‘জনরায়’র মহিমায় ভারতে বিরোধীদলের পুনর্জন্ম

এই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর মোদির জৌলুস বড় আকারে কমেছে এবং বিপরীতে বিরোধীদল উজ্জীবিত হয়েছে। ছবি: রয়টার্স

ভারতের প্রতিষ্ঠাতা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর পর প্রথম নেতা হিসেবে টানা তৃতীয় মেয়াদে আগামী রোববার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। ভারতের জনগণ তাদের নেতা ও পার্লামেন্টের প্রতিনিধিদের বেছে নিয়েছেন। সেজন্য আমরা তাদের অভিনন্দন জানাই।

এই নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের দৃশ্যপটে ফিরে এসেছে জোট সরকার। বিজেপির একদলীয় আধিপত্যে ২০১৪ সালে এই ধারার অবসান ঘটেছিল। তবে, এবারের নির্বাচনে এককভাবে সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ২৭২টি আসন পায়নি দলটি। ফলে, তাদেরকে সরকার গঠনের জন্য জোটের অংশীদার বিহারের নীতীশ কুমার ও অন্ধ্রপ্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডুর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

ভারতীয় গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী এবং এই উপমহাদেশের জোট নির্ভর রাজনীতিতে অতি প্রত্যাশিতভাবেই নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডু ইতোমধ্যেই তাদের সমর্থনের বিনিময়ে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কারণ, তাদের সমর্থন ছাড়া নতুন সরকার গঠন করতে পারবেন না মোদি।

কলকাতার দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ একাধিক মন্ত্রণালয়সহ স্পিকার পদের দাবি নিয়ে দরকষাকষি করছে তেলেগু দেশম পার্টি।

এই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর মোদির জৌলুস বড় আকারে কমেছে এবং বিপরীতে বিরোধীদল উজ্জীবিত হয়েছে। দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে সাংবাদিক স্বপন দাশগুপ্তর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ভারতে হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারীদের মাঝে একটি বার্তা ঘুরছে, যেখানে লেখা রয়েছে—'ভারতীয় ভোটাররা এমন এক রায় দিয়েছেন, যা দীর্ঘদিন মনে রাখতে হবে। তারা বিজেপি ও তার মিত্রদের এমন এক জয় দিয়েছেন, যা পরাজয়ের মতো। তারা ইন্ডিয়া জোটকে এমন এক পরাজয় দিয়েছেন, যা জয়ের মতো।'

সার্বিকভাবে মোদির জয় খুবই চিত্তাকর্ষক। বিজেপি একাই ২৪০টি আসন জিতে নিয়েছে, যা বিরোধীদলগুলোর সমন্বিত আসনের চেয়েও বেশি এবং এককভাবে কংগ্রেসের জয়ী হওয়া ৯৯ আসনের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

এই পরিসংখ্যান দেখার পর প্রশ্ন আসতেই পারে যে তাহলে কেন বিজেপির জয়কে পরাজয়ের মতো লাগছে? কারণ, তারা তাদের সম্ভাব্য সাফল্যকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশ করেছে এবং ৫৪২ আসনের লোকসভায় ৪০০টিরও বেশি আসনে জিতবে বলে যে স্লোগান দিয়েছে, তাতে মিশে ছিল ঔদ্ধত্য ও অতি আত্মবিশ্বাসের নিদর্শন। এসব প্রকারান্তে তাদের এই সাফল্যকে পরাজয়ের মতো করে দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে এটা ছিল তাদের নিজের পায়ে কুড়াল মারার মতো কাজ।

যখন বিশ্বের অসংখ্য দেশে গণতন্ত্রের ক্ষয় হচ্ছে এবং তাদের নির্বাচনে নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করা হচ্ছে, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলের উদ্যোগে, তেমন একটি সময়ে এসেও ভারতের নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সর্বস্তরে গ্রহণযোগ্যতা এমন একটি অর্জন, যা প্রশংসার দাবিদার এবং সারা পৃথিবীর গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের কাছে উদযাপনের উপলক্ষ।

এই নির্বাচনে দেশটির ১৪০ কোটি নাগরিকের মধ্যে ৯৬ কোটি ৮০ লাখ ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত ছিলেন, যা মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ৬৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ এবারের নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩১ কোটি ২০ লাখ ছিলেন নারী। এটি মানব ইতিহাসে যেকোনো নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক নারীর অংশগ্রহণের রেকর্ড।

বিজয়ী হলেও ক্ষমতাসীন জোট এনডিএ নির্বাচনে জোর ধাক্কা খেয়েছে বললেও কম হবে এবং বিষয়টি ভারতের ভেতরে ও বাইরের সব নির্বাচন পর্যবেক্ষককেই বিস্মিত করেছে। নরেন্দ্র মোদি ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এবং বিজেপি একক দল হিসেবে তাদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে পারলেও বিরোধীদলের পুনর্জাগরণ—বিশেষত সেই পুরোনো ও প্রাচীন দল কংগ্রেসের, যাদেরকে অনেক বিশেষজ্ঞ বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিলেন—একটি কার্যকর গণতন্ত্রের জেগে ওঠার নিদর্শন, যা ভারত ও তার প্রতিবেশীদের জন্য কেবল সুফলই বয়ে আনতে পারে।

আমাদের বিবেচনায় সদ্য সমাপ্ত ভারতীয় নির্বাচনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো বিরোধীদলের পুনর্জন্ম। বস্তুত, একে পার্লামেন্টের 'পুনর্জন্ম'ও বলা যায়। কারণ, পার্লামেন্টটি একদলীয় আধিপত্যে হিমশিম খাচ্ছিল এবং যথাযথ বিরোধিতার অভাবে কার্যকারিতা হারাচ্ছিল। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় পার্লামেন্ট সব ধরনের জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে। এখানেই সব ধরনের জাতীয় ইস্যু নিয়ে বিতর্ক হয়, সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়, পুলিশের কাজের বিচার হয় এবং সম্পদ বণ্টনের পূর্ণাঙ্গ যাচাই-বাছাই হয়। যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, পার্লামেন্টে সরকারকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় যে জনগণই তাদের 'মালিক'।

বিজেপির আধিপত্যের কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পার্লামেন্টের এই কেন্দ্রীয় ভূমিকার ক্ষয় ভারতেও দৃশ্যমান হচ্ছিল—যা আমরা বাংলাদেশে দেখেছি। ভারতের নির্বাচনে ২৩৩ আসন পাওয়ার পর সুশাসন কাঠামোর ওপর বিরোধীদল কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবে বলেই প্রত্যাশা। এর গুরুত্ব বলে শেষ করা যাবে না।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকার ও সরকারের কার্যক্রমকে আরও বড় আকারে জবাবদিহির আওতায় আনা যাবে। নতুন যেকোনো আইন আরও বেশি নজরদারিতে থাকবে এবং সব বড় প্রকল্প ও ব্যয়বহুল কার্যক্রম আরও গভীরভাবে যাচাই-বাছাই করা হবে।

পার্লামেন্টে শক্তিশালী বিরোধীদল থাকলে প্রত্যেক আইনপ্রণেতাই নিজেকে আরও বেশি ক্ষমতাবান মনে করেন। যার প্রভাবে তারা সরকার ও সার্বিকভাবে প্রশাসনের কার্যক্রমে প্রশ্ন ছুড়ে দিতে পারেন—বিশেষত আমলাদের প্রতি, যাদের জনগণের সেবা করার মানসিকতা নেই বললেই চলে।

সরকারের ওপর নজরদারি ও তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে বিরোধীদলের কার্যকরী ভূমিকা ফিরিয়ে আনা আমাদের জন্য খুবই উল্লেখযোগ্য বিষয়। কারণ, আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি যে পার্লামেন্ট হচ্ছে সেই জায়গা, যেখানে জনগণের প্রতিনিধিরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সংসদে একটি দলের সর্বময় উপস্থিতি এবং প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে সংসদ, তথা স্পিকার ও সংসদ সদস্যদের শক্তিশালী ভূমিকাকে কার্যত বিলুপ্ত করেছে।

সমগ্র ভারতের নির্বাচনের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন বাংলাদেশিদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। বেশিরভাগ মানুষ ভেবেছিলেন যে গতবারের তুলনায় রাজ্যটিতে এবার বিজেপি ভালো করবে, এমনকি আসনও বেশি পাবে। কিন্তু এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, নির্বাচনী কৌশল ও উজ্জীবিত প্রচারণার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন জানানো উচিত। কারণ, তিনি এককভাবে হিন্দুত্ববাদের জোয়ারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দলীয় প্রার্থীদের জয় নিশ্চিত করেছেন।

ভারতের নির্বাচন থেকে আরেকটি উল্লেখযোগ্য উপলব্ধি হলো, ধর্মভিত্তিক নির্বাচনী প্রচারণার গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ১৯৪৭ সাল থেকে যে দেশে গণতন্ত্রের চর্চা অব্যাহত রয়েছে, সে দেশের ভোটারদের এমন প্রচারণার ক্ষতিকর প্রভাব বোঝার মতো জ্ঞান রয়েছে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সৎ সাহসও রয়েছে।

আমাদের কাছে—যাদের প্রতিটি নির্বাচন নিয়ে অন্তহীন বিতর্ক চলতে থাকে—ভারতের নির্বাচন একটি ঈর্ষণীয় বিষয়। কারণ, এখন পর্যন্ত দেশটির কেউই এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া বা এর ফলাফল নিয়ে কোনো ধরনের অভিযোগ তোলেনি।

সাত ধাপে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রতিটি ধাপের ফলাফল ভারতের নির্বাচন কমিশনের কাছে সংরক্ষিত ছিল এবং নির্বাচন শুরুর ৪৪ দিন পর সব প্রক্রিয়া শেষে এই ফলাফল তারা প্রকাশ করেছে। প্রায় ১০০ কোটি নিবন্ধিত ভোটারের এই নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে ইভিএমের মাধ্যমে। ভোটারদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে প্রতিটি ইভিএমে ছিল পেপার ট্রেইল। অথচ, আমাদের জনগণের বিশ্বাস অর্জনে ইভিএমের গ্রহণযোগ্য ব্যবহার এখনো সুদূর পরাহত। সর্বশেষ নির্বাচনের পরে এই বিশ্বাস আরও কমেছে।

ভারতের নতুন নেতৃত্বকে শুভেচ্ছা জানানোর পাশাপাশি আমরা এই বিশাল প্রতিবেশী দেশে গণতন্ত্রের বিজয়কেও উদযাপন করছি, যাদের সঙ্গে আমরা পারস্পরিক সুবিধার জন্য অংশীদারিত্ব তৈরি করেছি। ভারতের ভোটারদের রায় প্রকাশের পরপরই এই ফলাফল ও সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপলব্ধি সারা বিশ্ব, তথা এ অঞ্চলের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়, কারণ আমাদের ভোটাররাও ভারতের ভোটারদের মতো একই রকম ক্ষমতা প্রত্যাশা করেন।

ভারতের নির্বাচনে এটা প্রমাণিত যে পপুলিজমের রূপ, বিভক্তির রাজনীতির বিপদ ও ভোট পেতে ধর্ম ব্যবহারের ক্ষতি একজন বোধ-বুদ্ধিসম্পন্ন ভোটারের চোখ এড়ায় না। কারণ, এসব ব্যবহার করে সমর্থন আদায় করতে চাইলে শেষ পর্যন্ত তার চরম মূল্য সাধারণ মানুষকে দিতে হয় ঘৃণা আর একে অপরকে দূরে ঠেলে দিয়ে।

ভারতের নির্বাচন আরও একবার প্রমাণ করেছে যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকলে 'জনরায়' সবসময়ই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে। অপরদিকে, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দিলে তা গণতন্ত্রের ভিতকে ধ্বংস করে দেয়।

মাহফুজ আনাম: সম্পাদক ও প্রকাশক, দ্য ডেইলি স্টার

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান

Comments

The Daily Star  | English

Has IMF experiment delivered?

Two years after Bangladesh turned to the International Monetary Fund (IMF) for a $4.7 billion bailout to address its worsening macroeconomic pressures, the nation stands at a crossroads.

8h ago