দখল-দূষণ

নেত্রকোণার ‘নেত্র’ কই…?

‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম অবকাঠামোগত উন্নয়নের যে দর্শন, আঞ্চলিক ব্যবসার সঙ্গে সংযোগ, নেত্রকোণা সেই হাবের অংশীজন নয়। ফলে, তার পক্ষে ওই উন্নয়নযজ্ঞে শামিল হওয়া কঠিন।’
ছবি: লেখক

হাঁটতে হাঁটতে আবার নদীর পাশেই এসে হাজির হলাম। এই শহরের মজাই এটা। যেদিক দিয়েই হাঁটি না কেন, শেষে এসে কোনো না কোনোভাবে নদীর পাশেই পথ পেয়ে যাই। গোলকধাঁধার মতো নদী বেষ্টন করে আছে এই শহরকে। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, নদীটা ফলার মতো শহরের বুক চিরে শহরকে ফালিফালি করে রেখেছে।

অথবা ঘটনাটা হয়তো উল্টো। পথের প্রয়োজনে, জল-হাওয়ার প্রয়োজনে, বাণিজ্যের প্রয়োজনে মানুষই নদীর পাশে পাশে আবাস গড়ে তুলেছে। আমরা ছবিতে-সিনেমায় ভেনিস শহরকে যেমন দেখি, এই শহরটাকেও আমার তেমন মনে হয়।

সুশাসন থাকলে, মানুষের শক্তি থাকলে এমন প্রাকৃতিক নদীকে বাঁচিয়ে রেখে, তাকে জীবন্ত রেখে ভেনিসের মতো না হলেও, তার কাছাকাছি একটা নৈসর্গিক শহর গড়ে তোলা সম্ভব হতো।

এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটছি। যে এলাকায় এসে পৌঁছেছি, সেটা শহরতলী হলেও পৌরসভার মধ্যেই পড়ে। এই পৌরসভাটাও পুরনো। প্রায় ১৬৬ বছর বয়সী। এই এলাকার এক প্রবীণা আমাকে একদিন গল্পে গল্পে বললেন, কলকাতা পৌরসভা যখন তৈরি হয়, সেসময় এ দেশে যে ১৩টি পৌরসভা তৈরি হয়েছিল এটিও তার একটি।

তথ্য ঘেঁটে দেখেছি, সময়কালের হিসাবে এই গল্পটা পুরো মিথ্যেও নয়। যদিও বয়সী এই পৌরসভা চেহারায়, সামর্থ্যে, সম্ভাবনায়, শক্তিতে, অবয়বে একটি পোড়ো পৌরসভার চেহারাই বহন করছে সগৌরবে।

অবশ্য পৌরপিতার ছবি প্রদর্শনের মহড়া দেখলে উল্টো ভাবনা মনে আসবে। এই পৌরসভায় সবচেয়ে বেশি যা দেখা যায় তা হচ্ছে, বর্তমান পৌরপিতার ছবি। ঈদে, পূজায়, পার্বণে পৌরসভায় যেখানেই যা ঘটুক না কেন, সেখানে ব্যানারে-ফেস্টুনে-গেটে পৌরপিতার বিশাল বিশাল ফটোগ্রাফ থাকে। সেটা এই পৌরসভার সর্বত্রই চোখে পড়বে। সে হিসেবে আগন্তুক রূপে আমার কাছেও এই শহরে তিনিই সর্বোচ্চ চেনা মানুষ। তাকে না চিনে উপায় নেই।

এই শহরটার নাম নেত্রকোণা। নেত্রকোণা পৌরসভার আনুষ্ঠানিক পরিচয়ে লেখা আছে, এই পৌরসভা ১৮৮৭ সালে স্থাপিত হয়। ধীরে ধীরে ক্রমবিকাশ হয়ে পৌরসেবার চাহিদা বৃদ্ধি ও প্রাপ্তির সমন্বয় সাধনের উন্নতির ফলে নেত্রকোণা পৌরসভা ১৯৯৬ সালের ১০ অক্টোবর 'ক' শ্রেণীতে উন্নতি হয়। পৌরসভাটি মগড়া ও ধলাই নদীবেষ্টিত। বর্তমান আয়তন ২১.০২ বর্গকিলোমিটার।

২.

ভোরবেলা হাঁটতে বেরিয়ে নেত্রকোণা পৌরসভার যে এলাকায় এসে গেছি, দেখি সেখানকার বাড়িতে বাড়িতে পৌরসভার পরিচয়ে এলাকার ও বাড়ির পরিচিতি দেওয়া আছে। এসব পড়ে জানলাম, এই মহল্লার নাম 'মহেন্দ্রপুর'। এটা পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত।

দু-একটা বাড়ি পেরুতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। দেখি মহল্লার নাম লেখা 'মইনপুর'। বিষয়টা কৌতূহলী করে তুললো। এবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখলাম। নতুন হওয়া বাড়িগুলোর অনেকগুলোতেই লেখা 'মইনপুর'। মহেন্দ্রপুর মইনপুর হলো, নাকি মইনপুর মহেন্দ্রপুর হলো—সেটাই আমার জিজ্ঞাসা।

নেত্রকোণা পৌরসভার একটি মহল্লায় কিছু বাড়ির ঠিকানায় ওই এলাকার নাম ‘মহেন্দ্রপুর’ থাকলেও নতুন বাড়িগুলোতে লেখা ‘মইনপুর’। ছবি: লেখকের সৌজন্যে

এই ভোরবেলায় রাস্তায় লোকজনের চলাচল তেমন নেই। তবুও কিছু কিছু মানুষ জেগে উঠেছেন। তাদের অনেককেই জিজ্ঞেস করলাম। দুজন খুব মজার উত্তর দিলেন। বললেন, এই এলাকার নাম আসলে 'মইনপুর'। কিন্তু যখন সুন্দর করে আমরা উচ্চারণ করি তখন বলি 'মহেন্দ্রপুর'।

যারা এই কথা বললেন, তাদের ধর্ম-লেবাস মইনপুরের সঙ্গে মানানসই। হাঁটতে হাঁটতে এবার এমন একজনের সঙ্গে দেখা হলো, যিনি (এদিক ওদিক তাকিয়ে) জানালেন, এই এলাকার নাম মহেন্দ্রপুর। এখনও অনেক হিন্দু বসতি আছে এই এলাকায়। একসময় পুরোটাই হিন্দুদের আবাস ছিল। আমি মহল্লার নাম রূপান্তরের ইঙ্গিত টের পেলাম।

৩.

নেত্রকোণা জেলা শহর, পৌরসভার অবয়ব যত চিনছি ততই আমার কষ্টটা বাড়ছে। এই শহরের প্রধানতম সম্পদ নদী। এই শহর বেড়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে 'মগড়া' নদীকে ঘিরে। শহরকে সাপের মতো পেঁচিয়ে রেখেছে মগড়া নদী। তার দুপাশেই গড়ে উঠেছে আবাস। আবার নদীর বুক চিরে ছোট সেতু, পুল, সাঁকো, রেলসেতুর ভেতর দিয়ে আন্তসংযোগ একের সঙ্গে অন্যকে যুক্ত করে রেখেছে। ফলে একটা অসাধারণ যোগাযোগ সবার সঙ্গে সবার।

কিন্তু যে মগড়া নদী এই যোগাযোগ ঘটাচ্ছে, সবাই মিলে সেটাকেই দূষণ করছে, দখল করছে। পুরো শহরেই নদীর পাড় দখল করে গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত বাড়ি, ক্লাব, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, ঈদগাহ, উপাসনালয়সহ নানারকমের স্থাপনা।

নদীর পানির চেহারার দিকে তাকানো যায় না। সম্ভবত শহরের সব আবর্জনা, সুয়ারেজের শেষ আশ্রয় এই মগড়া নদী। অনেক জায়গাতেই নদীর পুরোটাই পানিশূন্য। কোনো কোনো জায়গায় কচুরিপানায় ভরপুর। দেখেশুনে মনে হয়, মগড়া নদী পরিচয়ের লজ্জা ঢাকতেই এগিয়ে এসেছে কচুরিপানাদল।

অথচ একসময় এই মগড়া নদীতীরেই গড়ে উঠেছিল পাট ব্যবসার কেন্দ্র। নেত্রকোণায় 'পাটপট্টি' তার স্বাক্ষর বহন করে। এখন অবশ্য সেই ঢালও নেই, তলোয়ারও নেই। শ্রীহীন 'পাটপট্টি' পুরনো দিনের স্মৃতিই বহন করে কেবল।

নেত্রকোণা শহরের যেকোনো সড়কেই দিনেরাতে সবসময় দেখা মিলবে গতিবান বালুর ট্রাক। এখানকার বালুমহালের বালুর যোগান চলে দেশের বহু-জায়গায়। নেত্রকোণার দুর্গাপুরের চিনা মটি, কাকর মাটি, নুড়িপাথর, কয়লা, সাদামাটি (হোয়াইট ক্লে), সিল্কী বালুর মতো প্রাকৃতিক সম্পদ খুবই মূল্যবান।

ফলে, সেসব দখল-দূষণে চলে ক্ষমতাবানদের শক্তিমত্তার প্রতিযোগিতা। কখনো আইনের বলে, কখনো আইনের ফাঁক গলে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ নিয়ে চলে নানারকম হরিলুট। সেই চর্যাপদের কবিতার মতো, নেত্রকোণার সম্পদের অবস্থা হয়েছে, 'হরিণা মাংসে আপনা বৈরি' দশা। নেত্রকোণার সম্পদই তার হন্তারক হয়ে উঠেছে।

৪.

মানুষ বাড়ছে। সমাজেও রূপান্তর ঘটছে। ধর্মের পরিচয়ে, অর্থের পরিচয়ে, রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিচয়ে সেই রূপান্তর পরিচিত হচ্ছে। কখনো কখনো এই রূপান্তরে একধরণের সামাজিক দখল ও দূষণের চাপও থাকছে।

নেত্রকোণাকে মন্দির ও মসজিদের শহর বললে ভুল হবে না। একটা বড় সাংস্কৃতিক আবহের স্মৃতিচিহ্ন এখনো সুস্পষ্ট। বহু পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে এই জেলায়। এখানে মোহনগঞ্জ উপজেলা পর্যন্ত রেল যোগাযোগ আছে। কিন্তু অবাক করার বিষয়, গত দেড় দশকে সারা দেশের রেলের অবকাঠামোগত যে উন্নয়ন ঘটেছে, সেটা এখানকার রেললাইনের অবস্থা দেখলে বোঝা যায় না।

এখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ এসেছে নব্বইয়ের দশকে। কিন্তু কোনো শিল্পকারখানা গড়ে ওঠেনি। কৃষি ও মৎস্য সম্পদই ভরসা। নেত্রকোণায় অনেক ক্ষমতাবান মানুষের জন্ম হয়েছে। বহু খ্যাতিমান সামরিক-বেসামরিক-বিচারিক আমলার আদিবাস নেত্রকোণা। সারা দেশে তাদের ক্ষমতার উত্তাপ টের পাওয়া গেলেও নেত্রকোণার উন্নয়নে সেটার কার্যকর কোনো দেখা মেলেনি।

এখানকার এক অভিজ্ঞ মানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, নেত্রকোণা এতো অবহেলিত কেন? উত্তরটা খুব মজার দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এখানকার মানুষের দুই পা। একপা ময়মনসিংহে। আরেক পা ঢাকায়। যারা একটু দুর্বল, তারা ময়মনসিংহকেই সবকিছুর ঠিকানা বানিয়েছেন। আর যারা সবল, তারা ঢাকায় আসন গেড়ে, নেত্রকোণা থেকে চোখ ফিরিয়েছেন। তাদের চোখ ইউরোপ-আমেরিকায়।

আরেকজন উন্নয়ন গবেষক অবশ্য ভিন্ন কথা বলেছিলেন। নেত্রকোণার ভৌগলিক অবস্থান এক কোনায়। এর ভেতর দিয়ে অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে 'ডেড এন্ড' অবস্থা। এরকম জেলা যেগুলো—মেহেরপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ইত্যাদির মতো—সেগুলোর উন্নয়নে প্রতিবেশগত চ্যালেঞ্জ আছে। ফলে তার শিকার তাদের হতে হয়।

বলা ভালো, বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম অবকাঠামোগত উন্নয়নের যে দর্শন, আঞ্চলিক ব্যবসার সঙ্গে সংযোগ, নেত্রকোণা সেই হাবের অংশীজন নয়। ফলে, তার পক্ষে ওই উন্নয়নযজ্ঞে শামিল হওয়া কঠিন।

কিন্তু নেত্রকোণার যে সম্পদ আছে, জল-জলা-নদী-হাওর-খনিজ সম্পদ-অবারিত প্রকৃতি, সেটাই তাকে নতুনরূপে তুলে ধরতে পারে। এই অপরূপ সৌন্দর্যভূমি হতে পারে অসাধারণ পর্যটনকেন্দ্র। এখানে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর যে বৈচিত্র্য ও বহুমুখীনতা আছে, তা বাংলাদেশের বহু জেলাতেই অনুপস্থিত। সেসব সম্পদ কাজে লাগানো যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, দখল-দূষণের হাত থেকে এ শহরকে, এই শহরের নদী, জল-জলাভূমি, হাওরকে রক্ষা করা দরকার। শুধু নেত্রকোণার 'নেত্র' ফেরাতেই নয়, বাংলাদেশকেও প্রাকৃতিক বিপর্যয়-জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে এসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

নদী বেষ্টন করে থাকা শহরকে দখল-দূষণে খুন করলে, সেখানকার সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশেও তার প্রভাব পড়ে। সেখানেও দূষণের কালিমা বাড়তে থাকে। মানুষের মনে তার প্রভাব পড়ে। মানুষ আত্মপর, স্বার্থপর, প্রতিশোধপরায়ন, আক্রমণাত্মক, বিবেকহীন, প্রতিহিংসাপরায়ন, বিকৃতমনা হয়ে পড়ে। তখন 'মহেন্দ্রপুর'কে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে 'মইনপুর' বানাতে তার সামান্যতম দ্বিধাও থাকে না। বরং এতে সে নির্মূল আকাঙ্ক্ষী একধরণের বিজয়ের বিকৃত আনন্দই পায়।

শুভ কিবরিয়া: সিনিয়র সাংবাদিক, প্রকৌশলী

Comments