ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিশোধ ও পশ্চিমা দ্বিচারিতা

গত বছর ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা করলে পশ্চিমা বিশ্বে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। হামাসের এই হামলার পর আত্মরক্ষার নামে মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তির মদদে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

কিন্তু ইসরায়েল যখন ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে হামলা করে সাত কর্মকর্তাকে হত্যা করে, তখন পশ্চিমা শক্তি ছিল নীরব। নিহতদের মধ্যে ইরানের এলিট ফোর্স কুদসের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি ও তার সহযোগী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি-রহিমিও ছিলেন।

এই হত্যাকাণ্ডের পর ইরানও ঘোষণা দেয় যে তারা এর প্রতিশোধ নেবে। তারই অংশ হিসেবে ১৩ এপ্রিল ইরান ইসরায়েলে শত শত ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে প্রতিশোধ জানান দেয়।

ইরানের এই আক্রমণ কি অনিবার্য ছিল? অবস্থা দৃষ্টে মনে হয়েছে, ইরানের এই আক্রমণ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না। ইরানের কনস্যুলেটে হামলার ঘটনার ১৩ দিনেও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ এই ঘটনার নিন্দা প্রস্তাব নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ৪ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। এর মাধ্যমেই পশ্চিমা শক্তি ইরানের ইসরায়েলে আক্রমণকে আইনি বৈধতা দেয়।

১৩ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলে ইরানের হামলার নিন্দা করেছে, তেহরানকে আগ্রাসী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কিন্তু পশ্চিমা শক্তি কোনোভাবেই যে আলোচনাকে সামনে আনেনি সেটা হচ্ছে, ইরানেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে। তারা কেবল ইসরায়েলের আত্মরক্ষাকে সমর্থন করছে।

শুধু সমর্থনই নয় অস্ত্র, অর্থসহ সব মদদ দিচ্ছে। কিন্তু একই কারণে তারা ইরানের আত্মরক্ষার বিরোধিতা করছে। দেশটিকে আগ্রাসী শক্তি বলছে। এগুলোই হচ্ছে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের দ্বিচারিতা।

সিরিয়ায় ইরানের কূটনৈতিক স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলের বোমা হামলা আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, অন্য কোনো দেশে অবস্থিত কনস্যুলেটগুলো স্ব স্ব দেশের অন্তর্গত সার্বভৌম অঞ্চল। সুতরাং কোনো দেশের সার্বভৌম অঞ্চলে হামলা-আক্রমণ জাতিসংঘ সনদ ৫১ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন।

জাতিসংঘ ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এই বিষয়ে কোনো ধরণের বোঝাপড়ার সুযোগ তৈরি করেনি, বরং বাধাগ্রস্ত করেছে। এই বাধা প্রদানের মাধ্যমে তারা ইরানের পাল্টা আক্রমণের বিষয়টিকে অনিবার্য করে তুলেছে। সেই যুক্তিতে এটা ছিল ইরানের আত্মরক্ষার আইনি অধিকার। পশ্চিমা শক্তিই তাদের বাধ্য করেছে সেই পথে হাঁটতে।

গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর থেকেই ইরান ও ইসরায়েলের সম্পর্ক ক্রমেই খারাপের দিক যাচ্ছিল। ইরান এক কঠিন সময় পার করছিল। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলের ভয়াবহ আগ্রাসী তৎপরতা আরব বিশ্বকে বিব্রত ও অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু প্রভাবশালী দেশ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও উঠতি শক্তি ইরান তাদের ক্রোধ, ক্ষোভ ও হুমকির কথা গোপন করেনি, প্রকাশ্যেই বলেছে।

জিওপলিটিক্যাল ইকোনমির এক অনলাইন পোস্টে খ্যাতিমান থিংক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউস নিবন্ধ প্রকাশ করেন, যেখানে বলা হয় যে ইসরায়েলের দামেস্কে ইরানের দূতাবাসে হামলা একটি নজিরবিহীন ঘটনা।

তিনি আরও বলেন, ১ এপ্রিলের হামলা ছিল স্পষ্টত সংঘাতের মাধ্যমে সরাসরি 'ইরানের নেতৃত্বকে নির্মূল করা'র মিশন। সেটাই যদি হয়, তাহলে আত্মরক্ষার বিষয়টি ইরানের জন্য অনিবার্যই ছিল। এই ঘটনায় ইরানের আক্রমণের বৈধ অধিকারের যারা নিন্দা-সমালোচনা করছেন, তারা প্রকারান্তরে ইসরায়েলকে সমর্থনের মাধ্যমে নিজেদেরও অপরাধী করছেন।

১২ এপ্রিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরানকে ইসরায়েলে হামলা না করার জন্য সতর্ক করেন। এই ঘটনার পর ইরাকের উপপ্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী তামিমের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বৈঠকে বলেন, তারা ইরানের সঙ্গে কোনো ধরনের শত্রুতা বাড়াতে চায় না। তবে ইসরায়েলে ইরান হামলা চালালে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে রক্ষা করবে। তিনি বলেন, 'আমরা উত্তেজনা চাই না, তবে আমরা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা এবং এই অঞ্চলে আমাদের কর্মীদের সুরক্ষায় সমর্থন অব্যাহত রাখব।'

ইরান বলছে, তারা সিরিয়ায় তাদের দূতাবাসে হামলা করে শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করার প্রেক্ষাপটে এই হামলা করেছে। সে জন্য তারা ১৩ দিন সময় নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত হামলাকারী দেশ তাদের দায় স্বীকার করেনি।

আবার এই হামলার জন্য পশ্চিমা শক্তি ও জাতিসংঘ কোনো নিন্দাও জ্ঞাপন করেনি। অথচ যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ইরান যদি ইসরায়েলে হামলা করে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে থাকা তাদের কর্মীদের রক্ষায় সম্ভাব্য সবকিছু করবে। মানে ইসরায়েলকে মদদ যোগাবে। ইসরায়েলের অন্যায় আক্রমণকে বৈধতা দিয়ে তারা ইরানের হামলাকে অন্যায় বলছে, কিন্তু তেহরানের আত্মরক্ষার বিষয়টিকে উল্লেখ করছে না। এটাই হচ্ছে মার্কিনিদের মেরে ও কেঁদে জেতার কূটকৌশল।

এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৩ এপ্রিল ইরানের হামলার সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সামরিক বাহিনী ইসরায়েলকে সরাসরি সহায়তা করেছে। জর্ডানের সামরিক বাহিনীও ইসরায়েলের সমর্থনে সক্রিয় ছিল। তারা সম্মিলিতভাবে ইরানের ড্রোনগুলোকে ধ্বংস করতে সহায়তা করেছে।

মধ্যপ্রাচ্য মূলত একটি আঞ্চলিক যুদ্ধের মুখোমুখি হচ্ছে। ক্রমশ যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ফিলিস্তিন, ইসরায়েল, ইরান, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন ও ইয়েমেনে। ইরাকের ইরান সমর্থিত সরকার ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের চাপ দিচ্ছে। ইরাকের উপপ্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার উদ্বিগ্ন যে এ অঞ্চলকে 'একটি বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে, যা আন্তর্জাতিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে'।

ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেশটির সেনাপ্রধান মোহাম্মাদ বাঘেরি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, 'আমাদের সামরিক উদ্যোগে যদি ইসরায়েল প্রতিশোধ নেয়, তাহলে আজকের রাতের চেয়েও ভয়াবহ হামলা চালানো হবে।' বাঘেরি আরও উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি ইসরায়েলের প্রতিশোধ গ্রহণের অংশীদার হয়, তাহলে ইরান মধ্যপ্রাচ্যের মার্কিন সামরিক ঘাটিতে হামলা চালাবে। যুক্তরাষ্ট্র  ইতোমধ্যে ইসরায়েলকে জানিয়ে দিয়েছে, তারা এই যুদ্ধে জড়াবে না।

তবে, ইরানের হামলার জবাবে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রীসভা পাল্টা হামলার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। যদিও কখন সেই হামলা করা হবে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে বাইডেন ইসরায়েলকে সতর্ক ও কৌশলী ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন রণতরীর বিপরীতে ভূমধ্যসাগরে মিসাইল সজ্জিত রুশ সুপারসনিক যুদ্ধ জাহাজ অবস্থান নিয়েছে।

ইরান ইসরায়েলে হামলার পর নেতানিয়াহু দ্রুত জাতিসংঘের বৈঠকের আহ্বান করেছেন। যদিও তারাই জাতিসংঘের কোনো সিদ্ধান্ত ও কথাতেই কর্ণপাত করছে না। পরিস্থিতি হয়েছে, বিপদে পড়লে জাতিসংঘ, সুবিধায় থাকলে অবজ্ঞা।

ইরানের এই হামলার বিষয়টিকে নিয়ে তারা মনে করছে, গাজার গণহত্যা ও বর্বরতায় ইসরায়েল যে কোণঠাসা হয়ে ছিল, ইরানের এই আক্রমণ তাদের কিছুটা সুবিধা করে দিয়েছে। মানুষের মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে গেছে। গাজার যুদ্ধ বিরতির আলোচনা অনেকটা ম্লান করে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা কি আসলে তাই?

পশ্চিমা পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা এই প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসছেন যে, ইরানের এই হামলা কি ফিলিস্তিনিদের সুবিধা করে দিল, না চাপের মধ্যে ফেললো? তারা বলার চেষ্টা করছেন, গাজায় ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যায় তাদের পক্ষে যে বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছিল, তা তাদের বিপক্ষে চলে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এটা হচ্ছে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমের এক চতুর কৌশল। কেননা, বিষয়টি ইরানের কূটনৈতিক অঞ্চলে হামলা, হত্যা ও আত্মরক্ষার। এই ঘটনা মূলত ইরান ও ইসরায়েলের সামরিক সক্ষমতা ও বোঝাপড়ার বিষয়। সেখানে এই প্রশ্নকে প্রধান করা ইসরায়েলের ঔদ্ধত্য ও অপরাধকে প্রশ্রয় ও বৈধতা দেওয়ার সামিল।

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

Comments

The Daily Star  | English
Banking sector crisis

Why is the banking sector crisis so deep-rooted?

The regime-sponsored immorality to protect or pamper the financial gangsters not only eroded the future of the banking sector, but also made the wound too difficult to recover from.

4h ago