‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য’

ছবি: জীবন আহমেদ

এবারের ঈদে এক নারী পুলিশ সদস্যের ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে দেখা গেছে মেহেদি রাঙানো সতর্ক ও দৃঢ় হাতে তিনি ধরে রেখেছেন শটগানের ব্যারেল।

ছবিটি তুলেছেন একটি জাতীয় দৈনিকের ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ।

ফটোগ্রাফার জীবন ঈদের দিন সকাল ১০টায় তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ওই ছবি পোস্ট করেন। এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৭ হাজার বার শেয়ার হয়েছে ছবিটি, প্রায় সাড়ে ৫০০ মানুষ এতে মন্তব্য করেছেন এবং ১৭ হাজারের বেশি মানুষ ছবিটিতে বিভিন্ন রিঅ্যাকশন জানিয়েছেন।

ছবির ক্যাপশনে লিখা ছিল 'ঈদ মোবারক' এবং জাতীয় ঈদগাহ ময়দান ট্যাগ করা ছিল।

পুলিশের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্তা ছবিটি শেয়ার করেছেন। ছবিটি পুলিশের কর্ম উদ্দীপনার প্রতীকে রূপ নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন-ছবিটি সাধারণ মানুষ কেন এত পছন্দ করল? কেন ছবিটি মানুষের মন জয় করে নিল?

প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো নারী পুলিশ সদস্য বন্দুক হাতে তার দায়িত্ব পালন করছেন, এটা দুর্লভ কোনো ছবি নয়। গ্রাম, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, জেলা বা মহানগরের এমন চিত্র প্রায়ই দেখা যায়। তাহলে এই ছবির গুরুত্ব কোথায়?

ফটোগ্রাফার জীবনের ওই ছবির পোস্টে একটি মন্তব্য দেখা গেছে, 'মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য' (কাজী নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার একটি লাইন)।

ফটোগ্রাফারকে উদ্দেশ্য করে একজন লিখেছেন, 'এটা কোনো সাধারণ ছবি না। এটা পুলিশের জীবনের করুণ কাহিনী।'

কেউ লিখেছেন, 'উৎসব সবার, কর্তব্য পুলিশের।'

কেউবা আবার লিখেছেন, 'খুব পাওয়ারফুল ছবি।'

কেউ বলেছেন, 'খুব কষ্টের ছবি।'

এখন আসা যাক, কেন মানুষ এত সাধারণ একটি ছবিকে এত গুরুত্ব দিচ্ছে।

এর প্রথম কারণ হতে পারে, নারী পুলিশ সদ্যস্যের এই আত্মত্যাগ। বাংলাদেশের নারীরা সমাজের সব ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সমানতালে অবদান রাখছেন, এই ছবি সেই গল্প বলে। কনস্টেবল সাদিয়া ঈদ উপলক্ষ্যে হাতে মেহেদি দিলেও, মানুষের নিরাপত্তার স্বার্থে ঈদের আনন্দকে বিসর্জন দিয়েছেন, যা মানুষের মনে দাগ কেটেছে।

দ্বিতীয়ত, মানুষ সম্ভবত পুলিশকে বন্ধু হিসেবে দেখতে চায়। কিন্তু, পুলিশের নানাবিধ বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে মানুষ মাঝে মাঝে পুলিশের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, অত্যাচার-নির্যাতন করার ঘটনা প্রায় খবর হয়। পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর খবরও প্রায়ই গণমাধ্যমে পাওয়া যায়। মানুষ পুলিশের এসব খবর দেখতে চায় না। পুলিশকে পেতে চায় বন্ধু হিসেবে, যার এক হাতে থাকবে বাঁশের বাঁশরী আর এক হাতে রণ তুর্য।

তৃতীয়ত, পুলিশের দায়িত্ব অনেক কঠিন। জাতির জন্য তাদের অবদান সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আজ পর্যন্ত অনেক বেশি।

এর বাইরে ছবিটি মানুষ পছন্দ করেছে, তার কারণ পুলিশ কনস্টেবলের বাস্তব জীবন কত কঠিন ও কষ্টের সেটা ফুটে উঠেছে ছবিতে। দেশের সবচেয়ে দরিদ্র ঘরের ছেলে-মেয়েরা এই পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, যাদের অনেকের চাকরি জীবন শেষ হয় এই কনস্টেবল পদেই। সাধারণ মানুষ বোধহয় এই চিত্র দেখতে চায় না।

ছবিটির বিষয়ে জানতে চাইলে জীবন আহমেদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আসলে আমি ঈদের ছুটিতে কলকাতা যাব। সে কারণে এবার বাড়ি যাওয়া হয়নি। তাই ঈদের দিন ভোর সাড়ে ৬টায় বাসা থেকে বের হয়ে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে যাই। সাধারণত ঈদগাহ মাঠে আমরা নামাজ পড়তে আসা মানুষজনের কোলাকুলির ছবি তুলি।'

'এবার আমি যখন ছবি তুলতে যাই তখন জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের দ্বিতীয় গেটে দেখি নারীরা লাইন ধরে মাঠে প্রবেশ করছেন ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য। সেখানে বেশ কয়েকজন নারী কনস্টেবল হাতে হাত ধরে একটা নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করেছেন। তাদের মধ্যে দেখলাম, একজনের হাতে মেহেদী আর একজনের হাতে শাঁখাপলা। ছবিটি আমার মনে ধরল। মনে হলো একটি ধর্মীয় সম্প্রতির ছবি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমি যখন ক্যামেরা শাটারে চাপ দিতে যাব, এর মধ্যে তারা হাত ছেড়ে দিয়েছেন,' বলেন জীবন।

'এরপর আমি ছবি খুঁজতে থাকি। একপর্যায়ে দেখলাম এক নারী কনস্টেবল মেহেদি রাঙানো হাতে বন্দুক চেপে ধরে আছেন। ঈদের আনন্দে নিজের হাত মেহেদিতে রাঙালেও, আনন্দ বিসর্জন দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন।'

ফটোগ্রাফার জীবন বলেন, 'সবচেয়ে বড় বিষয়ে ফেস্টিভ মুডে থেকেও এক নারী তার দায়িত্ব পালন করছেন। এই চিত্রই আমি ধারণ করেছি।'

তিনি বলেন, 'নারীরা মানবতার জন্য সব কিছু করতে পারেন, ইতিহাস তার সাক্ষী। কিন্তু সফলতার ক্ষেত্রে শুধু পুরুষের নাম লেখা থাকে। অথচ, দেশ-রাষ্ট্র বা মানুষের জন্য নারীরা সব কিছুই করে থাকেন।

নারী কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন,

"কোন রণে কত খুন দিল নর, লেখা আছে ইতিহাসে

কত নারী দিল সিঁথির সিদুর, লেখা নাই তার পাশে।"'    

জীবন আহমেদ বলেন, 'সমাজে পুলিশ নিয়ে অনেক ভিন্ন মত থাকলেও, সবাই তো খারাপ নয়। অনেক ভালো কাজও পুলিশ করছে। পুলিশ আমাদের নিরাপত্তা দিচ্ছে বলেই তো আমরা রাত ৩টার সময়ও নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারি।'

জীবন আরও বলেন, একজন পুলিশ কনস্টেবলের ছুটি পাওয়া খুব কঠিন আমরা জানি। তাছাড়া পুলিশের একজন কনস্টেবল প্রায় নির্মোহভাবে কাজ করেন। দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এসব করার সুযোগ খুব কমই থাকে তাদের হাতে। বেতন-ভাতাও তারা খুব কম পান। যা পান তা দিয়ে ঢাকায় পরিবার নিয়ে থাকা সম্ভব নয়। সেদিক দিয়ে এই ছবি পুলিশ সদস্যদের কষ্টের জীবনের প্রতিচ্ছবি।'

যে নারী পুলিশ সদস্যের ছবি তোলা তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তার নাম সাদিয়া আক্তার (২২), গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। বাড়িতে মা-বাবা, বোন আছেন।

এক বছর হয়নি সাদিয়া পুলিশের কনস্টেবল পদে হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এর আগের ঈদ কেটেছে তার ট্রেনিং সেন্টারে এবং মাঠ পর্যায়ে এটিই তার প্রথম ঈদ।

এই ঈদে ছুটি পাননি তিনি, কোরবানির ঈদে বাড়ি যাবেন বলে জানান।

সাদিয়া জানান, এই ঈদে পরিবারের সবার জন্য জামা-কাপড় কিনেছেন তিনি, কিন্তু নিজের জন্য কিছুই কেনা হয়নি।

ঈদ কেমন গেল জানতে চাইলে সাদিয়া ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভালো-মন্দ মিলিয়ে কাটছে আলহামদুলিল্লাহ।'

সাদিয়া আরও জানান, তার উচ্চশিক্ষা খরচ জোগানোর সামর্থ্য মা-বাবার ছিল না। এখন নিজের রোজগারের টাকায় পড়াশোনা করতে চান তিনি।

হাতে মেহেদি দিয়ে ডিউটি করার বিষয়ে জানতে চাইলে সাদিয়া বলেন, 'বাড়িতে থাকলে প্রতিবারই মেহেদি দেওয়া হয়। এবারও মন ভালো রাখার একটা ক্ষুদ্র চেষ্টা থেকে হাতে মেহেদি দিয়েছি। ছুটি না পেলেও মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারছি, এটাও তো কম আনন্দের নয়।'

সাদিয়াদের জীবনের বাস্তব চিত্র শৈশবে দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করা। বড় হয়ে চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে ছোটা এবং চাকরি পাওয়ার পর মানুষের জীবনের জান-মালের নিরাপত্তা দেওয়া।

সাদিয়াদের ঈদ আনন্দ বিসর্জনেই আসে আমাদের আনন্দ, আমাদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা। তাই সাদিয়াদের আর কিছু দিতে না পারলেও দিতে পারি শুধু টুপি খোলা অভিবাদন।

Comments

The Daily Star  | English
Yunus in Nature’s top 10 personalities 2024

Yunus returns home after attending WEF

Chief Adviser Professor Muhammad Yunus returned to Dhaka this afternoon after concluding a four-day visit to Davos, Switzerland, where he participated in the annual World Economic Forum (WEF) meeting

52m ago