সিলেটে হারলেন কিম, নদিয়ায় কি তারক ঘোষ জিতবেন?
পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় জলঙ্গি নদী বাঁচানোর দাবি নিয়ে কৃষ্ণনগরের একটি পরিবেশবাদী সংগঠন তাদের মনোনীত একজন নির্দলীয় প্রার্থীকে ভোটে দাঁড় করিয়েছে। কৃষ্ণনগর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জলঙ্গি নদী নদিয়া জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলরেখা। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত দূষণ-দখলে এটি এখন বিপন্ন।
নদীটিকে বাঁচাতে কৃষ্ণনগরে যেসব আন্দোলন গড়ে উঠেছে, 'জলঙ্গি নদী সমাজ' তার অন্যতম। তারা এবার পঞ্চায়েত নির্বাচনে নদিয়া জেলা পরিষদের ২৪ নম্বর আসনের জন্য তারক ঘোষ নামে একজন নদীকর্মীকে প্রার্থী করেছে। তাদের স্লোগান— 'নদীর জন্য চাইছি ভোট'। তারক ঘোষ জলঙ্গি নদী পাড়ের একজন কৃষিজীবী মানুষ। সেইসঙ্গে রংমিস্ত্রি হিসেবেও কাজ করেন। তারক ঘোষ ভোটে জিতবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে।
তবে এই প্রসঙ্গ অবতারণার কারণ হলো—সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন। গত ২১ জুন অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে সিলেটের অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত ৪ নম্বর ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করেছিলেন আব্দুল করিম চৌধুরী কিম। নদী ও পরিবেশরক্ষা আন্দোলন করে যিনি সিলেট অঞ্চলে বেশ পরিচিত মুখ। তিনি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সিলেট শাখার সাধারণ সম্পাদক। তিনি ভোটে হেরে গেছেন। এই ওয়ার্ডে কাউন্সিলর হয়েছেন সাবেক যুবলীগকর্মী শেখ তোফায়েল আহমেদ শেফুল।
ভোটের ফলাফল প্রকাশের পরে আব্দুল করিম কিম ফেসবুকে লিখেছেন, 'ভোটের রাজনীতি আমার মতো মানুষের জন্য নয়। আমি হেরেছি বা হারিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাকে হারিয়ে কূটরাজনীতির কুশীলবেরা জয়ী হয়েছেন। নির্বাচনের এই পরাজয়ে আমি মোটেও ব্যথিত নই। তবে পরাজয়ের পেছনের কিছু কারণে বিস্মিত হয়েছি।'
কিম কেন হেরে গেলেন বা কেন জিততে পারলেন না, তার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু তিনি যে লিখলেন 'ভোটের রাজনীতি আমার মতো মানুষের জন্য নয়'—এই 'আমার মতো মানুষ' বিষয়টি নিয়েই এই লেখা।
রাজনীতির অঙ্ক যে বড়ই জটিল এবং এ দেশের মানুষের ভোটের দর্শন যে অদ্ভুত, সেটি প্রতিটি নির্বাচনেই টের পাওয়া যায়। জনপরিসরে সব সময়ই যে আলোচনাটি থাকে তা হলো, ভালো মানুষেরা রাজনীতিতে আসে না বলে খারাপ লোকেরা ওই শূন্যস্থান পূরণ করে। অথচ সেই ভালো মানুষেরা ভোটে দাঁড়ালে অনেক সময় তাদের জামানতও থাকে না। কেননা ভোট এখন পুরোপুরি দল ও মার্কানির্ভর। যে নির্বাচনে যে দলের প্রার্থীর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি অথবা মোটামুটি নিশ্চিত, সেই নির্বাচনে ওই দলের প্রার্থী হিসেবে একটি 'কলা গাছ' দাঁড় করালেও তিনি জয়ী হবেন। সম্ভবত 'ভোট টু বানানা ট্রি' কথাটা এখান থেকেই এসেছে। অর্থাৎ ব্যক্তি কোনো বিষয় নয়; মূল কথা দল ও মার্কা। সেই মার্কা নিয়ে যিনি দাঁড়াবেন—তিনিই জয়ী হবেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো দলীয় প্রতীকে হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যক্তির পরিচয়ে কিছু মানুষ জয়ী হতেন। অর্থাৎ তাদের কোনো দলীয় পরিচয় না থাকলেও, কোনো দলের প্রতি নিঃশর্তভাবে আনুগত্যের ঘোষণা ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলেও শিক্ষা-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণে ব্যক্তিমানুষ হিসেবে কমিউনিটিতে তারা শ্রদ্ধাভাজন ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে অনেকেই নির্বাচনে জয়লাভ করতেন। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচনটিও যেদিন থেকে দলীয় প্রতীকে শুরু হলো, সেদিন থেকেই এ নির্দলীয় ভালো মানুষদের জন্য জনপ্রতিনিধিত্ব করার দিন শেষ হলো। কারণ কোনো দলের প্রতি নিঃশর্তভাবে আনুগত্য প্রদর্শন এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে এবং পয়সার খেলা দেখিয়ে টিকে থাকার মতো ক্ষমতা ও রুচি তাদের থাকে না। থাকে না বলে তারা আর নির্বাচনে আগ্রহবোধ করেন না। উপরন্তু ভোট যখন দলীয় প্রতীকে হয় এবং বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত, ফলে দলীয় প্রতীকের নির্বাচনে একজন নির্দলীয় ভালো মানুষ সংখ্যালঘুতে পরিণত হন। তার জয়ের সম্ভাবনা থাকে না বললেই চলে। কালেভদ্রে দুয়েকজন বেরিয়ে যান। কিন্তু সেটি অনুল্লেখ্য। এসব কারণে জাতীয় সংসদ তো বটেই, স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মেয়র ও কাউন্সিলর বা মেম্বার পদেও নির্দলীয় ব্যক্তিরা সচেতনভাবেই নির্বাচন থেকে নিজেদের দূরে রাখেন।
মানুষের ভোটের সংস্কৃতিও এমন অদ্ভুত যে, তারা ভালো মানুষদের দেখলে সালাম দেবে ঠিকই, কিন্তু ওই লোকটিই নির্বাচন করলে তাকে ভোট দেবে না। প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে খ্যাত হুমায়ুন আজাদের প্রবচনগুচ্ছের প্রথমটা এরকম: 'মানুষ সিংহের প্রশংসা করে, কিন্তু আসলে গাধাকেই পছন্দ করে।' এটিকে একটু ঘুরিয়ে এভাবে বলা যায়: মানুষ সৎ লোককে পছন্দ করে, আসলে ভোট দেয় পয়সাওয়ালা লোককে। কারণ ভোট দেওয়ার সময় তার মাথায় অন্য আরও অনেক হিসাব কাজ করে।
মানুষ আসলে চায় যে সে যখন কোনো সমস্যায় পড়বে, তার জনপ্রতিনিধি তাকে টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করবে। সেই টাকার উৎস কী; জনপ্রতিনিধির সেই টাকাটি প্রকারান্তরে জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় পরিচালিত উন্নয়ন কাজ থেকে চুরি করা অর্থ কি না; সেই দানের টাকাটি লুটের অর্থ কি না; মাইকিং করে শত শত লোককে জাকাতের শাড়ি-কাপড় দেওয়া কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেওয়া অনুদানের টাকার উৎসগুলো অবৈধ কি না—এসব প্রশ্ন মানুষ করতে চায় না। তারা জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতিকের পরোপকারী চেহারাটিই দেখে এবং সেটির প্রশংসা করে।
পক্ষান্তরে যে ভালো মানুষ জীবনে অসৎ পথে পয়সা উপার্জন করেননি বা সেই যোগ্যতাও যার নেই, তিনি ভোটে দাঁড়ালে মানুষ তাকে ভোট দিতে নিরুৎসাহিত হয়। কারণ মানুষ জানে তার যেহেতু অবৈধ পয়সা নেই, অতএব তিনি সেভাবে মানুষকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত পেশাদার রাজনীতিবিদরা যেভাবে অভিনয়কলা ও চাপাবাজির জোরে দ্রুতই সাধারণ মানুষকে অনেক ভুলভাল কথা বলে তাদের মনে জায়গা করে নিতে পারেন, একজন সৎ-শিক্ষিত-সজ্জন ও রুচিবান মানুষের পক্ষে ওইরকম চাপাবাজি করে জনপ্রিয় হওয়া সম্ভব নয়। বরং তিনি কথা বলার আগে ভাবেন এটি বলা উচিত হবে কি না। এই ঔচিত্যবোধ তাকে রাজনীতি ও ভোটের মাঠে পিছিয়ে দেয়। তিনি অশিক্ষিত, চাপাবাজ, লুটেরা ও মাস্তান পলিটিশিয়ানের কাছে হেরে যান। আবার তার সঙ্গে জয়ী হওয়ার জন্য বাড়তি যেসব যোগ্যতার প্রয়োজন—সেই যোগ্যতাগুলোও একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ অর্জন করতে চান না। ফলে তিনি নিজেই আর ওই অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন না। হন না বলেই তার শূন্যস্থান পূরণ করে নেয় খারাপ লোকেরা এবং জনপরিসরে এই আক্ষেপেরও অবসান হয় না যে, ভালো মানুষেরা রাজনীতিতে আসে না। অথচ ভালো মানুষদের রাজনীতি করা বা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হওয়ার মতো পরিস্থিতিই যে তৈরি হয়নি বা শেষ হয়ে গেছে; ভোটারদের বিরাট অংশই যে সিংহের প্রশংসা করলেও গাধাকেই ভোট দেয়—সেই বাস্তবতাটিও অস্বীকারের সুযোগ নেই।
তাহলে সমাধান কী? সমাধান হলো রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিবর্তন। রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে এবং স্থানীয় উন্নয়নগুলো এতটাই পদ্ধতিগতভাবে পরিচালিত হবে যে সেখানে জনপ্রতিনিধির মাস্তানি করার প্রয়োজন পড়বে না। সমাজের দরিদ্র মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধাগুলো বণ্টনের পদ্ধতি এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যে, সেখানে কোনো ধরনের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ থাকবে না। আর্থিক খাতে দুর্নীতি বন্ধে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীল নীতি শুধু কেতাবি কথায় নয়, বরং কাজে প্রমাণ করতে হবে। এগুলো করা গেলে তখন জনপ্রতিনিধি হিসেবে অবৈধ পয়সাওয়ালা এবং পেশি শক্তির অধিকারী দলীয় মাস্তানদের বাইরে সত্যিকারের সৎ ও আদর্শবান মানুষেরা রাজনীতিতে আসতে উৎসাহী হবেন।
কিন্তু একটি খারাপ সিস্টেম এবং পরিবার ও মাফিয়াতন্ত্রের দ্বারা পরিবেষ্টিত মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো দেশের রাজনীতিতে আদৌ কোনো গুণগত পরিবর্তন চায় কি না—সেটিই বিরাট প্রশ্ন।
সর্বোপরি, সিলেট সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে হেরে গেছেন বলে আব্দুল করিম কিম নদী ও প্রাণ-প্রকৃতি সুরক্ষার আন্দোলন থেকে সরে যাবেন, বিষয়টি এমন নয়। বরং আমাদের প্রত্যাশা, তার আন্দোলন ও সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে এবং তিনি কেন হেরে গেলেন, নির্মোহভাবে তার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করবেন। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই শুভবোধের উদয় হওয়া প্রয়োজন যে, যারা তার পরিবেশ ও প্রাণপ্রকৃতির সুরক্ষায় কাজ করেন; যারা দেশটাকে সত্যিই ভালোবাসেন; বিপুল বিত্তবৈভব ও পেশি শক্তি না থাকলেও যাদের একটি সংবেদনশীল মন আছে—সেসব মানুষ যদি জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন—সেটি দেশের জন্যই কল্যাণকর। অতএব সিলেটে কিম হেরে গেলেও পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় জলঙ্গি নদী বাঁচাতে তারক ঘোষ নামে যে কৃষক কাম রংমিস্ত্রি প্রার্থী হয়েছেন, তার জন্য শুভকামনা।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments