যুক্তরাষ্ট্র কতজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে স্যাংশন দিলো?

বক্তিগত পর্যায়ে কে স্যাংশন পেলেন, কার ভিসা আটকে গেলো, কোন কোন সাংবাদিকের নাম তালিকায় থাকলো, কার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হলো—সেটি চূড়ান্ত বিচারে দেশের জন্য বড় কোনো খবর নয়। কিন্তু এই ইস্যুতে যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যি সত্যিই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বড় কোনো ব্যবস্থা নেয়, যা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে—সেটি সবার জন্যই দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে।
সাংবাদিকের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন

'নির্বাচনে যারাই বাধা দেবে—সরকারি দল, বিরোধী দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারবিভাগের সদস্য কিংবা গণমাধ্যমকর্মী—সবার বিরুদ্ধেই ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ হবে।' মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের ঊদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশ ও প্রচারের পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের নাম ও ছবি দিয়ে ট্রল করা হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র এই সাংবাদিকদের ওপর ভিসা স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

অথচ যাদের ব্যাপারে এই কথা বলা হচ্ছে, তাদের মধ্যে কতজন যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান কিংবা ভিসার জন্য আবেদন করেছেন অথবা ভবিষ্যতে করবেন—তা নিশ্চিত নয়। কেননা, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে যেতে চান না বা যার সেখানে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই; যার সন্তান বা পরিবারের কেউ পড়াশোনা বা অন্য কোনো প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন না এবং ভবিষ্যতেও যার সেখানে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই—তার নাম স্যাংশনের তালিকায় থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না।

মার্কিন ভিসা নীতির আলোকে স্যাংশনের তালিকায় আছেন বা আসতে পারেন দাবি করে যেসব সাংবাদিকের নাম আসছে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র যদি সত্যিই বাংলাদেশের কোনো সাংবাদিকের ওপর ভিসা স্যাংশন দেয়, তার নাম তারা ঘটা করে প্রকাশ করবে না। তাহলে সোশ্যাল মিডিয়ায় কেন কিছু সাংবাদিকের নামে নিয়ে আলোচনা বা রসিকতা হচ্ছে?

এর প্রধান কারণ হলো, যাদের নাম, পরিচয় ও ছবি দিয়ে ওই তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে, তাদের অনেকেই সরকারের ঘনিষ্ঠ বা সরকারপন্থি সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। অতএব এটা বোঝাই যাচ্ছে যে, সরকারবিরোধী কোনো গোষ্ঠী এই তালিকাটি তৈরি করেছে নিজেদের সুবিধার জন্য। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যদি স্যাংশন দেওয়ার জন্য সাংবাদিকদের তালিকা তৈরি করতে বলে, তাহলে তারা ওই সাংবাদিকদের নাম লিখবেন। কারণ ওই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ আছে।

যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য এই তালিকা করেছেন, তারা মনে করেন ওই সাংবাদিকরা 'সরকারের দালাল' এবং সরকারের সব অন্যায় কাজের সহযোগী। অতএব এই সাংবাদিকদের ভিসা স্যাংশন পাওয়া উচিত বলে মনে করেন।

আবার এটাও ঠিক যে, যেসব যুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র রাজনীতিবিদ, আমলা এবং সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে বলে মনে হয়, সেই যুক্তিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া তালিকার মধ্যে অনেক সাংবাদিক থাকতেই পারেন। কিন্তু মূল প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কি নির্দিষ্ট করে কোনো সাংবাদিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে, নাকি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর? যুক্তরাষ্ট্র কি আদৌ কোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বা সাংবাদিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়?

এটি হয়তো অস্বীকার করা যাবে না যে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় গণমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা অনেক কমেছে। রাজনীতি, নির্বাচন, গণতন্ত্র, দুর্নীতি ইত্যাদি ইস্যুতে গণমাধ্যমের যে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের কথা ছিল, সেটি অনেক সংবাদমাধ্যম করেনি—এই অভিযোগ জনপরিসরে প্রবল।

আবার এটাও ঠিক যে খুব বিপ্লবী হয়ে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে গিয়ে যেকোনো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল। কয়েকটি শক্তিশালী গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান হয়তো কাজটি করতে পারছে। কিন্তু সবার আর্থিক সক্ষমতা এবং প্রতিষ্ঠান মালিক ও তার সঙ্গে যুক্ত নীতিনির্ধারকদের নৈতিক জোর সমান নয়। নয় বলেই অনেক গণমাধ্যমই হয়তো 'সাহসী সাংবাদিকতা' করতে পারছে না। খুব ক্রিটিক্যাল সমালোচনা করতে পারছে না।

এটিও ঠিক যে দিন শেষে সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদের জন্য মানুষকে সোশ্যাল মিডিয়া নয়, গণমাধ্যমের কাছেই আসতে হয়। কিন্তু গণমাধ্যমের ভেতরের বাস্তবতা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন এবং সোশ্যাল মিডিয়া দিয়ে পুরো দেশ ও বিশ্বকে বোঝা সম্ভব নয়।

এটি হচ্ছে মুদ্রার একপিঠ। অন্যপিঠ হলো, যুগে যুগে এরকম অনেক সাংবাদিক ছিলেন এবং এখনো আছেন, যারা সব সময়ই ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী। ক্ষমতাসীনদের প্রশংসা করে, তাদের সব কাজের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেন। ফলে সত্যিই কোনো সাংবাদিকের নাম যদি মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকে, তাহলে ওই ধরনের সাংবাদিক, অর্থাৎ যারা ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগী—তাদের জন্য এটি বরং শাপেবর হতে পারে।

কেননা, তারা এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও সরকারের পক্ষের লোক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি পাবেন। আগামীতে আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় এলে তারা সরকারের কাছে থেকে নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা নিতে পারবেন। যারা আগে সুবিধা নেননি, তাদেরও পথ পরিষ্কার হবে।

আর সরকার পরিবর্তন হলে সাময়িক সময়ের জন্য তারা হয়তো কিছুটা অসুবিধায় পড়বেন, কিন্তু রাজনীতির পালাবদলে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর দিয়ে যে ঝড়টা বয়ে যায়, তার সিকি ভাগও ব্যবসায়ী, সাংবাদিক, পুলিশ ও আমলাদের ওপর দিয়ে যায় না। কেননা তারা পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেন। অনেকেই রঙ বদলে ফেলেন। একসময় যারা সরকারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, সরকার বদল হলে দেখা যায় তারাই আবার সেই সরকারের সমালোচনায় ‍মুখর হয়ে ওঠেন।

সুতরাং মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার তালিকায় কতজন সাংবাদিকের নাম আছে কিংবা আদৌ কোনো সাংবাদিককে তারা তালিকাভুক্ত করেছে কি না; করলেও সেটি প্রকাশিত হবে কি না—সেটি সময়ই বলে দেবে। এটি খুব বড় কোনো ইস্যু নয়। একইভাবে কোনো রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও যদি ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়, সেটিও দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য কী কী ক্ষতি বয়ে আনবে—সেটি চট করে বলা অসম্ভব, যদি না সেই নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থ জড়িত থাকে।

মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ প্রায় ১৮ কোটি ভোক্তার বাজার এবং এই বাজারের অধিকাংশ মানুষই কর্মক্ষম। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সুবিধা ভোগ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও বাংলাদেশের অংশ আছে। পৃথিবীটা এখন 'একলা চলো' নীতিতে চলে না, সবাইকে নিয়ে চলতে হয়। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয়ই  বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমন কোনো ব্যবস্থা নেবে না, যা এ দেশের অর্থনীতিকে বিপন্ন করবে।

আবার এটাও ঠিক যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কিংবা তাকে চটিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ খুব বেশি কিছু অর্জন করতে পারবে না। কেননা যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়, সেটি তার মিত্র দেশগুলোও অনুসরণ করে। তার মানে যুক্তরাষ্ট্রের ওই সিদ্ধান্ত হয়তো কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং ইউরোপে তার মিত্র দেশগুলোও প্রয়োগ করবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার সীমারেখা কেবল তার নিজের দেশেই সীমাবদ্ধ নয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বাস, আস্থা ও সমঝোতায় বড় রকমের ছন্দপতন হয়েছে। এই ছন্দপতনের মূলে একাধিক কারণ থাকলেও মূলত যুক্তরাষ্ট্র যে দাবিটি করছে যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য—সেই দাবি দেশের অধিকাংশ মানুষেরই।

বিগত দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন যেভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থাটি যেভাবে বিতর্কিত হয়েছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। এই কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে সরকার, তথা সরকারি দলকেই।

বক্তিগত পর্যায়ে কে স্যাংশন পেলেন, কার ভিসা আটকে গেলো, কোন কোন সাংবাদিকের নাম তালিকায় থাকলো, কার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হলো—সেটি চূড়ান্ত বিচারে দেশের জন্য বড় কোনো খবর নয়। কিন্তু এই ইস্যুতে যদি যুক্তরাষ্ট্র সত্যি সত্যিই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বড় কোনো ব্যবস্থা নেয়, যা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে—সেটি সবার জন্যই দুর্ভাগ্য ডেকে আনবে।

দিন শেষে ব্যক্তির চেয়ে দল এবং দলের চেয়ে দেশ বড়—সেই চিরন্তন সত্যটিই বিবেচনায় রাখা দরকার।

'আমরা ভিসা নীতিকে পাত্তা দেই না' বা 'পরোয়া করি না'—এরকম সাহসী কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিবিদ তথা সরকার ও ক্ষমতাসীন দলকে এটিও নিশ্চিত করতে হবে যে, বাংলাদেশের নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাবে না। সাহস পাবে না।

আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English

Dhaka board chairman announces resignation amid protests

Amid the ongoing protest for reevaluation of HSC results by a group of students, Dhaka Board Chairman Prof Tapan Kumar Sarkar announced his resignation today

5h ago