ভারতের লোকসভা নির্বাচন

চাপে মোদি, উল্লসিত দিদি, জাগ্রত কংগ্রেস

ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনে সরকার গঠনের জন্য ৫৪৩ আসনের মধ্যে দরকার ২৭২টি আসন। সাত ধাপে ৪৪ দিন ধরে চলা এই নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি ও জোট এনডিএ জিতেছে ২৯৩ আসনে। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বহুদলীয় বিরোধী জোট 'ইন্ডিয়া' পেয়েছে ২৩৩ আসন। বিজেপি এককভাবে পেয়েছে ২৪০ আসন। জাতীয় কংগ্রেস ৯৯ আসন পেয়ে দ্বিতীয় দল হিসেবে স্থান পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন বটে, কিন্তু তার সেই একচ্ছত্র আধিপত্য আর থাকছে না। দল হিসেবে শুধু বিজেপি এককভাবে সরকার গঠন করতে পারছে না। জোটসঙ্গীদের ওপর ভরসা করেই তাকে সরকার গঠন করতে হবে।

যে মোদি-অমিত শাহ জুটি এবার ৪০০ আসন পাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাদের এই দুরবস্থা কেন? কেন তাদের দুর্গ বলে পরিচিত উত্তরপ্রদেশে তারা বিপর্যস্ত? সরকার গঠন করে প্রধানমন্ত্রী হলেও এবার তার বিরোধীরাও বিশাল সংখ্যক আসন নিয়ে সংসদে বসবেন বিপুল বিক্রমে। অবতার হয়ে যাওয়া মোদিকে সাধারণ রাজনীতিবিদের কাতারে নামিয়ে ফেলল ভোটাররা। কেন মোদির এই বেহাল দশা? কেন পশ্চিমবঙ্গে বিপুল বিক্রমে জেগে উঠল তৃণমূল কংগ্রেস? কেন পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা বিজেপিকে গতবারের চাইতে কম আসনের দিকে ঠেলে দিলো? বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেছেন শুভ কিবরিয়া।

চাপে মোদি

১. নরেন্দ্র মোদি একক নেতা হিসেবে তার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। ভারতজুড়ে তার বিকল্প কোনো মুখ সামনে আসতে ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনিই একক ও অপরিহার্য এই ভাবনায় নিজ দলের একাংশকে কোণঠাসা করেছেন। অনেক ত্যাগী ও প্রতিষ্ঠিত বিজেপি সংগঠককে রাজনীতি থেকে নির্বাসিতও করেছেন। দলে ও দেশে তার এই স্বেচ্ছাচার বিজেপির রাজনীতি তো বটেই, সাধারণ ভোটারদেরও অসন্তুষ্ট করেছে। সেটার প্রভাব পড়েছে এই নির্বাচনে।

২. হিন্দুত্ববাদী ভারত প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রয়াসে রামরাজ্য তৈরির যে উদ্যোগ তিনি বাস্তবায়িত করতে চেয়েছেন, তা কট্টরপন্থীদের সন্তুষ্ট করলেও দেশ-জাতিকে যে বিপন্ন করে তুলতে পারে, এই আশঙ্কা ভোটারদের বড় অংশকে প্রভাবিত করেছে। সেটার প্রভাব পড়েছে ভোটব্যাংকে।

৩. দেশে বেকারদের কর্মসংস্থান তৈরিতে তিনি বড় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেননি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও কমে নাই। মূল্যস্ফীতি মানুষকে নাকাল করছে। কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অসন্তুষ্ট। শুধু ধর্ম দিয়ে চিড়া ভেজাবার রাজনীতি পরাস্ত হয়েছে 'রুটি-মাকান-কাপড়া'র প্রয়োজনের কাছে। ব্যালটে তার প্রভাব পড়েছে।

৪. দুর্নীতি প্রতিরোধের নামে ভারতে তিনিই প্রথম প্রধানমন্ত্রী যিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের মতো ক্ষমতাসীন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেও জেলে পুরেছেন। বহু বাঘা বাঘা বিরোধী নেতাদের জেলে ঢুকিয়েছেন। রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথিত লড়াইয়ের নামে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে বিপন্ন করার নীতিকে মানুষ প্রতিহত করতে চেয়েছে ভোটের মাধ্যমে। প্রতিশোধ-পরায়ণ-হিংসাশ্রয়ী তার এই 'আয়রনম্যান' ইমেজ ভোটারদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি।

৫. বিজেপির সরকার দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। সরকারের সব এজেন্সিকে তারা নির্বাচনে ব্যবহার করার সুযোগ গ্রহণ করেছে। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় অভীপ্সায় ব্যবহারের এই প্রবণতা যে গণতন্ত্রকেও ধ্বংস করতে পারে, নির্বাচন ব্যবস্থাকে বিপন্ন করতে পারে, বিরোধী রাজনৈতিক দল বিশেষত কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীর এই আবেদনে ভোটারদের সচেতন অংশ সাড়া দিয়েছেন ব্যাপকভাবে।

৬. সরকারের দুর্নীতিবিরোধী সব তদন্ত সংস্থাকে (ইডি, সিবিআই, আয়কর বিভাগ ইত্যাদি) বিরোধী রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নরেন্দ্র মোদি ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছেন। সেটা বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে 'ইন্ডিয়া জোট' গঠনে বিশেষ মদদ দিয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধিতাকে কোণঠাসা করে তার একচ্ছত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ এই প্রয়াস ভোটারদের মনে আশা জাগিয়েছে। ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলন ঘটেছে।

৭. ক্ষমতাসীন বিজেপি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে বিপুল অর্থকে এই নির্বাচনে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশের মিডিয়াকেও নরেন্দ্র মোদি ও তার সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। মানুষ জনমিডিয়াকে 'গোদি মিডিয়া' নামে অভিহিত করতে শুরু করেছে। এই নিয়ন্ত্রণ মানুষকে ভীত করেছে। ফলে, জনভীতি ব্যালটে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

৮. বিজেপি দলীয় কর্মসূচিতে ধর্মকে ব্যবহার করছে। তারা রামরাজ্যের রাজনৈতিক তরজাকে কাজে লাগিয়ে নরেন্দ্র মোদিকেই নির্বাচনের মুখ করেছে। 'প্রার্থী নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেই ভোট দিন'—এটাই বিজেপির মুখ্য প্রচারণা ছিল। মোদিই স্থিতিশীল হিন্দু ভারতের প্রতীক—সেটাই বিজেপি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। মোদি নিজেও নিজেকে ঈশ্বরের প্রেরিত অবতার হিসেবেই পোট্রেট করেছেন। সংখ্যালঘু, প্রান্তিক ভোটাররা এই প্রবণতাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন ব্যালটে।

৯. ভারতে ৬০ বছরের কংগ্রেস শাসনের প্রগতিশীল রাজনীতি হিন্দুত্ববাদের নতুন ন্যারেটিভের কাছে পরাভূত, মোদির আমলে। হিন্দুরাষ্ট্র না উদার ভারত—সেটাই ছিল এই নির্বাচনের বড় এজেন্ডা। পার্টিজান নন এমন ভোটারদের বড় অংশ এই প্রবণতাকে রুখতে চেয়েছেন ব্যালটেই। সেটাও বিজেপির কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আনতে বাধা দিয়েছে।

১০. বিজেপিবিরোধী জোটবদ্ধতার আক্রমণকেও বিজেপি নানাভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। আঞ্চলিক স্বার্থ, অর্থ, পদলাভ ইত্যাদি বিবেচনায় ভারতব্যাপী বিজেপি যেখানে যেটা প্রযোজ্য সেখানে সেটাই প্রয়োগ করেছে। ফলে, অন্যদলের বহু নেতাকে তারা ভাগিয়ে এনেছে। বহুজনকে শিবির পরিবর্তন করতে তারা বাধ্য করেছে। কখনো ভয় দেখিয়ে, কখনো লোভ দেখিয়ে, কখনো আদর্শের কথা বলে, কখনো স্থিতিশীল ভারতের কথা বলে, কখনো রামরাজ্যের স্বপ্ন দেখিয়ে রাজনীতির এই 'মোদি-মডেল' মানুষকে আর বৃহৎভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনি।

১১. সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নানা কথা বলে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার বিষয়ে যে উদ্বিগ্নতা নরেন্দ্র মোদি সৃষ্টি করেছেন, তা ভোটের বাক্সে তার পক্ষে জনজোয়ার তৈরি করতে পারেনি।

১২. নিজ দলের ভেতর নরেন্দ্র মোদি তার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিজেপির চাইতেও নরেন্দ্র মোদির ইমেজ বড় করে তুলে তিনি রাজনীতি করেছেন ও সরকার চালিয়েছেন। তার এই স্বেচ্ছাচার দলের বহু অংশকেও হতাশ ও নিষ্ক্রিয় করেছে। সেটাও তার বিরুদ্ধে গেছে ব্যালটে।

১৩. ধর্মে, সংগঠনে, অর্থনীতিতে, সরকার পরিচালনায়, বিশ্ব ভাবমূর্তিতে নরেন্দ্র মোদিই শেষ ভরসা, ভারতের ভোটারদের সেটা জোর করে বোঝাতে চেয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। ঠিক এই জায়গাতেই ভিন্ন কথা বলেছে কংগ্রেসসহ অন্যান্য বিরোধী দল। ভোটাররা সেই কথায় মন দিয়েছে। ভোটের বাক্সে তার প্রভাব পড়েছে।

দিদির ম্যাজিক

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ২০১৩ সাল থেকে টানা তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় রাজনীতিতে উল্কাসম, আন্দোলনের মাঠ গরম করতে কীর্তিমান আঞ্চলিক রাজনীতি তো বটেই, কেন্দ্রীয় রাজনীতির এক আলোচিত চরিত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে লড়াই করেছে বিজেপি। বিধানসভার ভোটে পশ্চিমবঙ্গে মমতার একচ্ছত্র দাপট থাকলেও লোকসভায় ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৪২টির মধ্যে বিজেপি ১৮টি আসন পেয়ে সবাইকে চমকে দেয়। গতবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট ও আসন সংখ্যা তৃণমূলের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বাম ও কংগ্রেস জোটবদ্ধ হয়ে বিজেপি ও তৃণমূলের সঙ্গে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামে জোরেশোরেই। কেন্দ্রে তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস জোটবদ্ধভাবে বিজেপির বিরোধিতা করলেও পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এককভাবেই নির্বাচনে অংশ নেয়। মোদির নানারূপি চাপের মধ্যেই এককভাবে লোকসভা নির্বাচনে নেমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নতুন ম্যাজিক দেখিয়েছেন। অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙে পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনে ৪২টি আসনের মধ্যে ২৯টি আসনে জিতেছেন। এটা একটা রেকর্ড বিজয়। যেখানে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহরা বলেছিলেন তারা পশ্চিমবঙ্গে ৩০-৩৫টি আসন পাবেন, এবার ঘটেছে উল্টো ঘটনা। বিজেপির আগেরবারের ১৮টি আসন কমে হয়েছে ১২। ভোটের মার্জিনেও এবারের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির চাইতে বহু শতাংশ ভোট বেশি পেয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে—পশ্চিমবঙ্গে কী এমন ঘটল, যেখানে দিদিই সবাইকে টেক্কা দিলেন? বিজেপি কেন তার পুরোনো আসন সংখ্যা ধরে রাখতে পারল না? কারণ—

ক) সামাজিক নিরাপত্তা খাতে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস কন্যা-শ্রী, লক্ষ্মীভাণ্ডার ইত‍্যাদি সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে চার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছে, তাতে প্রান্তিক মানুষ দারুণভাবে উপকৃত হয়েছে। সেটা ভোটারদের দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে তৃণমূলের প্রতি।

খ) মোদি ও বিজেপির ধর্মীয় পোলারাইজেশনের রাজনীতি পশ্চিমবঙ্গে কাজ করে নাই। দিদির সম্প্রীতি ও সামাজিক বিনিয়োগের রাজনীতিকেই মানুষ গ্রহণ করেছে।

গ) পশ্চিমবঙ্গে এবারের লোকসভা নির্বাচনে নারী ভোটারের বাড়তি উপস্থিতির পুরো বেনিফিট পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। নারীরা ব্যাপকভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি আস্থা রেখেছে।

ঘ) বিজেপির নানারকম প্রচারণা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলমান ভোটাররা আরও বেশি করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর আস্থা রেখেছেন। ভারতের অন্যত্র কংগ্রেস, বামপন্থী, তৃণমূলসহ আঞ্চলিক দলগুলোর সমবায়ে গঠিত 'ইন্ডিয়া জোট' বিজেপির মোকাবিলা করলেও পশ্চিমবঙ্গে ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। এখানে সম্মিলিত বিরোধীদের 'ইন্ডিয়া জোট' ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে লড়তে ব্যর্থ হয়েছে। মমতা পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস ও বামফ্রন্টের সঙ্গে ঐক্য করতে রাজি হননি। এখানে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট যৌথভাবে নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছে। তারা ভাগ বসিয়েছে তৃণমূলের ভোটের। তারপরও সংখ্যালঘুদের সিংহভাগ ভোট পেয়েছেন মমতা। কট্টরপন্থী হিন্দুরা ক্ষমতায় এলে মুসলমানরা যে নিরাপদ নন, সেই ভাবনাটাকে সংখ্যালঘু ভোটারদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছে তৃণমূল সার্থকভাবেই।

ঙ) দুর্নীতি ও স্বৈরতন্ত্রের অভিযোগ সত্ত্বেও মমতা ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের একটা ভালো পার্টি ভোটব‍্যাংক তৈরি হয়েছে। মমতার লড়াকু ও প্রান্তিকমুখী রাজনীতি সেই ভোটব্যাংকের আস্থা বাড়িয়েছে। সব বিপদের দিনে চাপের মুখেও মমতা ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এই ভোটারদের পাশে থেকেছেন সম্প্রীতি ও প্রগতির কথা বলে। সেটা এই ভোটব্যাংককে অবিচল রেখেছে তৃণমূলের দিকে।

চ) পশ্চিমবঙ্গের উন্নতি করতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ ছাড় দেয় নাই, কেন্দ্র-রাজ‍্য বঞ্চনার বিষয়ে মমতা ব‍্যানার্জির এই দাবির প্রতি পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা আস্থা রেখেছেন। ফলে বঞ্চনার প্রতিশোধ নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা ব‍্যালটেই। কেন্দ্রবিরোধী মমতার আওয়াজে ভোটাররা বিজেপিকে প্রত্যাখ্যান করে তৃণমূলেই আস্থা রেখেছেন।

ছ) সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে, ইডি-সিবিআই-আয়কর বিভাগকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে কাবু করার পন্থা মোদি সরকার নিয়েছে বারংবার। তার শিকার হতে হয়েছে মমতা ব‍্যানার্জি ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসকেও। দুর্নীতি বিরোধী সব তদন্ত সংস্থা (ইডি, সিবিআই, আয়কর বিভাগ ইত্যাদি) পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের মন্ত্রী, নেতাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় থেকেছে বছরভর। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রভাবশালী নেতা দুর্নীতির অভিযোগে জেলও খাটছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের এই আচরণে বিরূপ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ভোটাররা। তার প্রভাব গেছে তৃণমূলের অনুকূলেই।

জ) হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে সম্প্রীতির পক্ষে আপামর জনতা এবং সংখ্যালঘু মুসলমানরা এককভাবে মমতার ওপরেই আস্থা রেখেছেন। ধর্মীয় বিভেদের রাজনীতিতে মমতাই প্রগতির আলো জিইয়ে রেখে প্রাণপণে লড়াইয়ে রয়েছেন বলে তার প্রতিদান দিয়েছে বাংলা।

ঝ) মমতা ও তার দলকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভোট দিয়েছে গত বিধানসভা নির্বাচনে একচ্ছত্রভাবে। রাজ্যের সরকার আছে মমতা ও তার দলের হাতে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের প্রিয়তা পায়নি। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন বিকশিত হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়নি। সেটা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটারদের প্রভাবিত করেছে।

কংগ্রেসের জাগরণ

কংগ্রেস রাজনীতিতে এবার নিজেকে রক্ষার জন্য ত্যাগী হওয়ার মনোবৃত্তি লালন করেছে। দেশের সবচাইতে বড় ও পুরোনো রাজনৈতিক দল হিসেবে নয়, মোদিকে খেদানোর মানসে, ছোট ছোট আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলার জন্য নির্বাচনে সর্বোচ্চ ছাড়ও দিয়েছে। ভোটারদেরও সেই কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছে। সেটা গত নির্বাচনের চাইতে অনেক বেশি আসনে এবার কংগ্রেসের বিজয়কে নিশ্চিত করেছে।

বিজেপি যখন বিভাজনের, হিংসার, ধর্মের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, কংগ্রেস তখন ধৈর্য্য ধরে 'হিংসার বাগানে ভালোবাসার ফুল ফোটাবার' কথা বলেছে। এটা ধীরে ধীরে দেশজুড়ে ভোটারদের অনেকের মনে আশা জাগিয়েছে। সেটার প্রতিফলন মিলেছে ব্যালটে।

রাহুল গান্ধী, প্রিয়াঙ্কা গান্ধী দেশজুড়ে জনসংযোগ করেছেন। তাদের এই জনসংযোগ মানুষকে ইন্দিরা গান্ধীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। সেটাও ভোটারদের অনেককে প্রভাবিত করেছে।

কংগ্রেসের সুস্থির ও ধীর রাজনীতি এবং রাজনীতির ব্যাকরণে মানুষের নিত্যদিনের সংকটের কথাকে অগ্রাধিকার দিয়ে তুলে ধরার প্রবণতা ভোটারদের মন কেড়েছে।

ফলে, জনরায়ে আবার জেগে উঠেছে কংগ্রেস নতুন উদ্যমে।

গণতন্ত্রের জন্য সুখবর

এই ফলাফল এটা প্রমাণ করে যে, ভারতে নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেনি। মানুষ ভোটের মাধ্যমে যে রায় দিতে চেয়েছে, ভারতের নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলো তার সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে। এবারের ফলাফলে সরকারের বিপক্ষে শক্ত ও কার্যকর বিরোধী শক্তি বিপুল পরিমাণে নির্বাচিত হওয়ায় সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এলেও বিজেপিকে এবার সমঝে চলতে হবে। শুধু ধর্মের কার্ড খেললেই হবে না, মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষার প্রতি আরও বেশি মনোযোগী হতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিয়মের বাইরে ব্যবহারের প্রবণতাও অনেকটা কমবে। ফলে, ভারতের গণতান্ত্রিক যাত্রাপথ এবার একটা ভারসাম্য ও স্বাভাবিক পথে চলার সুযোগ অনেক বেশি পরিমাণে পাবে।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments

The Daily Star  | English

Netanyahu now a wanted man

ICC issues arrest warrants for the Israeli PM, his former defence chief for war crimes and crimes against humanity; 66 more killed in Gaza

55m ago