খৎনা ও এনডোস্কপি করাতে গিয়ে মৃত্যু প্রসঙ্গে কিছু কথা
দেশে সম্প্রতি অপারেশন ও মেডিকেল প্রসিডিউরের সময় তিন জনের মৃত্যু নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। প্রথম ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর সাঁতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঁচ বছরের এক শিশুর খৎনা করাতে গিয়ে। খৎনা করার জন্য অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করার পর আর শিশুটির জ্ঞান ফেরেনি। এই ঘটনার রেশ কাটার আগেই ল্যাব এইড হাসপাতালে অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে এনডোস্কপি করতে গিয়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর মৃত্যু হয়। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার মালিবাগের একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে খৎনা করতে গিয়ে ১০ বছরের আরেক শিশু মারা যায়।
তিনটি সার্জারি/প্রসিডিউর খুবই ছোট এবং সাধারণ। তবে কেন এমন হলো? সাধারণ সার্জারি/প্রসিডিউর করাতে গিয়ে দেড় মাসের মধ্যে তিন জনের মৃত্যু হলো। নিশ্চয়ই সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ এই ঘটনাগুলো তদন্ত করে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করবে। সর্বশেষ শিশুটির মৃত্যুর ঘটনায় একটি মামলাও হয়েছে।
আমি এখানে শুধু জানাতে চেষ্টা করব কেন এমন হচ্ছে, কোথায় আমাদের ডাক্তারদের দুর্বলতা, কেন এই দুর্বলতা, এতে কি শুধুই ডাক্তাররা দায়ী? বিষয়গুলো বিস্তৃতভাবে জানার আগে আমাদের প্রথমেই বুঝতে হবে কীভাবে ডাক্তারদের সঙ্গে অপারেশনের শিডিউল ঠিক করা হয় আর কিভাবে রোগীর প্রসিডিউরগুলো হয়ে থাকে।
অপারেশনের পূর্বপ্রস্তুতি
ডাক্তার যদি মনে করেন তার রোগীর কোনো প্রসিডিউর বা অপারেশনের দরকার আছে তাহলে তিনি সবার আগে ওই রোগীকে বা রোগীর নিকটাত্মীয়কে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। এতে অ্যানেসথেসিয়ার দরকার হলে সেটাও তিনি জানিয়ে দেন। বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা করে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নেন। রোগীকে কোনো ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে কি না অথবা বাড়তি কোনো ওষুধের প্রয়োজন হবে কি না সেটাও জানিয়ে দেওয়া হয়। এর পরই যিনি অপারেশন করেন অর্থাৎ সার্জন ও অ্যানেসথেসিওলজিস্ট রোগী ও রোগীর নিকট আত্মীয়র কাছ থেকে একটি সম্মতিপত্রে সই নেন। সম্মতিপত্রে রোগীর প্রসিডিউর ও ঝুঁকি সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা থাকে। সারা পৃথিবীতেই এই নিয়মটি মানা হয়।
ছোট ও বড় অপারেশন: লোকাল ও জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া
আমাকে অনেকেই বলেন খাৎনা একটি সাধারণ অপারেশন। হাজাম দিয়ে খৎনা করাতে আগে তো কোনো জটিলতা হতো না। তাহলে চিকিৎসক দিয়ে খৎনা করিয়ে কেন মৃত্যু হলো। হাজাম যখন অপারেশন করত বা এখনো করে তাতে যে জটিলতা হয় না তা নয়। হাজাম দিয়ে খৎনা করাতে গিয়ে গ্লাস পেনিসে (পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ) ক্ষত নিয়ে অনেক রোগীকে আসতে দেখেছি আমি। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ নিয়েও অনেক রোগীকে হাসপাতালে আসতে হয়। সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয় স্থায়ী বা অস্থায়ী মানসিক ট্রমা থেকে। যাই হোক, হাজাম দিয়ে খৎনা করানো কতটা অনিরাপদ আর সার্জন কতটা নিরাপদ সেটা বোঝানো আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি বলতে চাইছি কোনো অপারেশনই হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এমনকি লোকাল অ্যানেসথেসিয়া (শুধু অপারেশনের জায়গাটুকু অবশ করা) দিয়ে নেইল এভালসন (মরা নখ উপড়ে ফেলার অপারেশন) এর মতো সাধারণ অপারেশনের সময় ভ্যাসোভ্যাগাল অ্যাটাক (হৃদযন্ত্র বন্ধ হওয়ার উপক্রম) হতেও দেখেছি। কাজেই লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে সাধারণ অপারেশনেও অ্যানেসথেসিওলজিস্টের উপস্থিতিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিতে হয়। অস্ত্রোপচার করতে হবে সব ধরনের সুবিধাসম্বলিত সুসজ্জিত অপারেশন থিয়েটারে। শুধুমাত্র তাহলেই মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব। তবে অপারেশনে মৃত্যুর হার কেন শূন্যের কোঠায় নামানো সম্ভব নয় সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: মেডিকেল শিক্ষা
সম্প্রতি প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৩৭টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ৪২ শতাংশ শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। অধ্যাপকের পদ ৬২ শতাংশ শূন্য। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর এই চিত্র হলে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। পোস্ট গ্রাজুয়েশন বা উচ্চতর মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থার কি অবস্থা? পোস্ট গ্রাজুয়েশন মেডিকেল শিক্ষাও অনেকাংশে এই সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর ওপর নির্ভরশীল। আমরা কীভাবে মানসম্পন্ন চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি করছি যেখানে মেডিকেল কলেজগুলো শিক্ষক সংকটে ভুগছে? শিক্ষক সংকট ছাড়াও এই প্রতিষ্ঠানগুলো অবকাঠামোগত জটিলতা ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের নানা সুযোগ সুবিধার অভাব, আর্থিক খাতে অসচ্ছলতাসহ অনেক সমস্যায় জর্জরিত।
সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের কর্মপরিবেশ
সরকারি হাসপাতালে বহির্বিভাগে প্রত্যেক ডাক্তারের কক্ষের সামনে রোগীর লম্বা লাইন থাকে। একজন ডাক্তার সাধারণত সকাল ৮টায় রোগী দেখতে বসেন। কাজের ফাঁকে এক ঘণ্টা বিরতি নিলে দুপুর ২টা পর্যন্ত তিনি প্রায় পাঁচ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে রোগী দেখেন। বহির্বিভাগে নিবন্ধন খাতাগুলোতে দেখা যায় প্রত্যেক ডাক্তার দৈনিক অন্তত একশ রোগী দেখেন। কোনো কোনো ডাক্তার দুইশ জন পর্যন্ত রোগী দেখেন। পাঁচ ঘণ্টায় যদি একজন ডাক্তার একশ জন রোগী দেখেন তাহলে প্রতি ঘণ্টায় ২০ জন অর্থাৎ রোগী প্রতি সময় থাকে মাত্র তিন মিনিট। এই সময়ের মধ্যে ডাক্তার রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত শোনার পর ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসা লিখে দেন আবার সরকারি ঔষধাগার থেকে ওষুধ দেওয়ার জন্য একটা কাগজে ওষুধের নাম লিখে। এই তিন মিনিটের মধ্যেই একজন ডাক্তারকে রোগীর রোগ নির্ণয় ও অন্যান্য তথ্য হাসপাতালের নিবন্ধন খাতায় লিখতে হয়। আপনার কি এখন ডাক্তারকে সুপারম্যান মনে হচ্ছে?
প্রাইভেট চিকিৎসক
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাই অফিস সময়ের বাইরে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে চিকিৎসা দেন। রোগীর চাপ আর চিকিৎসক সংকটের ব্যাপারে সরকারি হাসপাতালগুলোর সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিশেষ তফাৎ নেই। সম্পূর্ণ বেসরকারি ডাক্তারদের ব্যবস্থাপনায় পূর্ণ বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে ওঠা তাই এখনো অনেক দূরের বিষয়। এক্ষেত্রে গুটিকয়েক করপোরেট হাসপাতালের কথা ভিন্ন।
বেসরকারি হাসপাতালেও রোগীর সংখ্যার তুলনায় ডাক্তার অপ্রতুল। অনেকটা সরকারি হাসপাতালের মতোই। সরকারি হাসপাতালে একজন ডাক্তারকে যেখানে তিন মিনিটে একজন রোগী দেখতে হয় সেখানে প্রাইভেট চেম্বারে বড়জোর ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় দেওয়া যায়। কিছু কিছু রোগীর রোগ নির্ণয়ের জন্য এই সময় আসলেই অপ্রতুল। বিশেষ করে অধ্যাপক পর্যায়ের ডাক্তারদের রোগীর চাপ দেখলে আপনারা বুঝতে পারবেন। অনেক ধরনের রোগী আছে যার রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য হয়তো ওই নির্দিষ্ট অধ্যাপকের কাছে যাবার দরকারই নেই। তবু দেখা যায়, ওই রোগী স্বেচ্ছায় ওই অধ্যাপকের কাছে পৌঁছে চিকিৎসা নিচ্ছেন এবং যাদের হয়ত সত্যিই ওই অধ্যাপকের পরামর্শের প্রয়োজন তারা তার কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। এর পেছনের কারণটা হলো আমাদের দেশে রেফারেল সিস্টেমটা একেবারেই কাজ করছে না। যে কেউ ইচ্ছে করলেই একজন অধ্যাপকের কাছে পৌঁছে যেতে পারছেন। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এমনটা সম্ভব নয়।
এজন্যই রোগীর কিছু তথ্য ব্যস্ত ডাক্তারদের নজর এড়িয়ে যায়। অনেক সময়ে যা রোগীর মৃত্যুর কারণও হতে পারে। এনডোস্কপি করাতে গিয়ে মারা যাওয়া রোগীর ব্যাপারে জানা গেল তার স্লিপ অ্যাপনিয়া ছিল। আমার ধারনা এই তথ্যটি হয়ত ওই ডাক্তারের নজর এড়িয়ে গেছে। যদিও রোগীর শারীরিক ওজন দেখে এই বিষয়টা তার মাথায় রাখা উচিত ছিল। কারণ এই তথ্য জানা থাকলে প্রসিডিউর করার সময় অবশ্যই অ্যানেসথেসিওলজিস্টের উপস্থিতিতে রোগীকে ঘুম পাড়ানো হতো। এটাও মনে রাখতে হবে, অ্যানেসথেসিওলজিস্টের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে অনেক প্রসিডিউর হয়ে থাকে। দক্ষ অ্যানেসথেসিওলজিস্টের সংকট, সেই সঙ্গে খরচ কমানোর চেষ্টায় এটা করা হয়।
বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় অ্যানেসথেসিয়া
এখনো বাংলাদেশে খুব অল্প সংখ্যক রোগী ও রোগীর স্বজনরা অ্যানেসথেসিয়া সম্পর্কে জানেন। তারা জানেন অপারেশনের সমস্ত দায়-দায়িত্ব সার্জনের। মূল সার্জনের সঙ্গে হয়তো আরও কয়েকজন সহকারী থাকেন এই পর্যন্তই তাদের জানা। কিন্তু যখন অঘটন ঘটে যায় কেবল তখনই অ্যানেসথেসিয়ার দক্ষ ডাক্তারের গুরুত্ব আলোচনায় আসে। মূলত এই কারণেই দেশে অ্যানেসথেসিয়া বিভাগের প্রসার ঘটছে না ও দক্ষ অ্যানেসথেসিওলজিস্ট তৈরি হচ্ছে না। ব্যাপারটা আরেকটু খুলে বলি।
৩৫-৪০ বছর আগেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগ বা গাইনি ও অবস্ বিভাগে রোগীর যে চাপ ছিল ও রোগের যে প্রকৃতি ছিল তাতে সার্জারি বিভাগ হয়তো প্রথমে তিনটি ইউনিটে (তিনজন অধ্যাপকের অধীনে) বিভক্ত ছিল। কিন্তু দিনে দিনে রোগীর চাপ ও রোগের প্রকৃতি অনুযায়ী সার্জারি বিভাগ তিনটি ইউনিট থেকে সাতটি ইউনিটে ও তারপর বিভিন্ন উপ-বিভাগে যেমন: শিশু সার্জারি, ইউরোলজি, পেডিয়াট্রিক সার্জারি, হেপাটো বিলিয়ারি সার্জারি ইত্যাদি নানা উপবিভাগে বিভক্ত হয়েছে। প্রতি উপবিভাগে বা ইউনিটে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক পদ সৃষ্টি হয়েছে। একইভাবে গাইনি ও অবসেরও নানা ইউনিট ও উপবিভাগে দিনে দিনে অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে রোগীর সংখ্যা ও রোগের প্রকৃতি অনুযায়ী। কিন্তু অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে কি একই হারে পদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে? অথবা সার্জারির উপবিভাগগুলোর পাশাপাশি অ্যানেসথেসিয়ায় সুনির্দিষ্ট ট্রেনিংভিত্তিক উপবিভাগ সৃষ্টি হয়েছে? না, হয়নি। অথচ প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উচিত ছিল পেডিয়াট্রিক (শিশু) অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, নিউরো অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, কার্ডিও অ্যানেসথেসিওলজিস্টের মতো বিভিন্ন উপ-বিভাগ তৈরি করে তাতে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করে দক্ষ অ্যানেসথেসিওলজিস্ট তৈরি করা। কিন্তু এ বিষয়ে কারোরই কোনো উদ্যোগ নেই। এই বিভাগ অবহেলিত থেকে গেছে। রোগী মারা গেলে এই বিভাগ নিয়ে মাঝে মাঝে কিছু কথা হয়। কিন্তু এরপর আর সুনির্দিষ্ট কোনো কর্মপরিকল্পনা করা হয় না।
এমনকি এই বিভাগের ডাক্তাররা আর্থিকভাবেও অবহেলিত। সার্জন যখন অপারেশন করেন তখন একজন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট রোগীর জীবন রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রোগীকে অজ্ঞান করে ব্যথামুক্ত সার্জারি শেষে জ্ঞান ফিরিয়ে পোস্ট-অপারেটিভ রুমে স্থানান্তর করেন। অথচ বেসরকারি হাসপাতালে অ্যানেসথেসিওলজিস্ট একজন সার্জনের এক দশমাংশ থেকে বড় জোড় এক তৃতীয়াংশ পারিশ্রমিক পান। অথচ উন্নত বিশ্বে তাদের পারিশ্রমিক সর্বোচ্চ। তাই বর্তমান প্রজন্মের দক্ষ ডাক্তাররা অ্যানেসথেসিয়া বিভাগে ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহ হারাচ্ছেন। দিন দিন সংকট বাড়ছেই।
সুসজ্জিত অপারেশন থিয়েটার
এ তো গেল অ্যানেসথেসিওলজিস্টদের সমস্যার কথাবার্তা। এই সমস্যার সমাধান হলেই কি হবে? নাহ্। সুষ্ঠু অপারেশনের সঙ্গে আরও অনেক বিষয়ে জড়িত।
একটা অপারেশন সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য দক্ষ সার্জন ও অ্যানেসথেসিয়ার ডাক্তারের পাশাপাশি আরও কিছু দক্ষ জনবল দরকার। বিশ্বের অন্য প্রায় সব দেশেই এটা আছে। এদের বলা হয় সার্জিক্যাল টেকনিশিয়ান ও অ্যানেসথেসিয়া টেকনিশিয়ান। অপারেশন থিয়েটারের ভেতর সার্জিক্যাল ও অ্যানেসথেসিয়ার যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা এদের কাজ। বাংলাদেশে এই পদগুলো সৃষ্টি হয়নি। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে আমি তিন-চার জন অ্যানেসথেসিয়া টেকনিশিয়ান দেখেছিলাম। তবে আর কোথাও এদের দেখা পাইনি। ভুটানে কাজ করার সময় আমার মনে হয়েছে বাংলাদেশে টেকনিশিয়ানের প্রয়োজন আছে। তাহলে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরের মূল্যবান জিনিসপত্র সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হতো।
এরপর আসা যাক অপারেশন থিয়েটারের ক্যাটাগরি অনুযায়ী যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে। আমি এমন অনেক সরকারি হাসপাতাল দেখেছি যেখানে সার্জিক্যাল ও অ্যানেসথেসিয়ার প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক যন্ত্রপাতি নেই। এমন অনেক সরকারি হাসপাতাল দেখেছি যেখানে অপারেশন টেবিল নেই অথচ সুসজ্জিত অর্থপেডিক টেবিল ও অর্থোপেডিক যন্ত্রপাতি আছে। অথচ সেখানে কোনোদিন অর্থোপেডিক ডাক্তারের পোস্টিং হয়নি। যেখানে বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিক সার্জন আছেন সেখানেই এ ধরনের টেবিল ও যন্ত্রপাতি থাকা দরকার। আমি এক সময় প্রত্যন্ত এলাকায় অ্যানেসথেসিওলজিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলাম যেখানে রোগীর জীবন বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় ইন্টিবিউশন টিউব ও লেরিঙ্গোস্কোপ ছিল না। অথচ সেখানে ছিল বিআইএস মনিটরের মতো অত্যাধুনিক যন্ত্র যা নিউরোসার্জারির অ্যানেসথেসিয়ায় প্রয়োজন। এই মনিটর সেখানে কীভাবে পৌঁছাল ভেবে ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। এরপরও আমি বলব আমাদের দেশের ৯০ ভাগের ওপর সরকারি হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটার মোটামুটি সুসজ্জিত। যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে রোগীর জীবন বাঁচানোর উপকরণ এখানে আছে।
বেসরকারি হাসপাতালের চিত্র
অল্প কিছু করপোরেট হাসপাতাল ছাড়া বাকি হাসপাতালগুলোর অপারেশন থিয়েটার অথবা প্রসিডিউরের রুম আসলেই সুসজ্জিত নয়। এজন্যই অঘটনগুলো ঘটছে। প্রথম শিশুটি মারা যায়, সেটি একটা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হলেও সেখানে অপারেশন থিয়েটারে রোগীর 'রিসাসিটেশন'-এর জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল না বলে পরে জানা যায়। আর দ্বিতীয় শিশুটির যেখানে খাৎনা করা হয়েছিল সেটা তো হাসপাতালই নয়, একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অপারেশন থিয়েটারে রোগীর জীবন রক্ষার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। আর এনডোস্কপির ঘটনাটাতে আমার মনে হয় রোগী যখন স্লিপ এপনিয়ায় (শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া) চলে গিয়েছিল তখনও চিকিৎসক ব্যস্ত ছিলেন তার এনডোস্কপি নিয়ে। সঠিকভাবে মনিটর হলে এই ঘটনা ঘটত না বলে আমার বিশ্বাস। এজন্য এনডোস্কপিতেও সিডেশন দিতে হলে অবশ্যই অ্যানেসথেসিওলজিস্ট সাথে রাখা উচিত।
রোগীর মৃত্যুর হার 'শূন্য' করা সম্ভব?
অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার আগে রোগীর শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও ল্যাব ইনভেস্টিগেশনের রিপোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চেক করে (যাকে বলা হয় প্রি অ্যানাসথেটিক চেকআপ) রোগীর স্ট্যাটাস নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। এটা নানা মানদণ্ডে করা হয়ে থাকে। তবে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় মানদণ্ড হচ্ছে ASA physical status classification system । এই মানদণ্ডে সবচেয়ে সুস্থ সবল রোগীর স্ট্যাটাসকে ASA 1 আখ্যায়িত করা হয়। এই ASA 1 রোগীরও মৃত্যুর হার ০.৩-০.৪ শতাংশ বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে। কাজেই অন্যান্য জটিল রোগীর অপারেশনে মৃত্যুর হার আরও বেশি থাকা স্বাভাবিক। কাজেই রোগীর মৃত্যু হলেই হাসপাতাল ও ডাক্তারের ওপর আক্রমণ যেমন কাম্য নয় তেমনি মৃত্যুর হার কমাতে সুদক্ষ সার্জন, সুদক্ষ অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, সিনসিয়ার নার্সিং স্টাফ, দক্ষ টেকনিশিয়ান সর্বোপরি সুসজ্জিত অপারেশন থিয়েটার দরকার।
এই তিনটি মৃত্যুর ঘটনাগুলোর পরপরই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ১০টি দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আমরা সবাই জানি এই দিকনির্দেশনাগুলো কার্যকর করা গেলে অবশ্যই রোগীর মৃত্যুর হার অনেক কমে আসবে। কিন্তু শুধুমাত্র বিবৃতি বা কাগুজে নির্দেশনা দিয়ে এটা কখনোই অর্জন সম্ভব নয়। প্রতিটি উপজেলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অধীনে একটি টিমের মাধ্যমে প্রাইভেট হাসপাতালগুলো সঠিকভাবে মনিটর করা জরুরি। একইভাবে ঢাকার ও অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরের সিভিল সার্জনের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন কমিটি গঠন করে সব বেসরকারি হাসপাতালগুলো মনিটর করা জরুরি। তাহলেই এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় মাধ্যমে রোগী মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব। আমরা বাংলাদেশের জন্য একটি সুন্দর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অপেক্ষায় রইলাম।
ডা. মোহাম্মদ মাহবুবে মোস্তফা, সহকারী অধ্যাপক, অ্যানেসথেসিয়া বিভাগ, ওএসডি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments