নাবালক রাজনীতি ও প্রতিবেশীর অভিভাবকত্ব
সব জল্পনাকল্পনা আর গুজবের অবসান ঘটিয়ে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এখন চলছে আলোচনা-সমালোচনা—যেমনটি সবসময়ই হয়, হয়ে থাকে।
সরকারি দল এই নির্বাচনকে দেশে 'গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা'য় একটি মাইলফলক হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে রাজপথের সব বিরোধী দল এটিকে দেখছে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক হিসেবে।
যত সমালোচনাই করা হোক না কেন, ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে যা ঘটেছে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমনটা যে হবে তা অনেক আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। কারণ, রাজপথের বিরোধী দলগুলো নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক বা তদারকি সরকারের যে দাবি জানিয়ে আসছিল, তা বোধগম্য কারণেই সরকার বা সরকারি দলের পক্ষে মেনে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না।
অন্যদিকে, পরপর দুটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা (২০১৪ ও ২০১৮) এবং দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বিরোধী দলের প্রতি সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের মারমুখী আচরণ থেকে তাদেরও বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। ফলে যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে।
নির্বাচনের কয়েকমাস আগে থেকেই আন্তর্জাতিক মহল, বিশেষ করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব একটি সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর চাপ দিয়ে আসছিল। অন্যদিকে ভারত, চীন ও রাশিয়া সরকারের উদ্যোগকে কখনো প্রত্যক্ষ, কখনো পরোক্ষভাবে দিয়েছিল সমর্থন।
নির্বাচনের পরপরই অনেক দেশ কূটনৈতিক শিষ্টাচার অনুযায়ী সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে, তাদের এ দেশীয় কূটনীতিকরা সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করে নিজ নিজ দেশের সমর্থনের কথা জানিয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ জানুয়ারি ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সঙ্গে তার দপ্তরে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, '২০১৪ সালেও নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ভারতবর্ষ আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনকেও বিতর্কিত করার এবং সে নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্থাপন করা হয়েছিল। ভারতবর্ষ আমাদের পাশে ছিল। এবারও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থানটা কী ছিল বা কী আছে, তা আপনারাই জানেন।' (প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি ২০২৪) স্বাভাবিকভাবেই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য বোদ্ধামহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতবর্ষের 'পাশে থাকা' বলতে কী বুঝিয়েছেন তা খোলাসা করে না বললেও অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন 'তাহলে কি ভারতের পরামর্শমতই' সরকার এই বিতর্কিত নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে?
বিষয়টিকে এত নেতিবাচকভাবে হয়তো না-ও দেখা যেতো। কিন্তু কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দল না থাকার পরও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নিজের লোকেরাই এমন সব কথা বলেছেন যে বাংলাদেশের নির্বাচনে সাধারণ মানুষ ভারত প্রসঙ্গটাকে খুব হালকাভাবে নিতে পারছে না।
নির্বাচনের মাত্র ১২ দিন আগে মেহেরপুর-১ (মুজিবনগর, সদর উপজেলা) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও সাবেক দুই মেয়াদের সংসদ সদস্য প্রফেসর আব্দুল মান্নান টেলিফোনে একজনকে বলেন, 'আমি শেখ হাসিনার প্রার্থী, আমি ভারতের প্রার্থী। আমি এখানে হারার জন্য আসিনি।' (সমকাল, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩)
একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনে সরকার দলীয় কেউ যখন নিজেকে ভিন্ন কোনো দেশের প্রার্থী হিসেবে প্রচার করে, তখন এটিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। কারণ, এটি স্পষ্টতই দেশের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব অস্বীকারের নামান্তর।
তবে বাংলাদেশের মন্ত্রী ও রাজনৈতিক নেতাদের এ হেন মন্তব্য-বক্তব্য যে খুব একটা সাম্প্রতিক বিষয়, এমন কিন্তু নয়। প্রায় দেড় বছর আগে ২০২২ সালের আগস্টে আমাদের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন ভারতে সরকারি সফর শেষে দেশে ফিরে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, 'শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে যা যা দরকার, তা করতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেছি।'
কোন রাখঢাক নেই, প্রকাশ্যেই বলেছিলেন এ কথা। বলেছিলেন বেশ গর্বের সঙ্গেই। শুধু তাই নয়, ২০১৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম বিদেশ সফরে ভারতে গিয়ে তিনি দুই দেশের সম্পর্ককে 'স্বামী-স্ত্রীর' মতো বলে উল্লেখ করেছিলেন। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে তিনি বলেছেন 'আমাদের বিজয় মানে ভারতের বিজয়, ভারতের বিজয় মানে আমাদের বিজয়।' তার এ হেন কথাবার্তা নিয়ে সে সময়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে অনেক। কিন্তু তাতে তার বচনামৃত বর্ষণে তেমন একটা রকমফের হয়নি।
নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীও তার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম সুযোগেই বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের পাশে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা থেকে মনে হয়, ভারত যেন আমাদের অভিভাবক। তাইতো গত তিন-তিনটি নির্বাচনে 'পাশে থেকে' পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।
একজন অভিভাবক যেমন তার সন্তানদের বিভিন্ন সমস্যা, ঝুটঝামেলা থেকে আগলে রাখেন, ভারতও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাই করছে। আর এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও আমরা বাংলাদেশিরা সাবালক হয়ে উঠতে পারিনি, যার জন্য আমাদের ভারতের মতো একজন অভিজ্ঞ অভিভাবকের প্রয়োজন থেকেই যাচ্ছে।
কিন্তু এই যে জন্মের ৫২ বছর পরও সাবালক না হতে পারা, এর কারণ কী? এ কী শুধুই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় যাওয়া বা টিকে থাকার বিষয়? নাকি এর পেছনে আরও কারণ রয়েছে? সময় এসেছে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেওয়ার।
আসলে আমরা যতই বলি না কেন যে আমাদের জনগণ রাজনীতি সচেতন, প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে বিরাজনীতিকরণের একটা প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে—যার যাত্রা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার অব্যবহিত পরই। অন্যদিকে, আমাদের রাজনীতিবিদরাও ক্ষমতার মসনদ দখলের জন্য এতই মরিয়া যে তারা রাজনীতিকে ক্ষমতায় যাওয়ার মই হিসেবেই শুধু ব্যবহার করেছেন—সাধারণ জনগণের কাছে নিয়ে যাওয়ার কোনো চেষ্টাই করেননি এযাবতকাল।
ফলে, রাজনীতি হয়ে গেছে মুষ্টিমেয় একটা শ্রেণীর ক্ষমতারোহনের প্রক্রিয়ামাত্র, যা আমাদের রাজনীতির সাবালকত্ব অর্জনে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তারই অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে বিদেশি রাষ্ট্র বা শক্তির ওপর নির্ভরশীলতা। সেই সুযোগটাই নিচ্ছে প্রতিবেশী ভারত।
এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের একটা সুবিধাজনক অবস্থা রয়েছে। সে এটাকে কাজে লাগাবে, এতে অবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই। আর বাংলাদেশের রাজনীতি যেহেতু রাজনীতিবিদদের হাত থেকে চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে, তারাও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বৃহৎ পুঁজির অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য চেষ্টিত হবেন, এটাও স্বাভাবিক।
সে কারণেই ভারত চাইবে আমাদের রাজনীতিটা নাবালকই থাকুক, যাতে তারা অভিভাবকের মতো খবরদারি করতে পারে। যতদিন আমাদের রাজনীতি সাবালক না হবে, ততদিনই তাকে কারো না কারো অভিভাবকত্ব মেনে নিতে হবে—হতে পারে তা ভারত, হতে পারে চীন, হতে পারে আমেরিকা কিংবা অন্য কোনো দেশ।
নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের জাতীয় নির্বাচনে যেভাবে ভারতের অভিভাবকত্ব প্রকাশ করেছেন, তা অন্যভাবেও করা যেতো। তার মনে রাখা উচিত ছিল যে রাজনীতিতে যত দুর্বলতাই থাকুক না কেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুধু একজন মন্ত্রীই নন, তিনি রাষ্ট্রের প্রধান কূটনীতিক। আর, আজকাল ছোট শিশুরাও মাত্রাতিরিক্ত অভিভাবকত্ব মেনে নিতে চায় না।
মোশতাক আহমেদ: সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা ও কলাম লেখক
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)
Comments