আমরা এ কোন সিঙ্গাপুরে বাস করি?

কিছুদিন আগেও সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, যে বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আসলে আমরা কোন দিক থেকে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা ইউরোপের দেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছি। মোট দেশজ উৎপাদন বা (জিডিপি) নামক একটি মাত্র সূচক দিয়েই কি আমরা উন্নয়নকে বিবেচনা করছি। অথচ জিডিপি বাড়ছে, সেটি কিসের উপর ভিত্তি করে? অল্প কিছু মানুষের সম্পদ এত বেশি পরিমাণে বাড়ছে যে জিডিপির পরিমাণ প্রতি বছর বাড়ছে। ফলে একদিকে জিডিপি বাড়ছে, আর অন্যদিকে বাড়ছে আয় বৈষম্য। সরকারের তথ্যই কিন্তু এসব কথা বলছে। ফলে আমরা হয়তো, একদিন ঠিকই সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে যাব, কিন্তু সেটি চরম বৈষম্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।

একমাত্র জিডিপির হিসাব বাদ দিয়ে যদি মানুষের জীবন মানের বিভিন্ন খাতের দিকে দৃষ্টি দিই তাহলে কী দেখা যায়। স্বাস্থ্যসেবার কথাই ধরা যাক। একজন সাধারণ মানুষ যখন কোনো ধরনের স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারি হাসপাতালে যান, তখনই বুঝতে পারেন যে তিনি এ কোন সিঙ্গাপুরে বাস করেন। আমাদের নীতি নির্ধারকরা সাধারণ মানুষের এই ব্যথা বুঝতে পারবেন বলে আমার মনে হয় না। কারণ তারা এসব সেবা নিতে সরকারি হাসপাতালেই যান না। তারা যেসব বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা নেন যেখানে টাকার বিনিময়ে স্বাস্থ্যসেবা মেলে। যেখানে সাধারণ মধ্যবিত্তদের যাওয়ার মতো বা ওই সেবার খরচ বহন করার ক্ষমতা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকরা এখন বেসরকারি হাসপাতালেও যান না। সোজা বিদেশে চলে যান। কারণ বেসরকারি হাসপাতালের সেবার উপরও তাদের ভরসা নেই।

গত শুক্রবার আরটিভির সাংবাদিক আবুল হাসানের ছোট ছেলে তাশনিফ আহনাফ মারা গেছেন ডেঙ্গুতে। তিনি অভিযোগ করেছেন যে, তিনি যখন রাত ৩টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আসেন তখন সেখানে কোনো জ্যেষ্ঠ ডাক্তার না থাকায় কর্তব্যরত ডাক্তাররা প্লাটিলেট কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো চিকিৎসা দিতে পারেননি। এমনকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শুরুতে অক্সিজেন দেওয়ার ক্ষেত্রে গড়িমসি করেছে। শেষ পর্যন্ত সকালে যখন জ্যেষ্ঠ ডাক্তাররা আসেন, ততক্ষণে আহনাফের অবস্থা শেষ। এই হচ্ছে বাংলাদেশের সিঙ্গাপুর মানের স্বাস্থসেবার নমুনা।

সেদিন পত্রপত্রিকায় দেখলাম আমাদের সিটি করপোরেশনের মেয়র কিছু বাড়ির মালিককে জরিমানা করছেন তাদের বাড়ির পাশে বা গ্যারেজে এডিস মশার লার্ভা পাওয়ার কারণে। এটি ঠিক যে এডিস মশা নিধনে সাধারণ মানুষের সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু মেয়র সাহেব আপনার কি দায়িত্ব নেই এডিস মশা নিধনে। আপনি কি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন? সেটির বিচার করে আপনাকে জরিমানা করবে কে? যেহেতু আপনার পদে বসার জন্য এখন আর সাধারণ জনগণের মুখাপেক্ষী হতে হয় না, তাই ভাবছেন বিচার করার কেউ নেই? বাড়ির মালিকদের উপর দায় চাপিয়ে দিব্যি জরিমানা করে বেড়াচ্ছেন। মেয়র সাহেব, যার সন্তান মারা গেছে সে বোঝে তার ব্যথা। আমি আবুল হাসানের ব্যথা বুঝি, তার ছয় বছরের বাচ্চা হারানোর শোক বুঝি। গত ১০ দিন আমি নিজের বাচ্চাকে নিয়ে যে শঙ্কা আর ভয়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি এ শঙ্কায় আমার মতো অনেক বাবাই ছিলেন, আছেন। আপনারা মানুষের ব্যথা বোঝেন না, কারণ এসব রোগ আপনাদের কাছে আসারও সাহস করে না। দয়া করে এই শোক সন্তপ্ত পরিবারগুলোর ব্যথা বোঝার চেষ্টা করে আপনার দায়িত্ব আপনি পরিপালন করুন।

এত গেল স্বাস্থ্যসেবার সিঙ্গাপুরীয় নমুনা। শুধু স্বাস্থ্যসেবাই নয় দেশের যে কোনো সরকারি সেবা নিতে গেলেই বোঝা যায় আমরা এখনও কতটা অনুন্নত, দুর্নীতিপ্রবণ দেশে বাস করি। এখানে সুলভে সরকারি সেবা নিশ্চিত হতে গেলে লাগে ক্ষমতা, তদবির। যদি ক্ষমতা থাকে, তাহলে আপনার জন্য সরকারি সেবা ঘরের দুয়ারে অপেক্ষা করবে। ঠিক উন্নত দেশের মতোই। সেটি হোক সরকার দলীয় ক্ষমতা, কিংবা প্রশাসনিক ক্ষমতা। সুতরাং যারা ক্ষমতাবান তারা এদেশকে সিঙ্গাপুরের সাথে তুলনা দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, বৈকি। এজন্যই মানুষের মধ্যে ক্ষমতার লোভও প্রবল। যতদিন পর্যন্ত এই তদবিরভিত্তিক সেবা ব্যবস্থার বিলোপ হবে না, ততদিন পর্যন্ত এই সিঙ্গাপুরকে ছাড়িয়ে আরও উন্নত হবে, তবে সেটি গুটি কয়েক মানুষের জন্য। সবার জন্য নয়।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার।

Comments

The Daily Star  | English

Tax authority to split. Will it bring the desired outcome?

Touted as a historic overhaul, the move has ignited debate over whether it will drive meaningful reform or merely deepen the layers of bureaucracy, given the NBR's persistent failure to meet its targets.

14h ago