ভয়-জমিদার-তৈলতন্ত্র কি যাবে?

আওয়ামী লীগের আমলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১৫ মাস বিনা বিচারে কারাগারে ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। তার কারাবন্দি থাকার এক বছর পূরণ হওয়ার দিন ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি মানববন্ধন করেছিলেন। শিক্ষার্থীদের অনুরোধে সেই সময় মানববন্ধনে গিয়ে খাদিজার মুক্তির দাবি জানিয়েছিলাম। কাউকে দোষারোপ না করে, কারও সমালোচনা না করে শুধু বলেছিলাম, কারাগারের অভ্যন্তরে মেয়েটি হয়তো প্রচণ্ড মানসিক যন্ত্রণায় আছেন। যেকোনো সময় তিনি ভেঙে পড়তে পারেন। তার জীবন বিপন্ন হতে পারে। রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে বিনীত নিবেদন ছিল, অবিলম্বে খাদিজাকে মুক্তি দেওয়া হোক।

এর ফলস্বরূপ বিকেল নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে ফোন পেলাম। দায়িত্বপ্রাপ্ত তিনজন ব্যক্তি ফোন করে প্রশ্ন করলেন, কোন আমি ওই মানববন্ধনে গিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনো শিক্ষক সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি, আমি কেন গেলাম। পরে ফোন পেলাম একটি গোয়েন্দা সংস্থার ফিল্ড অফিসারের। তিনি খুব সম্মান দেখিয়েই কথা বললেন। কিন্তু তাতে প্রচ্ছন্ন হুমকিও ছিল।

একবার চিন্তা করে দেখুন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী নিবর্তনমূলক একটি আইনে কারাগারে, আর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০০ জনেরও বেশি শিক্ষকের একজনও সাহস পাননি তার মুক্তির নিরীহ একটি দাবি জানাতে। আর খুবই নিম্নকণ্ঠে অতি সাধারণ একটি দাবি জানানোর পরও আমাকে পড়তে হয়েছিল অসম্মানজনক প্রচ্ছন্ন হুমকির মুখে। আমি নিশ্চিত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত সংবেদনশীল-বিবেকবান শিক্ষক মন থেকে খাদিজার মুক্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু ভয়ের সংস্কৃতি আর প্রশাসনিক শাস্তি ও হেনস্তার ভয়ে তারা নিশ্চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছেন। পক্ষ নিতে পারেননি ন্যায়ের।

একবার চিন্তা করুন, কী নিদারুণ ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করতো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। আমার ধারণা বাংলাদেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। আর ঠিক একই কারণে জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বড় পরিসরে যোগ দিতে পারেননি। এই আন্দোলনে আলোকবর্তিকা হাতে যেসব শিক্ষকরা যুক্ত হয়েছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা। তারাই নীতিচর্চার মশালটি বহন করেছিলেন সারাদেশের শিক্ষকদের প্রতিনিধি হিসেবে।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেছি ২০১৬ সালে। শুরু থেকেই লক্ষ্য করেছি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা কতটা ক্ষমতাশালী। তাদের তোষণ, তোয়াজ করা কতটা আবশ্যক। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই আমিও এই কাঠামোর অংশ। কিন্তু একটা অস্বস্তি বরাবরই ছিল। আমি নিশ্চিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহভাগ শিক্ষকই এই নির্লজ্জ তেলবাজী অপছন্দ করেন। তারপরও অযোগ্যতা ঢাকতে, সুদৃষ্টি পেতে, কুদৃষ্টি থেকে নিস্তার পেতে অনেকেই তেলচর্চা করতেন। সত্যি বলতে কারও কিচ্ছু করার ছিল না।

সেই সময় আমার শুধু সাহিত্যিক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর 'তৈল' নামের একটি প্রবন্ধের কয়েকটি লাইন মনে হতো। ওই সমাজনিষ্ঠ প্রবন্ধের একটি অংশে তিনি লিখেছেন 'বাস্তবিক অর্থেই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবলমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে'। নিশ্চিতভাবেই এই পথে সিদ্ধিলাভের চর্চা ছিল জগন্নাথসহ দেশের ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। হয়তো কোথাও কম, কোথাও বেশি।

তৈল ও তোয়াজে তুষ্ট উপাচার্যরাও দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আচরণ করতেন জমিদারের মতো। তারা ক্যাম্পাসে চলতেন একটি বহর নিয়ে। প্রক্টরিয়াল টিমের শিক্ষকদের মনে হতো রীতিমতো দেহরক্ষক। আর সারাদিন চলতো ফুলেল শুভেচ্ছা গ্রহণ। যেসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্তরা ফুলের তোড়া গ্রহণ করতেন—তা রীতিমতো লজ্জার। উপাচার্য দায়িত্ব নিয়েছেন—ধারাবাহিক ফুলবরণ, উপাচার্যের জন্মদিন—ফুল দিয়ে বরণ, উপাচার্যের দায়িত্বের এক মাস—ফুল দিয়ে বরণ, উপাচার্যের দায়িত্বের এক বছর—ফুল দিয়ে বরণ, উপাচার্য সরকারদলীয় কোনো পকেট কমিটির দায়িত্ব পেয়েছেন—ফুল দিয়ে বরণ, আরও কত কী! ঠিক যেন মনে হতো জমিদারের দুয়ারে প্রজার অর্ঘ্য অর্পণ।

তবে সব উপাচার্যই যে এমন জমিদার মানসিকতাসম্পন্ন ছিলেন, তা ঠিক নয়। যেমন: জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম তার দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনেই নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাকে যাতে অযথা ফুলের তোড়ায় ডুবিয়ে ফেলা না হয়। কারও যদি কোনো উপহার দেওয়া আবশ্যক হয়, তা যেন বই হয়। পরে জানতে পেরেছিলাম, তার দপ্তরে উপাচার্যকে দেওয়া উপহারের এই বইগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পাঠানো হতো। যা ছিল ইতিবাচক চর্চা। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বরাতে আমরা দেখেছি, তারপরও অধ্যাপক সাদেকা হালিম প্রচুর ফুলের তোড়া গ্রহণ করেছেন বা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। এক্ষেত্রে মনে হয় শুধু একতরফা উপাচার্য ও অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের দোষ দেওয়াটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। আবার ফিরতে হয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কাছে। তিনি তৈল বন্দনায় লিখেছেন 'এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মানও ফেরে'।

যারা আসলে নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় তৈলতন্ত্রের চর্চা করেছেন, তাদেরই মানসিকতা ও আচরণের পরিবর্তন দরকার। অভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে তৈলতন্ত্র, ভয়তন্ত্র ও জমিদারতন্ত্রের অবসান হবে এই কামনা রইল।

আমিও যেহেতু একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, তাই তৈলতন্ত্র, জমিদারতন্ত্রের সংস্কৃতির অংশ আমিও। এই দোষে আমিও দোষী, এই পাপে আমিও পাপী। কিন্তু এরপরও এই নেতিবাচক ধারা থেকে নতুন শুরুর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্ত হোক, সেই কামনা রইল।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
yunus calls on youth to join politics

Yunus urges young people to engage more in politics

Yunus made the call when a group of young political activists from different political parties of Norway called on him at the state guest house Jamuna today

1h ago