সংস্কার বনাম নির্বাচন: এ বছরের মধ্যে দুটোই প্রয়োজন ও সম্ভব

ইলাস্ট্রেশন: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি বিতর্ক আমাদের চিন্তাধারাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। 'সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়' বনাম 'নির্বাচনে দেরি হলে সংস্কার নয়'—এই বিতর্কে রাজনৈতিক মহল এতটাই জড়িয়ে পড়েছে যে, জরুরি বিষয়গুলো থেকে তাদের নজর সরে যাচ্ছে।

উভয়পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে বিতর্ক এখন আরও তীব্র হয়ে উঠছে। কিন্তু, বাস্তবতা হলো, আমাদের দুটোই প্রয়োজন এবং ২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যেই তা অর্জন করা সম্ভব।

জনগণ চায় সংস্কারের এই সুবর্ণ সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। তবে দেশের মানুষ বর্তমান পরিস্থিতির জটিলতা সম্পর্কেও সচেতন এবং তাদের অগ্রাধিকার হচ্ছে স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও আইনি পরিবেশ।

যারা নির্বাচনকে সংস্কারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন, তারা সংস্কারের অপরিহার্যতাকে খাটো করে দেখছেন। তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে, বাকশাল প্রবর্তন, দুইবারের সামরিক শাসন, ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ এবং দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসন কেবল বিচারব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের পথই রুদ্ধ করেনি, বরং শাসনব্যবস্থাকে জনসেবামূলক করার পরিবর্তে শাসকদের অস্ত্রে পরিণত করেছে। কাজেই সংস্কারের গুরুত্ব নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই।

অপরদিকে, যারা সংস্কারকে নির্বাচনের ওপরে স্থান দিচ্ছেন, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব এবং যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা যথাযথভাবে অনুধাবন করছেন না। কেননা, গত তিনটি নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দেশে একটি নির্বাচিত সরকার ও সংসদ ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। জাতীয় নির্বাচন জনগণকে সেই অধিকার ফিরিয়ে দেবে, যেখানে তারা নির্ধারণ করতে পারে যে কে শাসনক্ষমতায় থাকবে, কে থাকবে না।

কোন দল বা ব্যক্তি দেশ পরিচালনার ক্ষমতা পাবে, রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হওয়া করদাতাদের অর্থ ব্যয় করবে এবং নতুন নীতিমালা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে সেটা নির্ধারণ করা জনগণের অধিকার। কেবলমাত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমেই এটা নিশ্চিত করা সম্ভব।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে শেখ হাসিনার শাসনামলে ব্যাপক দুর্নীতি ও অপশাসনের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি জনরোষ সৃষ্টি করেছিল তার কারসাজিমূলক নির্বাচনগুলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে ছাত্রদের জনপ্রিয়তা ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার কারণে দেশের মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগে কিছুটা অপেক্ষা করতে রাজি আছে। কিন্তু সেই অপেক্ষারও সীমা আছে।

নির্বাচন কেবল সরকারই গঠন করে না, বরং ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করে। আমাদের শাসন ব্যবস্থায় সম্ভবত সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অবমূল্যায়িত শব্দ হচ্ছে 'জবাবদিহিতা'। সরকারি কর্মকর্তারা আমাদের করের টাকায় বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। আমাদের পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলো জনগণকে দমন করার ক্ষমতা রাখে, অথচ এটা জিজ্ঞাসা করার অধিকার জনগণের নেই যে তারা আদৌ সৎভাবে ও আইন মেনে তাদের দায়িত্ব পালন করছে কি না।

প্রতিটি পেশা ও ক্ষেত্রে কিছু মানুষ সিস্টেমের বিরুদ্ধে গিয়েও নিজেদের সততা ও পেশাদারিত্ব ধরে রেখেছেন এবং আমরা তাদের অভিবাদন জানাই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেতর থেকে পুরোপুরি পচে গেছে।

রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনই একমাত্র কার্যকর উপায়। বলা যায়, অতীতে এটিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়নি। তবে প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতের পরিস্থিতি হবে ভিন্ন।

অন্তর্বর্তী সরকার সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কার কমিশন গঠন করায় প্রশংসার দাবি রাখে। চারটি কমিশন ইতোমধ্যেই তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে এবং বাকি দুটি কমিশন শিগগির প্রতিবেদন জমা দেবে। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটিও তাদের পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করেছে। এখন বাকি শুধু এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ, যে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা করেছেন।

সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুপারিশ ইতোমধ্যে জনগণের সামনে এসেছে। এখন এ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা প্রয়োজন এবং আমরা মনে করি সেটা অবিলম্বে শুরু করা উচিত।

যেসময় জাতীয় সংলাপ শুরু জরুরি, ঠিক তখনই 'সংস্কার বনাম নির্বাচন' বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই বিতর্ক এমন আকার ধারণ করেছে যে এটা বন্ধ হওয়া জরুরি। বিএনপি নির্বাচন আয়োজনে তাড়া দিতে আন্দোলন শুরু করলে তার পাল্টা আন্দোলনের সূত্রপাতও ঘটতে পারে। তেমন কিছু হলে আবারও উত্তপ্ত হবে রাজপথ। যখন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীলতার পথে, তখন এমন কিছু একেবারেই অযৌক্তিক ও অপ্রয়োজনীয়।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, 'যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষতা হারায়, তাহলে নতুন সরকার গঠন করে নির্বাচন পরিচালনা করতে হবে।' তার এই মন্তব্য আমাদের বিস্মিত করেছে। এ ক্ষেত্রে তিনি যেসব কারণ উল্লেখ করেছেন, সেগুলো বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কিন্তু, তার সিদ্ধান্ত যথেষ্ট সুচিন্তিত নয় বলে মনে হয়েছে।

পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে যখন মির্জা ফখরুলের মন্তব্যের জেরে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম প্রশ্ন তোলেন—বিএনপি কি পরোক্ষভাবে ১/১১ এর মতো সেনাসমর্থিত সরকার গঠনের দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আমরা মনে করি, তার এই মন্তব্য বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে এবং বিষয়টিকে দ্বন্দ্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। পারস্পরিক বোঝাপড়া আরও ভালো হওয়ার বদলে বিএনপির উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে, যা যুক্তিযুক্ত হয়নি। এতে করে কেবল ছাত্রদের সঙ্গে বিএনপির দূরত্বই বেড়েছে এবং উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের ভাষায় এটি 'কাম্য নয়'। ১/১১-র সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী দলটি বিএনপি। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বিএনপির কোনো সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাওয়ার কথা নয়।

গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সংস্কার প্রস্তাবগুলো এখন আমাদের হাতে। সবাইকে এগুলো নিয়ে গুরুত্ব সহকারে আলোচনা শুরুর আহ্বান জানাই। সংস্কার শুরু করা যেতে পারে পুলিশ বিভাগ দিয়ে, যে বিষয়ে ইতোমধ্যেই সবার সম্মতি আছে। আমরা চাই, পুলিশ শাসক দলের 'লাঠিয়াল বাহিনী' না হয়ে আইন ও ন্যায়বিচারের বাহক হয়ে উঠুক এবং তাদের এই পরিবর্তন হোক স্থায়ী। জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশের উচিত ন্যায়বিচারের প্রতিনিধিত্ব করা, নিপীড়নের নয়। পুলিশ সংস্কারের যে প্রস্তাবগুলো দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশই যথাযথ, প্রাসঙ্গিক ও জরুরি। সংস্কার প্রক্রিয়া পুলিশের মধ্য দিয়েই শুরু করা যেতে পারে এবং এই প্রক্রিয়া অন্যান্য বিষয়ে সংস্কারের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।

বিচার বিভাগের সংস্কার নিয়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদন এখনো প্রকাশ পায়নি। তবে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে যতটুকু জানা গেছে তার মধ্যে উচ্চ আদালতের বেঞ্চগুলোর বিকেন্দ্রীকরণের ধারণাটি অত্যন্ত সময়োপযোগী। 'বিলম্বিত বিচারে বিচারপ্রার্থীর বঞ্চনা'—এই প্রবচনটি রাজধানীর বাইরে বসবাসরত অধিকাংশ নাগরিকের জন্য নির্মম বাস্তবতা। ঢাকায় এসে মামলা পরিচালনার জন্য যাতায়াত, থাকা-খাওয়া, আইনজীবীর উচ্চ ফি—সবমিলিয়ে এত খরচের কারণে অনেকের কাছেই উচ্চ আদালত নাগালের বাইরে। যারা এই কঠিন পথ পেরিয়ে উচ্চ আদালতে আসেন, তারাও অপ্রয়োজনীয় ও আরোপিত বিলম্বের কারণে আইনের হাতের পুতুলে পরিণত হন। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো ৫ লাখ ৭৭ হাজার মামলার জট।

বিচারপতি নিয়োগ ও কাজের জবাবদিহিতা, আর্থিক স্বচ্ছতা, বিচার বিভাগ স্বতন্ত্র করার মতো বিষয়গুলো নিয়ে যে সুপারিশ করা হয়েছে, তা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। 'বৈষম্যবিরোধী নীতি' যদি কোথাও বাস্তবায়ন জরুরি হয়, তাহলে সেটা করতে হবে বিচার বিভাগে।

জনপ্রশাসন সংস্কারও অত্যন্ত জরুরি। আমাদের প্রশাসন কখনোই জনগণের সেবা করে না। বরং তারা সবসময় ক্ষমতাসীন দলের সেবায় নিয়োজিত থাকে এবং বলাই বাহুল্য, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। সত্‍ ও নীতিবান কর্মকর্তাও রয়েছেন, কিন্তু তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য। অধিকাংশ কর্মকর্তাই দুর্নীতিগ্রস্ত, অদক্ষ ও জবাবদিহিতার বাইরে। এই খাতে সংস্কার সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়বে। তাই জনপ্রশাসন সংস্কারে হতে হবে আরও দৃঢ় সংকল্প।

এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। অন্য সব বিষয়ের আগে ও দ্রুততম সময়ে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে।

পুরো সংস্কার প্রক্রিয়ার অতি ক্ষুদ্র অংশ এই উদাহরণগুলোই প্রমাণ করে যে, সংস্কার প্রস্তাবগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং কতটা আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে এগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি।

আমরা আগেও বলেছি, আমাদের হাতে প্রায় এক বছর সময় আছে। যদি এই সময় দক্ষতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজে লাগানো যায় এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে না জড়িয়ে কাজে মনোযোগী হওয়া যায়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত সময়সীমার মধ্যেই সংস্কার ও নির্বাচন দুটোই সম্ভব—যার জন্য সর্বস্তরে ঐকমত্য রয়েছে।

আমরা জানি, দ্রুত নির্বাচন হলে কেউ বাড়তি সুবিধা পাবে, আবার কেউ পাবে না। তবে রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় না রেখে জনগণের স্বার্থকে সবার ওপরে রাখতে হবে। গণতন্ত্র, সাম্য, সহনশীলতা ও উন্নয়নের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ গঠনের পথে এগিয়ে যাওয়ার এই সুযোগ কোনোভাবেই হাত ছাড়া করা যাবে না।

সবপক্ষের প্রতি আমাদের আহ্বান—বিতর্কে না জড়িয়ে সংস্কার ও নির্বাচনের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিন। এতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা পাবে। পারস্পরিক বিভেদ ভুলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে তারা দ্রুত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সংস্কার ও নির্বাচন আয়োজনের এই দ্বৈত লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে পারে।

মাহফুজ আনাম, সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English
changes in Bangladesh media industry

Allegiance shifts, so do faces at the helm

Bangladesh’s media industry has seen some major shake-ups, with more than two dozen outlets shuffling leadership positions following the July mass uprising last year.

17h ago