আগে চাই সংস্কার, তারপর ভোটাধিকার

এবারও কি ছাত্র-জনতার বুকের তাজা রক্ত রোদে শুকিয়ে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র বেয়ে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হবে? সে চেষ্টাই করা হবে নিশ্চিত। ইতোমধ্যে সেই চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে—যার দোহাই হলো দ্রুত ভোটাধিকার।
শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে নেমে আসেন লাথো মানুষ। ৫ আগস্ট ২০২৪। ছবি: আনিসুর রহমান/স্টার

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমরা অনেক আন্দোলন করেছি এবং বেশ কয়েকবার বিজয়ের সূর্যোদয় দেখেছি।

প্রথমে আসি, এই 'আমরা' কারা? এই 'আমরা'কে মোটাদাগে ভাগ করলে দুটি অংশ বা শ্রেণী পাই।

প্রথম অংশ হচ্ছে সমাজের একেবারে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া দিনমজুর থেকে মধ্যবিত্ত পর্যন্ত মানুষ এবং তাদের উত্তরাধিকার—যারা নিজের ভাগ্যোন্নয়নে চেষ্টারত ছাত্র সমাজ। এক কথায় যারা 'ছাত্র-জনতা' নামে অভিহিত এবং জাতির প্রয়োজনে বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিতে সর্বাগ্রে যাদেরকে পাই।

দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে সমাজের বাকি অংশ—যারা সংখ্যায় কম কিন্তু সম্পদে, বিত্তে, বৈভবে অনেক এবং ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের অবস্থান। তারা দামী নীল রক্তের অধিকারী—যে রক্ত তারা সচরাচর বিলিয়ে দেওয়াকে সমীচীন মনে করেন না। তাদেরকে আমরা ক্ষমতাধর শ্রেণী হিসেবেই চিনি।

প্রথম অংশের ছাত্র-জনতা ৫২'র ভাষা আন্দোলনে বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়ে বিজয়ের সূর্যোদয় এনে দিয়েছিল, যা আজো জ্বলজ্বল করছে। ৫২'র পর স্বৈরাচার-দখলদারদের অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকে আবার ছাত্র-জনতা বুকের রক্ত ঢেলে দিতে তৈরি হলো।

রক্ত দেওয়ার প্রবল আকুতি উপেক্ষা করার পথ বন্ধ হয়ে গেলে উভয় অংশের মানুষ উপনীত হই এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বাংলার আকাশে পেলাম বিজয়ের নতুন সূর্য।

সেই সূর্যের আলো ছাত্র-জনতার জীবনে তেমন সুফল দিতে পারেনি। সামরিক শাসনে বাংলার আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল ৯০-এ। আবার প্রয়োজন হলো তাজা রক্তের। চিরায়ত নিয়মে সেই ছাত্র-জনতা ঢেলে দিলো বুকের রক্ত। আবার বিজয়, আবার একটা নতুন সূর্য, পেলাম গণতন্ত্র, পেলাম ভোটের অধিকার।

গণতন্ত্রের বৃক্ষ অঙ্কুরোদগমের মাত্র ১৫-১৬ বছর যেতে না যেতেই বিজয় সূর্যের আলোর অভাবে প্রায় মরতে মরতে বেঁচে গেলো। কিন্তু এই অভাগা জাতি পেলো মুখোশধারী গণতান্ত্রিক সরকার, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলাম স্বৈরাচারির আসল চেহারা।

অকার্যকর করে দিলো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সব প্রতিষ্ঠান, শুরু হলো ব্যাপক দুর্নীতি আর সগৌরবে চালানো হলো ভিন্নমত দমনের পাশবিক স্টিম রোলার। দমন-পীড়ন সইতে সইতে একসময় খাদের কিনারায় এসে আটকে গেল জাতি।

মুক্তির উপায়? আবারো লাগবে রক্ত। কে দেবে রক্ত?

আবার সামনে আসতে হলো সেই ছাত্র-জনতাকে। স্বৈরাচারের বন্দুকের সামনে পেতে দিতে হলো মুক্তির প্রতীক আবু সাঈদের মতো সাহসে ভরা অসংখ্য ছাত্র-জনতার বুক। খুলে দিল রক্তনদীর বাঁধ। পেলাম এক নতুন স্বাধীনতা, বিজয়ের নতুন সূর্য।

অতীতের বিজয়গুলোতে প্রথাগত ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদদের কিঞ্চিৎ অবদান থাকলেও এবারের রক্তিম বিজয়ে তাদের অবদান তো ছিলই না, বরং তাদেরই তৈরি রাষ্ট্রযন্ত্র নামক দানবের বিপরীতে করতে হয়েছে সংগ্রাম, দিতে হয়েছে রক্ত।

আসল কথায় আসা যাক।

এবারও কি ছাত্র-জনতার বুকের তাজা রক্ত রোদে শুকিয়ে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র বেয়ে বঙ্গোপসাগরে বিলীন হবে? সে চেষ্টাই করা হবে নিশ্চিত। ইতোমধ্যে সেই চেষ্টা শুরু হয়ে গেছে—যার দোহাই হলো দ্রুত ভোটাধিকার। ছাত্র-জনতার ত্যাগের অর্জন চলে যাবে ক্ষমতাধর শ্রেণীর হাতে, বিনিময়ে তারা পাবে গণতন্ত্রের আবরণে মোরা ভোটাধিকার।

সেজন্য ছাত্র-জনতার কাছে আমাদের প্রত্যাশা, ভোটাধিকারের আগে দরকার ভোটাধিকার হরণের বিচার, নিজের টাকায় কেনা বুলেটে ঝরানো রক্তের হিসাব, সীমাহীন দুর্নীতি আর ছাত্র-জনতা তথা আপামর জনগণের অর্থ লুণ্ঠনকারীদের মুখোশ উন্মোচন। রাষ্ট্রযন্ত্রের সব অকার্যকর প্রতিষ্ঠানগুলো ধুয়ে-মুছে করতে হবে ঝকঝকে পরিষ্কার, দিতে হবে কার্যকরী নতুন রূপ। এরপর বুঝে নিতে হবে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার।

কেন বারবার এই শ্রেণীর মানুষ বঞ্চিত হয়? এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের তাকাতে হবে নীতিনির্ধারকের দিকে। কারা তারা? তারা কি ছাত্র-জনতা তথা আপামর জনগণের প্রতিনিধি? মোটেই না। তারা নীল রক্তের অধিকারী। তারা বিজয়ের তরে বুকের রক্ত ঢেলে দেয় না, বরং ছাত্র-জনতার ঢেলে দেওয়া রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করে জোঁকের মতো ধীরে ধীরে শুষে খায়।

সুতরাং, সাধারণ ছাত্র-জনতার প্রতিনিধি দরকার নীতিনির্ধারকের আসনে, যারা কথা বলবে নিজের শ্রেণীর, আপামর জনগণের। তবেই আবু সাঈদদের আত্মা শান্তি পাবে, নতুবা না।

সেজন্য দরকার সংস্কারের, যাতে ত্যাগী শ্রেণীর প্রতিনিধিদের সুযোগ হয় স্ব-শ্রেণীর কল্যাণে নীতিগ্রহণ ও বাস্তবায়নের। জাতীয় সংসদ হচ্ছে সেই যন্ত্র, যা পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে এই ছাত্র-জনতার। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত এই সংসদের চালক হিসেবে ক্ষমতাধর শোষক শ্রেণীর প্রধান্যই আমরা দেখেছি—যারা হয় রাজনীতিবিদ থেকে ব্যবসায়ী, নতুবা ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ। আর দেখেছি তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম, যারা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি। এই শৃঙ্খল ভাঙতে হবে। আর এখনই সেটা করার উৎকৃষ্ট সময়।

পৃথিবীর অনেক দেশ আছে, যেখানে সংসদ সদস্যরা ব্যবসা করতে পারেন না। তারা অতি সাধারণ জীবনাচারে অভ্যস্ত। আর আমরা সংসদে যাই যাতে নিজের ব্যবসার অনুকূল নীতি প্রণয়ন করতে পারি, নিয়োগ বাণিজ্য আর সরকারের সঙ্গে ব্যবসার মাধ্যমে জনগণের টাকা ভাগাভাগি করে সম্পদের পাহাড় গড়তে পারি।

আবার আরেক শ্রেণী আছে যারা ব্যবসার নামে জনগণের পকেট হাতিয়ে সম্পদ গড়ে সেটা দিয়ে স্বৈরাচারদের মাথা কিনে নীতিনির্ধারণ করে আসনে বসেন আর ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে ভোগ-বিলাসের রাজত্ব কায়েম করেন। অপরদিকে আবু সাঈদ, নুর হোসেনদের হাত ধরে পায় গণতন্ত্র আর ভোটাধিকার।

এখনই সময়, এই তরুণ ছাত্র সমাজ আর সংগ্রামী জনতা সজাগ থেকে হত্যা, দুর্নীতির বিচার নিশ্চিত করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের মাধ্যমে নীতিনির্ধারক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করার পথ সুগম করার। তবেই দেশের জনগণ এত ত্যাগ, এত প্রাণ, এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন স্বাধীনতার সুফল পাবে। অন্যথায় এই বিজয় ম্লান হয়ে স্মৃতির পাতায় হারিয়ে যাবে, আর ছাত্র-জনতা অচিরেই গণতন্ত্র, ভোটাধিকারের ডালি হাতে নিয়ে ফেরি করে বেড়াবে, 'রক্ত লাগবে, রক্ত?' ঠিক যেভাবে আরেক বীর মুগ্ধ বলছিলেন, 'পানি লাগবে, পানি'।

ঢালী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী, এফসিএ

Comments

The Daily Star  | English

Post-August 5 politics: BNP, Jamaat drifting apart

The taunts and barbs leave little room for doubt that the 33-year-old ties have soured. Since the fall of Sheikh Hasina’s government on August 5, BNP and Jamaat-e-Islami leaders have differed in private and in public on various issues, including reforms and election timeframe.

7h ago