ব্রিকসের সম্প্রসারণ ও ভূ-রাজনীতির স্বার্থ-সমীকরণ

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলন শেষ হলো। নানা বিবেচনায় ব্রিকসের এবারের সম্মেলন বিশ্ব সংবাদের আলোচনা কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। ব্রিকস ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত এক অর্থনৈতিক জোট, যা জি-৭, জি-২০'র মতোই আরেকটি অর্থনৈতিক বলয়।

এই জোটগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শগত অবস্থানে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য আছে। এগুলোর অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ-সমীকরণও যে এক রকম নয়, বরং কখনো কখনো বিপরীতমুখী, সেটা ব্রিকসের বর্তমান সদস্যদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চরিত্র বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন: বিশ্বের বৃহৎ পরাশক্তি, জোট বলয়ের সঙ্গে এদের কারো কারো বোঝাপড়া, সম্পর্ক, বিরোধ সমান্তরাল নয়। এদের ভূ-রাজনীতি ও বাণিজ্যের সমীকরণ পারস্পরিক স্বার্থ-সুবিধার ওপর নির্ভরশীল।

চীন-রাশিয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত 'ব্রিকস' জি-৭ এর বিকল্প একটি শক্তিশালী বিশ্ব প্লাটফর্ম হয়ে উঠুক। এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার স্থলে একটি ভারসাম্যমূলক বা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অবস্থা তৈরি হোক, যাতে করে বিশ্ব বাণিজ্য, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির শক্তি, ক্ষমতা ও আধিপত্যে যে যার স্বার্থ-সুবিধা বজায় রাখতে পারে।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন জোহানেসবার্গের সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে বলেন, 'ব্রিকস সত্যিকার অর্থে একটি বহুমুখী ও ন্যায়ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা গঠনের পক্ষে কাজ করছে। ডলারের একক আধিপত্যের দিন শেষ। কঠিন হলেও ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে একটি একক মুদ্রা চালুর লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যাব।'

চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং বলেন, 'চীন ইতিহাসের সঠিক পথেই অবস্থান করছে। তাদের প্রকৃতিতে আধিপত্য বলে কিছু নেই।'

ব্রিকস নেতৃত্বের মধ্যে এমন প্রত্যাশা থাকলেও জোটভুক্ত দেশগুলোর রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশগুলোর আভ্যন্তরীণ নীতির পরিবর্তন ঘটতে পারে বা ঘটবে। যেমন: ব্রিকসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য লুলা ডি সিলভা ব্রিকসের পক্ষের একজন অন্যতম জোরাল বক্তা। রাজনৈতিক মতাদর্শগতভাবে তিনি পশ্চিমা শক্তির প্রিয়ভাজন নন, তাকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে মার্কিনিরা নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। যে কারণে তাকে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকতে হয়েছে, জেলে থাকতে হয়েছে।

ব্রাজিলের লুলা কখনো কখনো পশ্চিমের গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেন, আবার একইসঙ্গে তিনি এক স্বাধীন গ্লোবাল সাউথের পক্ষে জোরাল কণ্ঠস্বর। এই ভিন্নভিন্ন কৌশলগত অবস্থানের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার মতো কঠিন কাজটি তাকে করতে হবে। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিদ্যমান শৃঙ্খলাকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ না চাইলেও তার সংস্কার, পরিবর্তন যে চান, সেটা সর্বজনবিদিত।

ভারতও ব্রিকসের সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। তাদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের একটি শক্তিশালী কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। যদিও ভারত এখনো গ্লোবাল সাউথের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।

ব্রিকস সম্মেলনে এবারের এজেন্ডা যাই থাক, আলোচনা মূলত আটকে ছিল ব্রিকসের এক্সটেনশন বা নতুন সদস্য গ্রহণের নীতি-কৌশল বিষয়ে। তিন দিন এই সম্মেলনের বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল—কোন দেশকে ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, আর কোন দেশকে করা হবে না, সেই আলাপে।

জানা যায়, ব্রিকসের সদস্য হতে ২২টি দেশ আবেদন করেছিল। এর মধ্যে থেকে ৬টি দেশকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। দেশগুলো হচ্ছে—সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা, মিশর ও ইথিওপিয়া। নতুন দেশগুলোর সদস্যপদ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। ব্রিকস তথ্যকেন্দ্র জানিয়েছে, ভবিষ্যতেও ব্রিকসে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করে এর সম্প্রসারণ ঘটানো হবে।

যে নীতিমালার ভিত্তিতে ব্রিকসের সম্প্রসারণ ঘটানো হোক না কেন, এই জোট ছোট-বড় অর্থনীতির গণতান্ত্রিক, কর্তৃত্ববাদী, রাজতান্ত্রিক, ধর্মভিত্তিক শাসনব্যবস্থার একটি সম্মিলিত ব্লক।

লুলা ব্রিকসের সদস্য পদের জন্য আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করলেও আর্জেন্টিনা দক্ষিণ আফ্রিকায় তাদের কোনো প্রতিনিধিদল পাঠায়নি। এমনকি প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজকে সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি সেখানে উপস্থিত হননি। দেশটির অর্থমন্ত্রী তখন আইএমএফের ঋণের জন্য প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের দরবার করছিলেন। সেই সময় আর্জেন্টিনার এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মন্তব্য করেন, আইএমএফ ও ব্রিকস দুটি এক বিষয় নয়, ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার বলয়। বাংলাদেশও আইএমএফের ঋণ ও পশ্চিমা শক্তির সঙ্গে অনেকভাবে সংশ্লিষ্ট। এটাও ব্রিকসের জন্য একটা বিবেচনার বিষয়।

অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় আর্জেন্টিনার নির্বাচনে প্যাট্রিসিয়া বুলরিচ রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী। তিনি আর্জেন্টিনার ব্রিকস জোটে যোগদানের ঘোর বিরোধী। দেশটির উদারপন্থি প্রার্থী জাভিয়ের মাইলেইও বুলরিচের সুরেই কথা বলেছেন। তারা ইরানের সঙ্গে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংযোগেরও বিপক্ষে।

গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে—বাংলাদেশ কেন প্রথম ধাপে ব্রিকসের সদস্য পদ অর্জন করতে পারল না? এই সম্মেলন শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে যখন এটা নিয়ে তুমুল বিতর্ক হচ্ছে, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করলেন, 'বাংলাদেশ তো ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদনই করেনি।'

পত্রিকায় মন্ত্রীর এই বক্তব্য দেখার পর দেশ-বিদেশের মিডিয়ার মাধ্যমে জানলাম, বাংলাদেশ গত ১৯ জুন ব্রিকসের সদস্য পদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে বাংলাদেশে এ বিষয়ে যোগাযোগও করেছে, সে সংবাদও পত্রিকায় আছে।

তার মানে কি বাংলাদেশ সদস্য না হতে পারার জন্য নিজেদের কূটনৈতিক দুর্বলতাকে ঢাকতে বিষয়টিকে এভাবে হালকা করছে? ২২টি দেশ ব্রিকসের সদস্য পদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করলেও তার মধ্যে থেকে ৬টি দেশকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। বাকিগুলোকে কী কারণে নেওয়া হয়নি, তার পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা ব্রিকস সূত্র থেকে দেওয়া হয়নি। তবে তারা ভবিষ্যতেও ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর কথা বলেছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ভারতের অনাগ্রহের কারণে নাকি বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্যপদ পায়নি। সম্ভবত ভারতের ওপর মার্কিনিদের একটা চাপ ও তাদের মধ্যে একটা কূটনৈতিক বোঝাপড়া ছিল। যেমন: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুন সদস্য গ্রহণের বিষয়ে বলেছেন, 'আন্তর্জাতিকে ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞার মুখে থাকা কোনো দেশকে ব্রিকসের সদস্য না করাটাই সমীচীন। বাংলাদেশ এখন যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘনের শর্তের মধ্যে আছে, অতএব তার এই প্রস্তাব বাংলাদেশের সদস্য পদের জন্য বাধা তৈরি করে। সে কারণেই বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য পদ না পাওয়ায় ভারতের ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে।

চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করলেও নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার দ্বি-পাক্ষিক কোনো বৈঠক হয়নি। বিশ্বনেতাদের সম্মানে দেওয়া নৈশভোজের সময় নরেন্দ্র মোদি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে কুশল বিনিময় করেন।

কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, 'ভারতকে যা দিয়েছি, সারা জীবন মনে রাখবে।' বাস্তবতা হচ্ছে ভারত তা মনে রাখেনি! এ জন্য কূটনৈতিক সম্পর্কে বলে, দ্বি-পাক্ষিক স্বার্থে একসঙ্গে সব দিতে নেই, পরবর্তী আলোচনা ও সুবিধা আদায়ের জন্য কিছু বিষয়-ইস্যু হাতে রাখতে হয়। কিন্তু আমাদের শাসকরা সে পথে হাঁটেননি।

বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হলে কোনো লাভ হতো কি না, তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত থাকলেও এ কথা বলা যায়, একটি অর্থনৈতিক জোটের অংশীদার হলে জাতীয় স্বার্থ উন্নয়নে বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তির সঙ্গে বোঝাপড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়, সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশ এখন অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি সংকটময় সময় পার করছে। স্ব-উদ্যোগেই তাদের সেখান থেকে উত্তরণের পথ বের করতে হবে।

ড. মঞ্জুরে খোদা: লেখক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments