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সম্পূর্ণ অনিশ্চিত ও অজানা সশস্ত্র সংগ্রামের পথে অগ্রসর হওয়ার তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্তটি কেবল ব্যক্তি তাজউদ্দীনের জন্যই নয়, বরং জাতির জন্যও ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের ঘটনা। শেখ মুজিবের সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। অনেকেই এর সমালোচনা করেছেন, অনেকে করেননি, দুই দিকেই যুক্তি রয়েছে। আমার লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের পক্ষে বা বিপক্ষে যুক্তি দেওয়া না, বরং এই সিদ্ধান্ত তাজউদ্দীনের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছিল তা বিশ্লেষণ করা।

বঙ্গবন্ধুর পর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে এবার তাজউদ্দীনকে জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হয়। দুর্দান্ত সাহস, দৃঢ় সংকল্প, গভীর দেশপ্রেম ও অনুকরণীয় নেতৃত্বের মাধ্যমে তিনি সেই কাজটি করেছিলেন।

সেই নয় মাসের সংকটকালীন যাত্রায় আমরা যদি তাজউদ্দীনের রূপান্তর দেখি—একজন সফল সংগঠক থেকে মুক্তিযুদ্ধের কার্যত প্রধান ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াটি বোঝার চেষ্টা করি—তাহলে তার বহুমাত্রিকতা ও অন্তর্নিহিত শক্তির গভীরতা উপলব্ধি করতে পারি। তিনি পরিস্থিতির প্রয়োজনে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছিলেন, চিন্তা ও কর্মের পরিসর বাড়িয়েছিলেন, জ্ঞানের ব্যাপ্তি ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রসারিত করেছিলেন এবং সর্বোপরি, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন কোনো রাজনীতিবিদ, এমনকি তাজউদ্দীন নিজেও সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু আত্মবিশ্বাস, মর্যাদাবোধ, কৌশলগত দূরদর্শিতা ও সততার সঙ্গে তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেই সময়ে তার নিজ দল থেকে আসা বাধাও তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল।

সহজভাবে বলতে গেলে, তাকে জাতিকে যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে হয়েছে এবং বিশ্বকে সহযোগিতার জন্য রাজি করাতে হয়েছে।

ভাবুন, আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে প্রথম দুদিন তিনি পুরান ঢাকায় আত্মগোপনে ছিলেন, তারপর দিনমজুরের ছদ্মবেশে শহর ছেড়ে বের হয়ে কখনো হেঁটে, কখনো নৌকায় দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চল পেরিয়েছেন এবং পুরো সময়জুড়ে তিনি গভীরভাবে ভেবেছেন যে কীভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত করা যায়।

তার মানসিক অবস্থার প্রথম ঝলক আমরা পাই যখন তিনি সীমান্তে পৌঁছে বলেন, তিনি ভারতে 'আশ্রয়প্রার্থী' শরণার্থী হিসেবে নয়, বরং 'একটি স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি' হিসেবে সাহায্য চাইতে চান।

ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী, তারা ভারতীয় পক্ষের সাড়া পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয় বিধায় সেই অপেক্ষা এতটাই দীর্ঘ হয় যে, একপর্যায়ে তারা ক্লান্ত হয়ে একটি কালভার্টের ওপর ঘুমিয়ে পড়েন। ভাবুন, যে মানুষটি কয়েক দিনের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন, তিনি কোনো ধরনের অহমিকাবোধ না রেখে একটি কালভার্টের ওপর ঘুমিয়ে পড়েন। এটাই ছিল তার বিপ্লবী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।

তাজউদ্দীনের ব্যতিক্রমী নেতৃত্বের আরেকটি সাক্ষ্য পাওয়া যায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতে। এই সাক্ষাতের গুরুত্ব বর্ণনাতীত। সেখানেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্বের বীজ বপন হয়, যা পরবর্তী নয় মাসের গণহত্যা ও নৃশংস যুদ্ধের সময়ে আমাদের পথ দেখিয়েছে।

একবার কল্পনা করুন—একজন মানুষ, যার কাছে আত্মমর্যাদা ও জনগণের স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা এবং সেটা অর্জনে আত্মত্যাগের সাহস ছাড়া আর কিছুই নেই, তিনি বসেছেন বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের একজন নেত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মুখোমুখি। তার কাছে তিনি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সহযোগিতা চাইছেন।

'আলোকের অনন্তধারা'য় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের লেখা অনুযায়ী, তাজউদ্দীন বলেছিলেন, '...এই স্বাধীনতার যুদ্ধ আমাদের এবং আমরা নিজেরাই সব করতে চাই। আপনাদের কাছ থেকে যা চাই তা হলো—ভারতীয় ভূখণ্ডে মুক্তিবাহিনীর জন্য আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ। আমরা সীমান্ত অতিক্রম করার সময় যে পরিস্থিতি দেখেছি, তাতে মনে হয় দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে বিশাল শরণার্থী ঢল নামবে। তাদের আশ্রয় ও খাদ্যের ব্যবস্থা করতে ভারতের সহায়তা প্রয়োজন। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা বিশ্বের কাছে জানানোর জন্যও আপনাদের সহায়তা দরকার। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও আমরা আপনাদের সহায়তা কামনা করি।' (প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৬৯) তিনি বলেছিলেন, এ যুদ্ধ আমাদের। তিনি চাননি এটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কিংবা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ হিসেবে প্রতীয়মান হোক। এটি ছিল আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তির যুদ্ধ।

তাজউদ্দীনের সামনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সিদ্ধান্ত ছিল আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি 'প্রবাসী সরকার' গঠন করা, যাতে আমাদের যুদ্ধ বৈধতা পায়, দৃশ্যমান রূপ নেয়, একটি প্রতিনিধি ও বৈধ নেতৃত্ব কাঠামো তৈরি হয়। এটা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করবে এবং সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটি সংগঠিত প্রক্রিয়া তৈরি করবে।

অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের কারণে বিষয়টি কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। শেখ মনি ও সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন তরুণরা (যেখানে তোফায়েল আহমেদ ও আ স ম আবদুর রবসহ অন্যান্যরা ছিলেন) অসহযোগ আন্দোলনের সময় অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। তারা সেই সময় বিপ্লবী সরকার গঠনের দাবি তোলেন। এ ধরনের সরকার তাদেরকে অনেক বেশি ক্ষমতা ও কৌশলগত সুবিধা দিত। এটা ছিল তাজউদ্দীন ও অন্যান্য জ্যেষ্ঠ নেতাদের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক। কেননা, তাদের চিন্তা ছিল ১৬৭ জন কেন্দ্রীয় ও ২৮৮ জন প্রাদেশিক নির্বাচিত সংসদ সদস্যকে কলকাতায় নিয়ে আসা এবং তাদের সমর্থনে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করা।

সরকার গঠনে তাজউদ্দীনের কৌশল ছিল অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন গ্রুপকেই অনুসরণ করা। তিনি একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কাঠামো বেছে নেন—বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী এবং এম মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান ও খন্দকার মোশতাক আহমদকে মন্ত্রী করে তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধান করেন।

তবে শেখ মনির নেতৃত্বাধীন তরুণ গোষ্ঠী তাজউদ্দীনের এই কৌশল মানতে বাধ্য হলেও তার বিরুদ্ধে বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। প্রতিটি পদক্ষেপেই তাকে চ্যালেঞ্জ ও বিরোধিতার মুখে পড়তে হয়েছে। এই বিরোধিতা চরমে ওঠে যখন মুজিব বাহিনী গঠিত হয়।

'আলোকের অনন্তধারা' বইয়ে অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের বর্ণনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, কীভাবে দলীয় বিভাজনের কারণে তাজউদ্দীনের সরকার নানান সমস্যার সম্মুখীন হয়। শেখ মনি ও ছাত্রনেতাদের পাশাপাশি জ্যেষ্ঠদের মধ্যে খন্দকার মোশতাকের ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব চান, অন্যদের থেকে আলাদা করে একটি বিশেষ অফিস বরাদ্দ দিতে মুজিবনগর সরকারকে বাধ্য করেন এবং মাহাবুব আলম চাষী ও তাহেরউদ্দিনকে কলকাতায় এনে তার পররাষ্ট্র দপ্তরে সংযুক্ত করতে বাধ্য করেন। ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর এই দুজনের নাম সামনে আসে, যেখানে মোশতাক প্রধান ভূমিকা পালন করেন এবং খুনিরা তাকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির পদে বসায়।

তাজউদ্দীন আহমদ যেভাবে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম, অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা থেকেই তার অনন্য নেতৃত্ব ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তৎকালীন কোনো রাজনীতিবিদ, এমনকি তারও এ বিষয়ে কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা ছিল না। ১১টি সেক্টর ও ৭০টি সাবসেক্টর গঠন, সেগুলোর নেতৃত্ব কাঠামো তৈরি এবং অস্ত্র, গোলাবারুদ, খাদ্য ও প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা ছিল একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ।

আমাদের সেক্টর কমান্ডাররা ছিলেন পাকিস্তান-প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর। তাদের মূল্যবোধ, মনোভাব ও কমান্ড কাঠামো ছিল স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনীর উপযোগী। কিন্তু, সেগুলো সেই সময়ে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধের জন্য উপযোগী ছিল না। এই প্রেক্ষাপটেও আমাদের সেক্টর কমান্ডাররা অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন, যার যথোপযুক্ত সম্মান আজও তারা পাননি।

আমাদের বাহিনীকে অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করতেও তাজউদ্দীন বিশাল ভূমিকা পালন করেন। ইতিহাসের সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সৈনিকদের যে মানসিক সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল, তিনি অকুণ্ঠভাবে তা দিয়েছেন। যুদ্ধাঞ্চলগুলোতে গিয়ে গিয়ে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।

তার সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল ভারতের সঙ্গে আলোচনা করে অস্ত্র ও গোলাবারুদের সরবরাহ অব্যাহত রাখা। যদিও সেই সময় আমাদের যে পরিমাণ অস্ত্র-গোলা বারুদ দরকার ছিল, তা আমরা পাইনি। নিঃসন্দেহে এ বিষয়ে ভারতের সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে তাদের নিজস্ব কৌশলগত বিবেচনাতেই। কিন্তু, তাজউদ্দীন সবসময় আমাদের প্রয়োজনগুলো সফলভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছেন এবং তার লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।

তাজউদ্দীনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল, যা খুব বেশি আলোচিত হয়নি।

প্রথমটি ছিল একটি প্ল্যাটফর্ম গঠনে তার প্রচেষ্টা, যার মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থনকারী সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যায়। তিনি সেপ্টেম্বর মাসে মওলানা ভাসানী, মোজাফফর আহমদ, কমরেড মণি সিংহসহ বিভিন্ন দলের নেতাদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন। এটি ছিল এক প্রজ্ঞাসম্পন্ন পদক্ষেপ, যা প্রবাসী সরকারের ভাবমূর্তি ও মর্যাদাকে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিকভাবে অনেক শক্তিশালী করেছিল।

একইসঙ্গে তাজউদ্দীন আগেভাগেই ভবিষ্যৎ চিন্তা করেছিলেন এবং বাংলাদেশের সৃষ্টি-পরবর্তী সময়ের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের জন্য পরিকল্পনা করেছিলেন। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ছিল সব মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করা। তার ভাবনা ছিল, যারা অস্ত্র হাতে শত্রুকে পরাজিত করেছে, সেই তরুণদের জাতি গঠনের এক বিশাল শক্তিতে রূপান্তর করা। তিনি কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে খালি হাতে বাড়ি পাঠাতে চাননি, বরং তাদেরকে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজে নিয়োজিত করতে চেয়েছিলেন।

তাজউদ্দীন আহমদের জন্মশতবার্ষিকীতে তাকে স্মরণ করার সময় আমাদের নিজেদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করতে হবে—কেন এই মহান ব্যক্তির অবদান আজও এত উপেক্ষিত?

আমরাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যে উপহাস করেছি, তার মধ্যেই এর উত্তর নিহিত। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেত আমাদের ইতিহাসের বই, জাতীয় প্রতীক, বীর ও স্কুলের পাঠ্যপুস্তক। একবার ভেবে দেখুন, আমাদের সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনার বর্ণনাকে দলকেন্দ্রিক করে আমরা তরুণ প্রজন্মের কী পরিমাণ ক্ষতি করেছি। যেহেতু তাজউদ্দীন-সমর্থক কোনো দল কখনো ক্ষমতায় আসেনি, তাই তার অবদানও অবহেলিতই থেকে গেছে।

ইতিহাসের প্রতি এত সংকীর্ণ, অসৎ ও অদূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কি কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারে? আজ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের নিয়ে যে উদাসীনতা ও যথাযথ শ্রদ্ধার অভাব দেখা যায়, তার অন্যতম কারণ হলো—ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধকে অপব্যবহার করা। অথচ এই মুক্তিযুদ্ধ আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে মহিমান্বিত অতীত, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, যেখানে আমরা গণহত্যা, জাতিগত নিধন ও জাতি হিসেবে ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছিলাম। এই যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। ঘরবাড়ি ও জীবিকা হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ।

কখন এবং কীভাবে আমাদের মন যথার্থ ও তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের দিকে ফিরবে? যখন দেখতে পাই, ইতিহাস বিকৃত হচ্ছে, সত্যটা বিকৃত করে মিথ্যা বর্ণনায় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে, তখন ভাবতে থাকি—কীভাবে সত্যের ভিত্তিতে আমাদের ইতিহাস প্রতিষ্ঠা করা যায়!

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

Comments