এই সময়ের বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতার তর্ক

বাকস্বাধীনতার প্রশ্নে একটি নতুন ভাবনা উসকে দিয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম। ১৬ নভেম্বর (শনিবার) দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে 'অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ: মুক্তচিন্তা ও বাকস্বাধীনতা' শীর্ষক আলোচনায় তিনি বলেন, 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অন্তরায় আমরা নিজেরাও। যখন আমরা ক্ষমতার বাইরে থাকি, তখন মতপ্রকাশ নিয়ে আমাদের অনেক আকাঙ্ক্ষা, অনেক দাবি থাকে। কিন্তু যখন আমরা ক্ষমতায় যাই, তখন আমরা আগের সেই আকাঙ্ক্ষাকে ধরে রাখতে পারি না।' মাহফুজ আনামের মতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হতে হবে তথ্যভিত্তিক।

এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের সুযোগ নেই যে, নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ছাড়া কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যে নতুন রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠান বিনির্মাণের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে গণতন্ত্র সুসংহত করার জন্য মত ও মুক্তচিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষার সব আইন এবং প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই।

বাস্তবতা হলো, নানাবিধ আইনি পরিকাঠামোর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রই নাগরিকের বাকস্বাধীনতার সুযোগ সীমিত ও সংকুচিত করে। যেমন: বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে নাগরিকের চিন্তা ও বিবেক এবং বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে সেটি শর্তসাপেক্ষ। যেমন: একজন নাগরিক এমন কিছু বলতে বা লিখতে পারবে না যাতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়; বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হয়; জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়; আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা দেয়। সংবিধান এগুলোকে বলছে 'যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ'। কিন্তু মুশকিল হলো, রাষ্ট্র এই যুক্তি ঠিক করে তার সুবিধামতো। কেননা আমাদের রাষ্ট্র, সরকার ও দল একাকার হয়ে যায়। যায় বলেই তারা নিজেদের ক্ষমতা আনচ্যালেঞ্জড রাখতে নাগরিকের কণ্ঠ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়।

সেজন্য ওই 'যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধের' দোহাই গিয়ে কখনো তথ্যপ্রযুক্তি আইন, কখনো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা কখনো সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে এবং কোনো নাগরিক ক্ষমতাকে প্রশ্ন করলে আইনের প্যাঁচে ফেলে তাকে জেলে নিয়ে যায়। সেখানে কারো কারো প্রাণও কেড়ে নেয়। অর্থাৎ রাষ্ট্র চায় তার নাগরিকরা শুধু প্রশংসা করবে, প্রশ্ন নয়। ফলে কথাটি 'যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ' নাকি ন্যায়সঙ্গত—সেই আলোচনাটিও এখন উঠছে। অর্থাৎ সংবিধান যদি বলে যে 'ন্যায়সঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হলো'—তাহলে রাষ্ট্র বা সরকার চাইলেই যেকোনো যুক্তি হাজির করতে পারবে না। তখন তাকে এমন কারণ দেখাতে হবে যেটি সরকারের জন্য ন্যায়সঙ্গত এবং একইসঙ্গে নাগরিকের জন্যও। যেখানে দেশ ও মানুষের স্বার্থই প্রধান। কিন্তু রাষ্ট্র অনেক সময়ই নাগরিকের ওপর এমন সব আইনি বিধান চাপিয়ে দেয় যেখানে জনকল্যাণের চেয়ে সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রশ্নটিই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।

ডেইলি স্টারে যেদিন এই আলোচনাটি হলো, সেদিনই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন, 'সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটি সমাজ গড়ার আওয়াজ তুলেছেন তরুণরা। সামনের বাংলাদেশ হবে ন্যায়বিচার, মানবাধিকার এবং বাক-স্বাধীনতার।'

প্রশ্ন হলো, বাক-স্বাধীনতা বলতে আমরা কী বুঝি এবং এর সীমারেখা কতটুকু? বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে পরমতসহিষ্ণুতা তথা অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধার বিষয়টি যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সেটি আমরা অনেক সময় খেয়াল করি না।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতে সংবিধান ও আইন একজন নাগরিককে যে সুরক্ষাই দিক না কেন, ব্যক্তি হিসেবে তিনি যদি আরেকজনের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে না পারেন; যদি মতপ্রকাশ বা বাকস্বাধীনতার নামে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করেন, সেটি খুব বিপজ্জনক। এই জায়গাটিতে এখনো বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে বলে মনে হয়।

এখনো অনেক ফেসবুক পোস্টের নিচে, বিশেষ করে সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ছাত্রজনতার আন্দোলন প্রসঙ্গে কেউ কিছু লিখলে তার নিচে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও প্রতিশোধ-পরায়ণমূলক মন্তব্য মন্তব্য চোখে পড়ে। তার মানে সবাই চায় দুনিয়ার সবাই তার মতো করে বলবে ও লিখবে। না হলেই সে প্রতিপক্ষ, শত্রু। অর্থাৎ প্রত্যেকে বাকস্বাধীনতা চায় শুধু নিজের জন্য; অন্যের জন্য নয়।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, নাগরিকের বাকস্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলের নেতারা ক্ষমতার বাইরে থাকতে যতটা সোচ্চার থাকেন, ক্ষমতায় গিয়ে তারাই ঠিক বিপরীত ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ক্ষমতার বাইরে থাকা অবস্থায় যে ধরনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে তারা উৎসাহ দেন ও প্রশংসা করেন, ক্ষমতায় গিয়ে সেই একই ধরনের সাংবাদিকতার জন্য তারা সাংবাদিকদের জেলে ঢুকাতে চান।

তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বিভিন্ন সময়ে বলেছেন যে, গণমাধ্যম এখন পুরোপুরি স্বাধীন। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন, অতীতের মতো কোনো সাংবাদিককে এখন রাষ্ট্রের কোনো বাহিনীর তরফে ফোন করে কোনো সংবাদ প্রকাশ বা প্রচারের জন্য জবাবদিহি চাওয়া হয় না বা ভয়-ভীতি দেখানো হয় না।

নাহিদ ইসলামের এই কথার সত্যতা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু তারপরও এই বাস্তবতাও অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, গণমাধ্যমগুলো এখনো নানারকম অজানা ভয় কিংবা জুজুর ভয় থেকে পুরোপুরি বের হতে পারেনি। পারেনি বলেই এখনো সেলফ সেন্সরশিপের বাতাবরণ রয়ে গেছে। আবার যারা এসব ভয় কাটিয়ে সরকার ও সরকারের অংশীদারদের জবাবদিহির মধ্যে রাখত, তাদের কাজকর্মের ক্রিটিক্যাল বিশ্লেষণ করতে চান, সমালোচনা করতে চান—তাদের অনেককে ওই লেখার জন্য ব্যক্তিগত পরিসরে 'আগের সরকারের দালাল' বলে চিহ্নিত করার প্রবণতাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগের সরকারের আমলে যেমন সরকারের সমালোচনা করলেই তাকে উন্নয়নবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বলার প্রবণতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল, সেই ট্যাগিংয়ের অপসংস্কৃতি থেকে দেশ বের হতে পেরেছে কি না সেটি বিরাট প্রশ্ন।

মাহফুজ আনাম বলছেন, 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হতে হবে তথ্যভিত্তিক।' এই কথার সঙ্গে কিছুটা ভিন্নমত প্রকাশ করা যায় এভাবে যে, একজন নাগরিক যখন কোনো ফ্যাক্ট বলবেন বা যেটির সংবাদমূল্য আছে, সেটি অবশ্যই তথ্যভিত্তিক হতে হবে। কিন্তু কেউ যদি সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে তার মতামত প্রকাশ করেন, সেখানে তথ্য সব সময় জরুরি নয়। যেমন: কোনো নাগরিক যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনকি পত্রিকার কলামেও যদি লেখেন যে, দেশে সমাজতান্ত্রিক শাসন চালু করা উচিত অথবা কেউ যদি বলেন বা লেখেন যে দেশে ইসলামি শাসন কায়েম হলেই মানুষের মুক্তি হবে—এটি তার ব্যক্তিগত মত। এখানে তথ্য খুব জরুরি নয়। এটি তার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি বা মতামত। কিন্তু একই ব্যক্তি যদি বাকস্বাধীনতার নামে এমন কিছু বলেন বা লেখেন যা বিভ্রান্তিকর, সত্য নয় বা অর্ধ সত্য এবং যে কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করা—সেটি নিশ্চয়ই বাকস্বাধীনতা নয়।

শুধু সংবাদের ক্ষেত্রে নয়, বরং সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো কিছু শেয়ার করা বা কারো স্ট্যাটাসে মন্তব্য করার বেলায়ও যদি এই নীতিটা মেনে চলা যায়, তাহলে তথ্যের নামে অপতথ্য, ভুলতথ্য, বিভ্রান্তি ও গুজব এড়ানো সম্ভব। কেউ একজন ফেসবুকে লিখলেন যে পাকিস্তান থেকে আসা জাহাজে অস্ত্র এসেছে, সঙ্গে সঙ্গে সেই কথাটি বিশ্বাস না করে যিনি এই দাবি করেছেন তার এই কথাটি তথ্যভিত্তিক কি না সেটি যাচাই করা দরকার অথবা যিনি এই তথ্য শেয়ার করলেন তাকেই প্রশ্নটা করা যে আপনার এই তথ্যের সপক্ষে প্রমাণ আছে কি না?

প্রশ্ন করার সংস্কৃতি গড়ে তোলা গেলে যারা সচেতনভাবে কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে তথ্যের নামে অপতথ্য ছড়াতে চান; যারা বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের নামে কোনো ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান, তারাও একসময় প্রশ্নের মুখে পড়বেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা অন্যকে হেয় করা, অসম্মানিত করা বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই যা খুশি লিখে দেন—তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা গেলে সেটি নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটা বড় অর্জন হবে বলে আশা করা যায়।

মনে রাখা দরকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক স্তম্ভ। তবে এই স্বাধীনতা তখনই কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হয় যখন তা তথ্যভিত্তিক ও দায়িত্বশীল হয়। তথ্যভিত্তিক মতপ্রকাশ বলতে বোঝায়, মতামত দেওয়ার আগে সঠিক তথ্য যাচাই করা, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করা এবং গুজব বা অসত্য তথ্যের প্রচার থেকে বিরত থাকা।

বলা হয়, ডিজিটাল দুনিয়ায় সত্যের চেয়ে মিথ্যা ও গুজব দ্রুত ছড়ায়। সুতরাং মতপ্রকাশ করার আগে তথ্যের সঠিকতা যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি। অন্যকে অসম্মান করা বা কাউকে আক্রমণ করার নাম বাকস্বাধীনতা নয়। বাকস্বাধীনতার প্রথম শর্তই হলো অন্যের স্বাধীনতা প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন।

গণতান্ত্রিক সমাজে অ্যাবসোলিউট স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। কেননা অ্যাবসোলিউট স্বাধীনতা সমাজে নৈরাজ্য তৈরি করে। মিথ্যা বা ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ে, যা সমাজে বিভ্রান্তিই সৃষ্টি করে না, বরং সামাজিক স্থিতিশীলতাও নষ্ট করে। সুতরাং শুধু তথ্য প্রকাশ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তথ্যের সঠিক বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপট তুলে ধরাও জরুরি।

বলা হয় বাকস্বাধীনতা হচ্ছে একটি কাণ্ডজ্ঞান। যেমন: কাউকে অভয় ও সুবিধা দেওয়ার পরেও তিনি আরেকজনের ব্যাপারে কোনো মিথ্যা বা খারাপ কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখবেন না—এটিই হচ্ছে নাগরিক হিসেবে তার দায়িত্ব। অর্থাৎ তিনি কী করবেন বা করবেন না, কী লিখবেন বা লিখবেন না—সেটি তার কাণ্ডজ্ঞানের নিক্তিতে পরিমাপ করা দরকার।

সৈয়দ শামসুল হক তার 'মার্জিনে মন্তব্য' বইতে লিখেছেন: 'আপনি কী লিখবেন সেটি যেমন জরুরি, তেমনি কী লিখবেন না সেটি আরও জরুরি।' এই সময়ের পৃথিবীতে, বিশেষ করে এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে অন্তত এই কথাটি মনে রাখলে বাকস্বাধীনতা নিয়ে আর কোনো উদ্বেগ থাকে না।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক

Comments

The Daily Star  | English

Has IMF experiment delivered?

Two years after Bangladesh turned to the International Monetary Fund (IMF) for a $4.7 billion bailout to address its worsening macroeconomic pressures, the nation stands at a crossroads.

9h ago