ভাবাদর্শিক ও নিপীড়ক কলকব্জা ভেঙে চুরমার

গীতিকার ইমতিয়াজ মাহমুদের দুটো লাইন বারবার মনে পড়ছে—'লেখা আছে হাতের রেখায়, জাহাজ ডুববে অহমিকায়'। শেষ পর্যন্ত তার কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। শেষ পর্যন্ত অহংবোধ থেকেই পরাজিত হলো শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ। ভাবা যায়, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য গলায় দড়ি দিয়ে টেনে ভূপাতিত করা হচ্ছে, ৩২ নম্বর পুড়ছে, পুড়ছে আওয়ামী সাম্রাজ্য!

একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে কাজ করার সময় ২০১২ সালে ভাষা-মতিনের (ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন) একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম প্রথম শহীদ মিনার নিয়ে। তিনি জানিয়েছিলেন, ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের পর কয়েকদিন ঢাকা শহর পাকিস্তানি শাসনমুক্ত ছিল। স্বাধীন ছিল। মেডিকেল চত্বরে রাতারাতি নির্মিত অস্থায়ী শহীদ বেদিতে নেমেছিল মানুষের স্রোত। বর্ধিত জুলাইয়ের ৩৪ তারিখে (৩ আগস্ট) শহীদ মিনারের জনসমুদ্র দেখে ভাষা-মতিনকে মনে পড়ল। তিনি বলেছিলেন, বাঙালির ভয় প্রথম ভেঙেছিল বায়ান্নর ফাল্গুনে। একটু দীর্ঘ বিরতিতে হলেও যে সাহস তারুণ্যকে সংক্রমিত করেছে বারবার। যে সাহস একগুঁয়ে, একনায়ক ও স্বৈরাচারকে চ্যালেঞ্জ করে বারবার তাগাদা দিয়েছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের বাংলাদেশের।

জুলাইয়ের বর্বর হত্যাকাণ্ড ও গণঅভ্যুত্থান রাষ্ট্রযন্ত্রে কী কী পরিবর্তন আনবে, তা হয়তো রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। কিন্তু এই নজিরবিহীন সহিংসতা ও প্রাণহানি স্কুল-কলেজ বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোজগতে যে বড় পরিবর্তন এনেছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। রাজাকার আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর যে হত্যা-নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন, বর্বর। আমার ধারণা অভ্যুত্থান শেষে একজন শিক্ষার্থী যখন ক্যাম্পাসে ফিরবেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মানুষ। তার মধ্যে বড় ধরনের এক পরিবর্তন ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে, যা নিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগের পক্ষে নয়।

যতদূর অনুভব করতে পেরেছি, জুলাই হত্যাকাণ্ডে শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিষ্ঠুর নীরবতা শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে নেননি। নেওয়ার কোনো কারণও নেই। এমনকি শ্রেণিকক্ষে তাদের সঙ্গে আমরা যে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করি, তা অনেকের কাছে প্রহসন ঠেকছে। দেবতার আসন থেকে ইতোমধ্যেই অনেক শিক্ষককেই তারা ছুড়ে ফেলেছেন। নীতিহীন, অনুভূতিহীন, অসংবেদনশীল আখ্যা দিয়ে অনেকক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করছেন। আকারে-ইঙ্গিতে আমাকেও অনেক শিক্ষার্থী টিপ্পনী কেটেছেন, কটাক্ষ করেছেন। আমি তাদের দোষ দেই না। হয়তো আমার কাছে তাদের প্রত্যাশাটা অনেক বেশি ছিল।

জুলাই হত্যাকাণ্ডের পর পরিবর্তন শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আসেনি। আমার ধারণা, নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগ, নির্বিচার হত্যাকাণ্ডে এক ধরনের বড় পরিবর্তন এসেছে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবাদর্শ প্রচারকারীদের মধ্যেও, যারা এক ধরনের সফট পাওয়ার হিসেবে সমাজে কাজ করে ক্ষমতাসীনদের মতাদর্শ প্রচার ও ক্ষমতা প্রলম্বিত করতেন। ফরাসি চিন্তক ও সমাজবিজ্ঞানী লুই আলথুসার যে বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস বা ভাবাদর্শিক কলকব্জা হিসেবে। লুই আলথুসারের মতে এই ভাবাদর্শিক কলকব্জার মধ্যে রয়েছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল, গণমাধ্যম, সংস্কৃতি ও পরিবার।

২০০৪ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা পর্যন্ত সমাজে এক শ্রেণির মানুষের ন্যায়সঙ্গত প্রতিবাদ আমি নিজে দেখেছি। তাদেরকে আদর্শ বুদ্ধিজীবী মনে করেছি। কিন্তু হায়! জুলাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তারা একদম নিশ্চুপ। রাষ্ট্রযন্ত্র এত বড় একটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে ফেলার পরও তাদের মুখ থেকে একটি শব্দও বের হয়নি। আর অর্বাচীন মন্তব্যে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।

এবার আসা যাক গণমাধ্যমের কথায়। আওয়ামী রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে বারবার বলা হয়েছে, সবকিছুর জন্য জামায়াত-শিবির দায়ী। কয়েকজন মন্ত্রীমশাই তো রীতিমতো কোরাস গেয়েছেন। কিন্তু দুনিয়ার কোনো গণমাধ্যম এই ন্যারেটিভ গ্রহণ করেনি। বরং সারাবিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যম শেখ হাসিনাকে 'স্বৈরাচার' 'নৃশংস একনায়ক' বলেছে, যা আওয়ামী ভাবাদর্শ প্রচারকারীরা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি। বাংলাদেশের মূলধারার জনপ্রিয় শিল্পীরাও বৃষ্টিতে ভিজে শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। বর্জন করেছেন আওয়ামী লীগের সিগনেচার সাংস্কৃতিক আয়োজন জয়বাংলা কনসার্ট। প্রতিবাদ জানিয়ে সংহতি প্রকাশ করেছেন জাতীয় ক্রিকেট দলের অনেক ক্রীড়াবিদও। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন সাকিব ও মাশরাফি।

সবারই জানা যে, আওয়ামী লীগের অন্যতম ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ছিলেন তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান ও মাশরাফি বিন মর্তুজা। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই এই ধরনের চর্চা আছে। তাদের দলে নেওয়ার লক্ষ্য তারুণ্যের জনসমর্থন। মনে পড়ে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় সাকিব শিক্ষার্থীদের বার্তা দিয়েছিলেন। একটু চিন্তা করে দেখুন, এই দুই জাতীয় ক্রিকেটারের আজ কী পরিণতি! হত্যা, গণগ্রেপ্তার ও নিষ্ঠুর নির্যাতনে মুখবন্ধ রেখে তারা এরইমধ্যে সমাজে প্রত্যাখ্যাত, ধিক্কৃত। যার মাধ্যমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। লুই আলথুসারের ভাষায় এটা আওয়ামী লীগের মতাদর্শগত কলকব্জা অকেজো হওয়ার চিহ্ন।

আমার মনে হয় জুলাইয়ের এই নির্বিচার হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগের ভাবাদর্শ প্রচারকারীদের শুধু অসাড়ই করে দেয়নি, অনেকটা বিপদেও ফেলে দিয়েছে। শেখ হাসিনার এমন পলায়নে তারা হতভম্ব, বিস্মিত। জুলাইয়ের জলজ্যান্ত হত্যাকাণ্ড ও নিষ্ঠুরতাকে পাশ কাটিয়ে তারা কীভাবে আগামীতে দলীয় ভাবাদর্শ প্রচার করবেন, কীভাবে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে অবস্থান নেবেন, সেটা এক বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। দিনে দিনে এই পরিস্থিতি তাদের জন্য নিশ্চিতভাবেই ভয়াবহ সংকট তৈরি করবে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, শেষ চেষ্টা হিসবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম ও গণজাগরণ মঞ্চকে সক্রিয় করার একটা চেষ্টা ছিল। এমনকি হেফাজতে ইসলামের একটি অংশকেও কাজে লাগানোর চেষ্টা ছিল। তা সফল হয়নি। তারুণ্যের তোপে সব উড়ে গেছে।

লুই আলথুসার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ভাবাদর্শিক কলকব্জার বাইরে আরেকটি উপাদানের কথা উল্লেখ করেছেন। সেটি হলো রিপ্রেসিভ স্টেট অ্যাপারেটাস বা নিপীড়নমূলক কলকব্জা। যার মধ্যে রয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, আদালত ও কারাগার। আওয়ামী লীগের ভাবাদর্শিক কলকব্জায় অসাড়তা আসার পর শেষ মুহূর্তের ভরসা হিসেবে শেখ হাসিনা এই অ্যাপারেটাসের ওপর বেশি নির্ভর করছে। যদিও এই অস্ত্র আগের মতো আর সক্রিয় ছিল না। নির্বিচার গণগ্রেপ্তার ও ব্লক রেইড দিতে দিতে ক্লান্ত বাহিনীগুলোর সদস্যরা শেষ দিকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন। কোথাও কোথাও ফুল বিনিময়, একসঙ্গে চা পান করছেন। যদিও সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়ে কিছু সংশয় ছিল। কিন্তু ভরসার বিষয় শেখ হাসিনার 'ফাঁদে' পা দেয়নি সেনাবাহিনী। শেখ হাসিনাকে প্রত্যাখ্যান করে তারা নিয়েছেন জনগণের পক্ষ।

শেখ হাসিনার পতনের পর আওয়ামী ভাবাদর্শ আবার কবে, কীভাবে এই দেশে প্রতিষ্ঠা হবে, সেটার জন্য ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তবে তার আগে হিসাব হতে হবে আওয়ামী লীগের লুটপাট, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্বিচার ছাত্রহত্যার মতো ঘৃণ্য অপরাধের। এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড আওয়ামী লীগের অস্তিত্বকে বিপন্ন করবে, সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

রাহাত মিনহাজ: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

6h ago