সাংবাদিকতা করতে প্রেস কাউন্সিলের সনদ লাগবে কেন?
বলা হয়, বাংলাদেশে সবচেয়ে সহজ কাজ হলো 'সাংবাদিক' হওয়া। একজন সিনিয়র সাংবাদিক একবার এক অনুষ্ঠানে রসিকতা করে বলেছিলেন, ঢাকা শহরের সবচেয়ে উঁচু ভবনের ছাদ থেকে একটি ছোট ইটের টুকরো নিচে পড়ে গেলে সেটি নির্ঘাৎ 'প্রেস' বা 'সাংবাদিক' লেখা কোনো গাড়িতে গিয়ে পড়বে।
সাংবাদিকের সংখ্যা বেশি হওয়াটা হয়তো মন্দ নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, যারা নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দেন বা দাবি করেন; সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে নানাবিধ অবৈধ কাজকর্ম করেন—সেই সংখ্যাটা কত? যারা নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দেন বা যাদের প্রেস কার্ড আছে, তাদের মধ্যে প্রকৃত সাংবাদিক কত শতাংশ? সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন এমন মানুষের সংখ্যাই বা কত?
শুধু তাই নয়, মূলধারার গণমাধ্যমে কাজ করেন, এমন সাংবাদিকদের মধ্যেই বা কতজন সত্যিকারার্থে সাংবাদিক হওয়ার যোগ্যতা রাখেন—সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এরকম বাস্তবতায় একটি খবর নতুন করে কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ নিজামুল হক নাসিম সম্প্রতি বলেছেন, সাংবাদিক পরিচয় দিতে প্রেস কাউন্সিলের সনদ পেতে হবে। তিনি বলেছেন, 'সারা দেশের সাংবাদিকদের ডেটাবেজ তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। মফস্বল সাংবাদিকদের ডেটাবেজ তৈরির জন্য আমরা জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছি। ডেটাবেজ তৈরির ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে যাচাই-বাছাই করা হবে। যাচাই-বাছাই শেষে বার কাউন্সিলের মতো আমরা প্রকৃত সাংবাদিকদের সনদ দেবো। এই সনদধারীরাই কেবল নিজেদের সাংবাদিক পরিচয় দিতে পারবেন।' তিনি জানান, সাংবাদিক পরিচয় দিতে গেলে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ধরা হয়েছে স্নাতক ডিগ্রি পাস। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে ৫ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের শিক্ষাগত যোগ্যতার এই শর্ত কিছুটা শিথিল থাকবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
দেশে সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতা, চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেইলিং, প্রেস কার্ড বানিয়ে চাঁদাবাজি ও মাদক চোরাকারবারের অভিযোগও বেশ পুরোনো। হাল আমলে শুরু হয়েছে কথিত ডটকম ও ইউটিউব সাংবাদিকতা। এসব প্রতিরোধের জন্য শক্ত আইনি কাঠামো দরকার—এটি যেমন ঠিক, তেমনি সেই অপরাধ ঠেকানোর প্রক্রিয়াটি কী হবে, কারা ঠেকাবেন, যারা ঠেকাবেন তাদের যোগ্যতা ও নিরপক্ষেতা প্রশ্নাতীত কি না এবং সর্বোপরি তাদের নিয়ত বা উদ্দেশ্য ভালো কি না—সেটিও বোঝা দরকার। যে কারণে প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান যখন বলছেন যে তারা সাংবাদিকদের সনদপত্র দেবেন, তখন কিছু প্রশ্নও সামনে আসছে।
১. এই সনদ কারা পাবেন? প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম, যেমন: দৈনিক পত্রিকা ও টেলিভিশনের হেড অফিসে কর্মরত থেকে শুরু করে এসব প্রতিষ্ঠানের স্থানীয় প্রতিনিধি এবং সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় পর্যায় থেকে প্রকাশিত ও প্রচারিত সব গণমাধ্যমের কর্মীরা?
২. সাংবাদিক বলতে কাদেরকে বোঝানো হবে? যারা সরাসরি রিপোর্টিং ও এডিটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত তারা?
৩. সাংবাদিক পরিচয় দিতে গেলে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা স্নাতক ডিগ্রি পাস। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে ৫ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের শিক্ষাগত যোগ্যতার শিথিল থাকবে। প্রশ্ন হলো, একজন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ৫ বছর কোনো একটি অখ্যাত পত্রিকা বা অনলাইনে কাজ করলে তিনিও প্রেস কাউন্সিলের সনদ পাবেন? অর্থাৎ শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিলের এই সুযোগ অযোগ্য অনেকেই নেবেন।
৪. কোন প্রক্রিয়ায় এই সনদ দেওয়া হবে? অর্থাৎ কোনো পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে, নাকি নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হবে? আবেদনের পরে কোন প্রক্রিয়ায় এই সনদ পাওয়া যাবে? অনলাইনে নাকি প্রেস কাউন্সিলে সরাসরি গিয়ে এ সনদ সংগ্রহ করতে হবে?
৫. সনদ পাওয়ার জন্য কি ফি দিতে হবে? সেই ফি পরিশোধের প্রক্রিয়া কী হবে?
৬. যারা এখন সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত; দেশের খ্যাতনামা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন, তাদেরও কি এই সনদ নিতে হবে? তাদের সনদ প্রদানের প্রক্রিয়াটি কী হবে?
৭. বাংলাদেশের যে রাষ্ট্রীয় কাঠাামো এবং কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে সরকারি অফিসগুলো যেরকম দুর্নীতির আখড়া হিসেবে পরিচিত, সেখানে লাখো মানুষকে এই সনদ পেতে গিয়ে কী হয়রানি ও ঝামেলায় পড়তে হবে? শুধু ঢাকা শহর নয়, সারা দেশ থেকে, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যারা বিভিন্ন গণমাধ্যমপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন, যারা স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় কাজ করেন, তাদেরও কি সনদ পেতে ঢাকায় আসতে হবে?
যদি আসতে না হয়, তাহলে তাদের সনদ কে দেবে? এ জন্য কি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রেস কাউন্সিলের কার্যালয় স্থাপন করা হবে? নাকি স্থানীয় প্রশাসন বিষয়গুলো দেখবে? এমনিতেই সরকারি অফিস তথা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে অনেক সময় পেশাদার সাংবাদিকদের দূরত্ব থাকে। কারণ, তারা তথ্য দিতে চান না। বিশেষ করে অপরাধ সংশ্লিষ্ট খবরের কারণে প্রকৃত সাংবাদিকরা অনেক সময়ই স্থানীয় প্রশাসনের বিরাগভাজন হন। সেই প্রশাসনের কাছ থেকেই যদি সাংবাদিকদের সনদ সংগ্রহ করতে হয়, সেটি নতুন করে জটিলতার সৃষ্টি করবে। সুতরাং স্থানীয় পর্যায়ের লাখো সাংবাদিকের সনদ সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি কী হবে—সেটি পরিষ্কার হওয়ার দরকার।
৮. সরকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে যেকোনো সেবা পাওয়া সাধারণ মানুষ তো বটেই, সাংবাদিকদের জন্যও বিরাট চ্যালেঞ্জ। যেমন: সচিবালয়সহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় প্রবেশের জন্য সাংবাদিকদের যে অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড সংগ্রহ করতে হয়, সেটি পাওয়া এখন আগের চেয়ে অনেক কঠিন। প্রতিটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানকে আগে যে সংখ্যক কার্ড দেওয়া হতো, এখন সেটি অনেক কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সুতরাং প্রেস কাউন্সিলের সনদও যেহেতু একধরনের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড হবে, ফলে সেটি পাওয়ার জন্যও এরকম ভোগান্তি হবে কি না, সেটি নিয়ে এখনই কথাবার্তা বলা শুরু করা দরকার। বিশেষ করে এই সনদপত্র পাওয়া এবং না পাওয়ার মাঝখানে কোনো দালালচক্র ঢুকে যাবে কি না; কোনো অর্থের লেনদেন তথা অবৈধ অর্থের বাণিজ্য শুরু হবে কি না—সেদিকেও কড়া নজর রাখতে হবে। সর্বোপরি এই সনদ পেতে দলীয় রঙে রঙিন সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতা, প্রভাব ও ইন্ধন, দলবাজি ও তদবিরবাজি শুরু হবে কি না, সেটিও বড় উদ্বেগের জায়গা।
৯. প্রেস কাউন্সিলের এখতিয়ার শুধু সংবাদপত্রে। কিন্তু অপসাংবাদিকতা বেশি হয় অনলাইন মাধ্যমে। সেখানে কে সনদ দেবে? তারমানে কি শুধু পত্রিকার মানুষই সাংবাদিক পরিচয় দেবেন, আর টিভি ও অনলাইন মাধ্যমের সাংবাদিকদের যেহেতু সনদ থাকবে না, ফলে তারা সাংবাদিক পরিচয় দিতে পারবেন না? প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অবশ্য জানিয়েছেন, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়াও এই কাউন্সিলের আওতায় আনার কাজ চলছে। তার মানে, প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধন করতে হবে।
১০. সাংবাদিকতা করার জন্য প্রেস কাউন্সিল থেকে সনদপত্র নিতে হবে কেন? ২০২২ সালে 'গণমাধ্যম কর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল-২০২২' সংসদে উত্থাপন করা হয়েছে। এই প্রস্তাবিত আইনের কিছু ধারা নিয়ে সাংবাদিকদের তরফে আপত্তি জানানো হয়েছে। সম্ভবত সেই কারণে বিলটি আটকে আছে। কিন্তু সেই আপত্তির জায়গাগুলো পরিষ্কার করে এই বিলটি কেন দ্রুত পাস করা হচ্ছে না? গণমাধ্যমকর্মী আইন থাকলে তো সেখানে প্রেস কাউন্সিল থেকে সনদপত্র নেওয়ার প্রশ্ন থাকে না।
১১. তবে এসব ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি সামনে আসছে তা হলো, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এই পদ্ধতিতে সাংবাদিকদের সনদপত্র দেওয়া হয় কি না? অর্থাৎ সরকারি সংস্থার কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে সাংবাদিকতা করতে হয় কি না? উন্নত বিশ্ব এমনকি প্রতিবেশী ভারতের চর্চা কী? যদি সেসব দেশে না থাকে, তাহলে বাংলাদেশে কেন সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে সনদপত্র নিয়ে সাংবাদিকতা করতে হবে? অপসাংবাদিকতা রোধ করার জন্য? সেজন্য কি আর কোনো বিকল্প নেই?
সর্বোপরি, একটি আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্যে গণমাধ্যমকে ঢুকিয়ে দেওয়ার পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, সে বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মী এবং গবেষকদের এখনই কথা বলা শুরু করা উচিত এবং সংসদে যে বিলটি আটকে আছে, সেটি যাতে সাংবাদিকবান্ধব হয়, সেভাবে সংশোধন করে দ্রুত পাস করা উচিত।
আমীন আল রশীদ: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন
Comments