এ মুহূর্তে অমর্ত্য সেন পাঠ কেন জরুরি

অমর্ত্য সেনের জন্মদিন ছিল গত শুক্রবার, ৩ নভেম্বর। যে ক’জন বাঙালি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি ও সম্মানের অধিকারী হয়েছেন, তিনি তাদের অন্যতম। যখন দেশে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দৃশ্যত এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তখন অমর্ত্য সেন বেশি বেশি পাঠ করা জরুরি। কেননা এই অচলাবস্থা কীভাবে দূর করা যায় তার সুন্দর ও যৌক্তিক সমাধান দিয়েছেন তিনি।
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ছবি: সংগৃহীত

অমর্ত্য সেনের জন্মদিন ছিল গত শুক্রবার, ৩ নভেম্বর। যে ক'জন বাঙালি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খ্যাতি ও সম্মানের অধিকারী হয়েছেন, তিনি তাদের অন্যতম। যখন দেশে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে দৃশ্যত এক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তখন অমর্ত্য সেন বেশি বেশি পাঠ করা জরুরি। কেননা এই অচলাবস্থা কীভাবে দূর করা যায় তার সুন্দর ও যৌক্তিক সমাধান দিয়েছেন তিনি।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর আবারও কি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি চলছে? ২০১৪ এর নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায়, একতরফা নির্বাচনের সুযোগ কাজে লাগায় আওয়ামী লীগ। ১৫৩ জন দলীয় প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দশম জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। সেসময় বিএনপির প্রধান অভিযোগ ছিল সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে। নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হওয়া জরুরি, তা না হলে সেই নির্বাচনে জনমতে প্রকৃত প্রতিফলন হয় না। বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলোর আশঙ্কা ছিল নির্বাচনে জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে না। এসব বিবেচনায় তারা নির্বাচন থেকে দূরে থাকে।

২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনের পরিবেশসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাদের অভিযোগ থাকলেও নির্বাচন থেকে দূরে সরে যায়নি, প্রার্থিতাও প্রত্যাহার করে নেয়নি। কিন্তু নির্বাচন শেষে দেখা গেল ভোট সুষ্ঠু হয়নি। ফলে, এ নির্বাচনেও জনমতের প্রকৃত চিত্র গরহাজির থাকে। দুটো নির্বাচনেই একটা বিষয় স্পষ্ট যে ভোটাররা তাদের ভোট দিতে পারেনি।

বাংলাদেশে প্রতি পাঁচ বছর পর পর সংসদ নির্বাচন হয়। সেই অনুযায়ী, ২০২৪ এর জানুয়ারি মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। প্রশ্ন হল, এই নির্বাচনও কি আগের দুটো জাতীয় নির্বাচনের মতো হবে। এবারও কি ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না? এসব নিয়ে বিএনপি পার করছে কঠিন একটা সময়। ভোট সামনে নিয়ে দেশজুড়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের মধ্যে শঙ্কা, হতাশা আর ভয় বেড়েছে। বিশেষ করে ২৮ অক্টোবরের পর। তারও আগে থেকে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভোটের অধিকার নিয়ে মুখোমুখি লড়াইয়ে থাকলেও ওইদিন থেকে এই লড়াই আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। ২৮ অক্টোবর বিএনপির জনসভা পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর, তারা হরতালের কর্মসূচি দেয়। হরতাল শেষ করে শুরু হয়েছে অবরোধ। যা দ্বিতীয় বারের মতো চলছে গত রোববার থেকে। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগের 'শান্তি সমাবেশ' কর্মসূচিও অব্যাহত রয়েছে। বিএনপির প্রথম সারির নেতাদের একটা বড় অংশ কারাগারে। তাদের মাথার ওপর ঝুলছে শত শত মামলার খড়গ।

দুই দলই আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে। উভয়ের লক্ষ্য এক কিন্তু পথ ভিন্ন। বিএনপি চায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা। আওয়ামী লীগ চায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। সংবিধানের কথা বলে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নাকচ করছে। বিএনপি মনে করে বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। যার স্পষ্ট উদাহরণ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন। এমনিতেও এদেশের মানুষের সাধারণ অভিজ্ঞতা হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনেই ক্ষমতাসীনরা জয়ী হয়নি। ৯১, ৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। প্রতিটি নির্বাচনেরই ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে।

আওয়ামী লীগের ভাষ্য হলো, তারাও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। তবে সেটা সংবিধানের ভেতর থেকেই। যদিও তাদের আন্দোলনের কারণেই একসময় নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু এখন তারা মনে করে, সংবিধানে যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা নেই তাই সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা নিয়ে রাজনীতিবিদদের তরফে বিশেষ করে ক্ষমতার মৌরসীপাট্টায় যারা থাকেন তাদের পক্ষে এমন আলোচনাও এসেছে যে, তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা গৌরবের কিছু নয়, রাজনীতিবিদদের জন্য তো নয়ই। কেননা, রাজনীতিবিদরা সবকিছু চালাতে পারলে এবং এ ব্যাপারে তাদেরকে বৈধতা দেওয়া হলে নির্বাচনের সময় কেন তারা পারবে না। উল্টো দিকে এ কথাও জারি আছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাংলাদেশের জন্য ছিল সবচেয়ে গর্ব ও গৌরবের। এটা বিশ্বের দেশে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটা মডেল হতে পারত। অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অতীত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ইতিহাসের গভীরে রয়েছে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে গোপালকে জনগণের মধ্য থেকেই রাজা নির্বাচিত করা হয়েছিল। যা, সেই সময়ের মাৎস্যন্যায় রোধে পালন করেছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই ঐতিহ্যকেও আমরা নতুন জাগরণের বারতায় হাজির করতে পারতাম। যা সংকট মোকাবেলায় পালন করতো ঐতিহাসিক এক ভূমিকা। কিন্তু সংবিধানের দোহাই দিয়ে পরিস্থিতিকে আরও সংকটময়, জটিল ও ধ্বংসাত্মক করে তোলা হয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে হবে, বর্তমান সংবিধানের মধ্য থেকেই হবে, নাকি আলোচনার মধ্যে দিয়ে সবাইকে আস্থায় নিয়ে একটা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা হবে। এই উদ্বেগ, প্রশ্ন, শঙ্কা ও আলোচনার মধ্যেই হাজির হলো অমর্ত্য সেনের ৯০তম জন্মদিন। নির্বাচন নিয়ে তিনি খুব সুন্দর একটা তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন। যা একই সঙ্গে যৌক্তিক ও সবার জন্যই গ্রহণযোগ্য। আমরা এ তত্ত্বের আলোকে যদি আমাদের নির্বাচন সম্পন্ন করি তা হলে উদ্ভূত অবস্থার সমাধান পাওয়া সম্ভব।

অমর্ত্য সেন বলেছেন, নির্বাচন কেবল সাংবিধানিকভাবে বৈধ হলেই হবে না, নৈতিকভাবেও সিদ্ধ হতে হবে। এর কোনো একটার অনুপস্থিতি হলে সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। প্রশ্ন হলো, কোন নির্বাচনকে আমরা সাংবিধানিকভাবে এবং নৈতিকভাবে শুদ্ধ বলব, বৈধতা দেব? উনার জবাব, নির্বাচনকে চারটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এক. সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে হবে। দুই. অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিন. প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। চার. উৎসবমুখর হতে হবে।

তিনি মনে করেন এগুলো নিশ্চিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। আমাদের নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিকভাবে এসব করার সুযোগ রয়েছে। সংবিধান তাদেরকে এই ক্ষমতা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, তারা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে কতটা আন্তরিক ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। শিগগিরই তফসিল ঘোষিত হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের যে রুটিন ওয়ার্ক এখন দৃশ্যমান, তাতে কি অমর্ত্য সেনের ওই চার শর্ত বাস্তবায়িত হওয়ার চেষ্টা জারি রয়েছে? সামনে নির্বাচন অথচ বিএনপির অনেক নেতাকর্মী জেলে, আদালতের বারান্দায় সময় কাটাচ্ছে। তা হলে এই নির্বাচনকে কি অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে? বিএনপিকে ২৮ অক্টোবর জনসভা করতে দেওয়া হয়নি—কারণ যাই হোক। অথচ জামায়াত পুলিশের অনুমতি ছাড়াই জনসভা করল? এসব নিয়ে নির্বাচন কমিশনের পরিষ্কার কোনো বার্তা নেই। ফলে, এই প্রশ্ন তো ভোটারদের মাঝে রয়েছে, কী আছে নির্বাচন কমিশনের মনে? তারা কি গত দুই নির্বাচন থেকে শিক্ষা নেবে, নাকি পুরোনো পথেই হাঁটবে? বর্তমানে বিএনপির মহাসচিব কারাগারে। দলের কেন্দ্রীয় অফিস পুলিশ প্রহরায় আবদ্ধ। নির্বাচন কমিশন সংলাপে বসার জন্য যে চিঠি ইস্যু করেছিল বিএনপির নামে তা নেওয়ার লোক খুঁজে পাননি। সেই চিঠি পড়েছিল অফিসের সামনে থাকা চেয়ারে। তাহলে কীসের ভিত্তিতে এই আস্থা রাখা যাবে যে, আগামী নির্বাচন অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও প্রযোগিতাপূর্ণ হবে?

যেভাবে, হরতাল, অবরোধ হচ্ছে এবং তার বিপরীতে পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে ভয়ের সংস্কৃতির পরিবেশ জারি রয়েছে, তাতে ভোটারদের কাছে নির্বাচন কি উৎসবমুখর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে? আমরা কথায় কথায় বলি, 'মর্নিং শো'জ দ্য ডে'। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যে 'মর্নিং' দেখা যাচ্ছে তাতে তো কেবলই ভয়, শঙ্কা আর হতাশার উপস্থিতিই বাড়াচ্ছে। এই অবস্থায় অমর্ত্য সেন একটা মানসম্পন্ন নির্বাচনের জন্য যে জরুরি চার বিষয় হাজির করেছেন তার কোনো-কোনোটি হয়তো পূরণ হচ্ছে, সবগুলো পূরণ হওয়ার কোন সুযোগ বা সম্ভাবনা কি রয়েছে? অথচ অমর্ত্য সেন কিন্তু স্পষ্ট করেই বলেছেন একটা ভালো নির্বাচনের জন্য, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য উপর্যুক্ত চারটি শর্তই পূরণ করা জরুরি। এর কোনো একটা বাদ গেলে সেই নির্বাচন গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নয়।

কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও গবেষক।

kazal123rashid@gmail.com

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments