আড়ি পেতে শোনার গল্প

ছবি: সংগৃহীত

আড়ি পেতে শোনা বা ইভসড্রপিং শব্দটা অনেকের কাছেই অতি পরিচিত। প্রাচীনকাল থেকেই আড়ি পেতে শোনার প্রচলন রয়েছে। তখন ইভস বা ঘরের ছাদের কার্নিশের নিচে বসে কারো অজান্তে ঘরের ভেতরের কথোপকথন শোনা হতো। তখন থেকে আজ পর্যন্ত ইভসড্রপিং বা আড়ি পেতে শোনার ব্যবস্থা যুগে যুগে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে।

টেলিযোগাযোগ সেবা আবিষ্কারের পর ওয়‍্যারট‍্যাপিংয়ের মাধ্যমে টেলিফোনে আড়িপাতা শুরু হয়। শুরুর দিকে গৃহযুদ্ধের সময় সৈনিকরা এবং পরবর্তীতে অসাধু ও কালোবাজারি চক্র টেলিফোনে আড়িপাতা শুরু করেছিল।

ষোড়শ শতাব্দী থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আড়ি পেতে শোনার প্রচলন শুরু হয়। পরবর্তীতে সরকারি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আইন সম্মতভাবে টেলিফোনে আড়িপাতা শুরু করে। আইনি কাঠামো এবং ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা করে বিশেষ উদ্দেশ্য যেমন: জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে, অপরাধ তৎপরতা তদন্তের স্বার্থেই শুধুমাত্র আড়িপাতা শুরু করা হয়।

ফিক্সড লাইন পিএসটিএন টেলিফোনের যুগে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের এমডিএফ (মেইন ডিস্ট্রিবিউশন ফ্রেম) রুম থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যালয় পর্যন্ত কপার কেবল স্থাপন করা থাকত। টার্গেট বা সাবজেক্ট টেলিফোন নম্বরকে এমডিএফ রুম থেকে প্যারালাল করে (ওয়‍্যারট‍্যাপিং) গ্রাহকের অজান্তেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের অফিসে বসে কথোপকথন শুনত বা রেকর্ড করত।

মোবাইল ফোন আসার পর আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যাকে আড়িপাততে চায়, তার কথোপকথন রেকর্ড করার পাশাপাশি তার অবস্থান জানারও প্রয়োজন পড়ে। মোবাইল ফোনে আড়িপাতার জন্য মোবাইলের মেইন সুইচ (সার্কিট সুইচ বা আইপি) থেকে বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ফরকিং করে অপটিক্যাল ফাইবার দিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দপ্তর পর্যন্ত সংযোগ করা থাকে। সেই বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে গ্রাহকের তথ‍্য, কলের ডিটেইল রেকর্ড, কথোপকথন রেকর্ড করা এবং লোকেশন রেজিস্টার থেকে মোবাইলের জিপিএস অবস্থানও জানা যায়। মোবাইল অপারেটর কখনো জানতে পারে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কার মোবাইল ট্যাপ বা ট্র‍্যাক করছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক অপরাধীকে খুব দ্রুত শনাক্ত এবং গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়েছে।

ইন্টারনেটের যুগে আড়িপাতার ধরনই পরিবর্তন হয়ে যায়। ইলেকট্রনিক ইভসড্রপিং একটা নতুন টার্ম চালু হয়। ইন্টারনেট যেহেতু ওপেন টেকনোলজি এখানে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি অসাধু হ্যাকাররাও আড়িপাতার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ই-মেইল যোগাযোগে ম‍্যান ইন দ্য মিডল অ্যাটাক করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ক্রিমিনাল বা রাষ্ট্রদ্রোহিতা ঠেকাতে পারে, আবার অন‍্যদিকে হ‍্যাকাররা অভিনব প্রতারণার ফাঁদ তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে বা সামাজিক মূল্যবোধ রক্ষার্থে নেটওয়ার্ক মনিটরিং বা ডেটা ইন্টারসেপশন ব‍্যবস্থা চালু করে। ইন্টারনেট গেটওয়ের ব‍্যান্ডউইথের ওপর ডিপ প্যাকেট ইন্সপ্যাকশন (ডিপিআই) নামে একটি সিস্টেম বসানো হয়, যা দিয়ে ইন্টারনেটের বিভিন্ন সার্ভিসকে কন্ট্রোল বা মনিটরিং করার চেষ্টা করা হয়। বিশেষ কোনো সামাজিক যোগাযোগমাধ‍্যম, বিভ্রান্তিমূলক ওয়েবসাইট বা পর্ন সাইট বন্ধের চেষ্টা করা হয়।

আগের যুগে যেমন কালোবাজারিরা টেলিফোনে আড়ি পেতে শুনত, আর বর্তমানে অসাধু হ‍্যাকাররা সাইবার অ্যাটাকের মাধ‍্যমে ডেটা মডিফাই, ডিলিট বা কন্ট্রোল নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে থাকে। জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার্থে সাইবার সিকিউরিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভিনদেশি হ্যাকাররা যাতে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ‍্যের নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারে, সেদিকেও কড়া নজর রাখতে হয়। সুতরাং মহৎ উদ্দেশ‍্য নিয়েই সাইবার স্পেসে বিভিন্ন ধরনের পর্যবেক্ষণ ও নিরাপত্তার ব‍্যবস্থা করা হয়।

স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ‍্যম আসার পর আড়িপাতা এক অন‍্য মাত্রায় চলে যায়। মোবাইল বা ফিক্সড ফোনের ভয়েস কল যখন ইন্টারনেটের ওপর দিয়ে অ্যাপভিত্তিক কলের মাধ‍্যমে শুরু হয়, তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বেশ বেকায়দায় পড়ে যায়। অপরাধীরা গোপন কথা বিভিন্ন সিকিউরড অ্যাপেই বলা শুরু করে। অনেক দেশে এসব অ্যাপের সিকিউরিটি কি সেই দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে শেয়ার করতে বাধ্য করা হয়। যদিও অনেক উচ্চমূল্যের সফটওয়্যার (পেগাস‍্যাস) অ্যাপভিত্তিক কলেরও আড়িপাতার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সবচেয়ে বড় সমস‍্যা হলো ভুল বা বিভ্রান্তিমূলক তথ‍্যের অবাধ প্রচার, যা সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করে। সামাজিক যোগাযোগমাধ‍্যমে অনেক নিরীহ অসহায় ব‍্যক্তি এবং শিশুরা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়। সুতরাং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে বিভিন্ন টুলস ব‍্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ‍্যমেও এখন সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে হয়।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১-এ সন্নিবেশিত টেলিযোগাযোগ (সংশোধন) আইন, ২০০৬ এর ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে দেশের টেলিযোগাযোগ সেবা দানকারী সব অপারেটরে আইনসম্মত মনিটরিং কাজে আইনপ্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সহায়তা করার জন‍্য ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে এনএমসি (ন‍্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার) নামে ডিজিএফআই একটি কার্যক্রম চালু করে। ২০১৩ সালে জানুয়ারিতে এনএমসি নাম পরিবর্তন করে এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) করা হয়, যা ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এই সংস্থাই বাংলাদেশে আড়িপাতার একমাত্র আইনি সংস্থা, যারা অন‍্য সংস্থাগুলোকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। যদিও অন‍্য কিছু সংস্থাও আড়িপাতার জন‍্য নিজস্ব সক্ষমতা তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী ব্যক্তির গোপনীয়তার অধিকার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিবেচিত। আড়িপাতা একটি অত‍্যন্ত সংবেদনশীল বিষয়। আইন-বহির্ভূতভাবে কোনো ব্যক্তিকে আড়িপাতা বা গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল।

কিন্তু আমাদের দেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই কর্তৃত্ববাদী, একনায়ক, ফ্যাসিস্ট, ডেসপট সরকারেরা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা বা অপরাধ দমনের নামে বিরোধী মত দমন, মত প্রকাশ বা বাকস্বাধীনতা রোধে আড়িপাতা সংস্থাকে হীন স্বার্থ চরিতার্থে ব্যবহার করে আসছে। বিগত বছরগুলোতে আমাদের দেশেও আড়িপাতার মাধ‍্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক অভিযোগ আছে, যা অনেকবার মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। ইন্টারনেট গেটওয়েতে সরকারি কন্ট্রোল থাকায় কখনো বিশেষ কোনো ওয়েবসাইট, অ্যাপ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করা হয়েছে। একইভাবে দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা ও অপরাধ দমনে অবশ‍্যই আড়িপাতার ব‍্যবস্থা রাখতে হবে। কিন্তু সেই কার্যক্রমের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যাতে কেউ মানবাধিকার লঙ্ঘন করতে না পারে, তার জন্য কঠোর আইনি কাঠামো এবং তার প্রয়োগের ব‍্যবস্থা করতে হবে।

মো. হাসিবুর রশিদ: প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইন্টারক্লাউড লিমিটেড

Comments

The Daily Star  | English

Retaliation 'underway' as India hits Pakistan

New Delhi claims hitting 9 'terrorist sites'; Islamabad says civilians hit, claims downing 5 Indian jets; at least 8 killed; US, UN sound alarm

3h ago