পরিবেশ দূষণ মোকাবিলায় বাজারভিত্তিক সমাধান জরুরি
অর্থনীতির ভাষায় দূষণকে সংজ্ঞায়িত করা হয় বাজার ব্যর্থতা হিসেবে। সব ধরনের পরিবেশ দূষণের মনুষ্যসৃষ্ট কারণ অর্থনৈতিক। আবার পরিবেশ দূষণের সমাধান অর্থনীতি ও রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। দূষণরোধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক সদিচ্ছারও প্রয়োজন। এ কারণেই সব দেশের সরকার, এনজিও, সিভিল সমাজ, সাধারণ জনগণ—সবাইকে একই উদ্যোগে সম্পৃক্ত করার উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সাল থেকে উদযাপিত হয়ে আসছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এ বছর প্লাস্টিক দূষণকে মূল প্রতিপাদ্য ধরে বিশ্ববাসীকে প্লাস্টিক ব্যাবহারে সচেতন করতে পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।
জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, বায়ু দূষণ ও নদী দূষণের মতো প্লাস্টিক দূষণ ও বর্তমান সময়ের অন্যতম সংকট। কিন্তু ১৯০৭ সালে প্রথম বার বেলজিয়ান বিজ্ঞানী লিও বাকেল্যান্ড যখন সিনথেটিক পলিমার তৈরি করে, তখন ধারণা করা হয়েছিল প্লাস্টিক পৃথিবীকে পাল্টে দিবে। সাশ্রয়ী ও স্থায়িত্ব বিবেচনায় প্লাস্টিককে মনে করা হয়েছিল প্রাকৃতিক কাঁচামালের অন্যতম বিকল্প, যা প্রাকৃতিক সম্পদের অতি আহরণ কমাবে। হয়েছিলও তাই। রান্না ঘর থেকে শুরু করে উড়োজাহাজ, সব ক্ষেত্রেই স্টিল, কাঠের বিকল্প হিসেবে শুরু হয়েছিল প্লাস্টিকের ব্যবহার। তাই ১৯৫০ সালের পরবর্তী সময়কে অনেক গবেষক প্লাস্টিক এজ বলেও অভিহিত করে থাকেন।
কিন্তু ক্রমান্বয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য হয়ে ওঠে ধরিত্রীর গলার কাঁটা। প্লাস্টিক দূষণ আজ এমন অবস্থায় এসেছ যে মানুষের ভ্রূণেও দেখা মিলছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের। বর্তমানে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়, যার শেষ পরিণতি নদী, খাল, বিল, জলাশয়, সমুদ্র, পাহাড়, পর্বত, বন। প্লাস্টিক আবিষ্কারের শত বছর পরে এসে প্লাস্টিকই অন্যতম বড় মনুষ্যসৃষ্ট দূষণ সমস্যা। প্লাস্টিক দূষণ মোকাবিলায় বাজারভিত্তিক দূষণ নীতির অনুপস্থিতি, প্লাস্টিক রিসাইক্লিং শিল্পের অপ্রতুলতা ও সচেতনতার অভাব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্লাস্টিক দূষণকে আরও প্রকট করে তুলেছে।
অর্থনীতির চাকা সচল রেখে, পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখতে সারা বিশ্বে দূষণ প্রতিরোধে মোটা দাগে ২ ধরনের পদ্ধতির প্রচলন দেখা যায়। 'কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল' পদ্ধতি এবং বাজারভিত্তিক বা অর্থনৈতিক পদ্ধতি। সব থেকে বেশি ব্যবহৃত 'কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল' পদ্ধতি এমন এক ব্যবস্থা যেখানে সরকার বা নীতিনির্ধারকেরা আইন বা নীতিমালা করে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের মানমাত্রা নির্দিষ্ট করে দেয়। বাংলাদেশে যেমন পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ২০২৩। কোন প্রকার শিল্পে তরল বর্জ্য পরিশোধনে, বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কী প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে, তা এই পদ্ধতির আওতায় নির্দিষ্ট করা থাকে। এখন কোনো শিল্প-কারখানা যদি নির্ধারিত মাত্রার থেকে বেশি দূষিত বর্জ্য প্রকৃতিতে ছেড়ে দেয়, সেক্ষেত্রে তাদের জরিমানা করা হয়, ক্ষেত্র বিশেষে পরিবেশ ছাড়পত্র বাতিলও করা হয়। এটাই 'কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল' পদ্ধতির নিয়ম। বাংলাদেশ দূষণ মোকাবিলায় এই পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল।
'কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল' পদ্ধতিতে দূষণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিল্প-কারখানার বা দূষণ উৎপাদকের কোনো ধরনের আর্থিক প্রণোদনা থাকে না। ফলে দূষণ সৃষ্টিকারীর একটা সাধারণ প্রবণতা থাকে কম খরচে দূষণের সর্বনিম্ন মানমাত্রা নিশ্চিত করে জরিমানা এড়ানো। অন্যদিকে বাজার বা অর্থনীতিভিত্তিক ব্যবস্থায় দূষণ সৃষ্টিকারীর দূষণরোধের জন্য এক ধরনের আর্থিক প্রণোদনা থাকে। এই পদ্ধতিতে পরিবেশকে কিছুটা বাজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়।
আমরা প্লাস্টিক দূষণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে দেখি এই পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে। উন্নত বিশ্বে প্লাস্টিক বোতলের দূষণরোধে 'ডিপোজিট রিফান্ড সিস্টেম' একটি কার্যকরী ও জনপ্রিয় বাজারভিত্তিক পদ্ধতি। প্লাস্টিক বোতল ব্যবহারের পরে সঠিকভাবে সংগ্রহ করা গেলে অনেকাংশে প্লাস্টিক বোতল দূষণ রোধ করা সম্ভব। বোতলজাতকারী বা হোলসেলার যখন প্লাস্টিক বোতলজাত পানীয় খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে, তখন ডিপোজিট বা আমানত হিসেবে প্রত্যেকটি প্লাস্টিক বোতলের মূল্য পানীয় বিক্রির খুচরা বিক্রেতার থেকে রেখে দেয়। আবার খুচরা বিক্রেতা যখন ভোক্তার কাছে পানীয়সহ বোতলটি বিক্রি করছে, ক্রেতাও প্লাস্টিক বোতলের মূল্য ডিপোজিট আকারে জমা রাখে খুচরা বিক্রেতার কাছে। বোতলের পানীয় শেষ হওয়ার পর প্লাস্টিক বোতলটি জমা হয় ভোক্তার কাছে। ওই ভোক্তা তখন নিকটস্থ কোনো খুচরা বিক্রেতা বা সুপারমার্কেটে খালি বোতলগুলো ফেরত দিয়ে তার ডিপোজিট রাখা টাকা ফেরত পায়।
তেমনিভাবে খুচরা বিক্রেতা আবার খালি প্লাস্টিক বোতলগুলো ফেরত দিয়ে হোলসেলারের কাছ থেকে তার ডিপোজিটের টাকাটা ফেরত নিয়ে আসে। ক্রেতা যখন প্লাস্টিক বোতল কেনার সময় প্লাস্টিকের বোতলের জন্য টাকা জমা রাখছে রিটেইলারের কাছে, তখন খালি বোতলগুলো ফেরত দিয়ে তার টাকা ফেরত নিয়ে আসা এক ধরনের আর্থিক প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে ভোক্তার জন্য। ফলে ভোক্তা তার ব্যবহৃত বোতলগুলো জমিয়ে রাখে ডিপোজিটের টাকা ফেরত আনার জন্য। এর ফলে রাস্তাঘাটে প্লাস্টিক আর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে না, নদী-নালা, জলাশয় মুক্ত থাকে প্লাস্টিকের হাত থেকে।
বাজারভিত্তিক ব্যবস্থায় আরেকটি জনপ্রিয় পদ্ধতি পলিউশন ট্যাক্স (দূষণ ট্যাক্স) যা পৃথিবীর অনেক দেশে বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দূষণ ট্যাক্স পদ্ধতির মূল ধারণা এসেছে বিখ্যাত 'পলিউটারস পে প্রিন্সিপাল' থেকে। যখন কোনো শিল্প-কারখানা দূষণ করে, তার জন্য সমাজকে একটা ক্ষতির শিকার হতে হয়। ফলে ওই ক্ষতির পরিমাণ দূষণের জন্য যে দায়ী, সে বহন করবে। এই ক্ষতির পরিমাণ ট্যাক্স আকারে দূষণের জন্য দায়ী প্রতিষ্ঠান থেকে আদায় করা হয়। যে যত বেশি দূষণের জন্য দায়ী, তার ট্যাক্সের পরিমাণও তত বেশি হবে। ফলে দূষণকারী ট্যাক্স এড়াতে নিজ উদ্যোগে দূষণ মোকাবিলায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। এই দূষণ ট্যাক্স কিন্তু সরকারের জন্য বড় একটা রাজস্বের উৎসও হতে পারে। ডেনমার্কে দূষণ ট্যাক্স জিডিপির প্রায় ৪ ভাগ। মোদ্দাকথা, দূষণ ট্যাক্স ও আর্থিক প্রণোদনা দূষণকারীকে নিজে থেকে দূষণরোধের উপায় খুঁজে বের করতে প্ররোচিত করে।
আবার কোনো নির্দিষ্ট এলাকার কোনো নির্দিষ্ট দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে বেশ কার্যকরী বাজারভিত্তিক একটি উপায় 'পলিউশন পারমিট ট্রেডিং সিস্টেম'। যেমন: প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের আলোকে সৃষ্ট 'ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশন' লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাংলাদেশকে ২০৩০ সালের ভেতর ২৭ দশমিক ৫৬ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এই পদ্ধতি বেশ কার্যকরী হতে পারে বাংলাদেশের জন্য।
বাংলাদেশে 'কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল' পদ্ধতি সঠিক ও পরিপূর্ণভাবে পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের যে দক্ষ জনবল ও আর্থিক সক্ষমতা দরকার, তা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই দূষণ রোধে একটি হাইব্রিড ব্যবস্থার প্রচলন জরুরি, যেখানে 'কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল পদ্ধতির' সঙ্গে বাজারভিত্তিক ব্যবস্থাও কাজ করবে। আমাদের যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন দরকার, তেমনি দরকার পরিবেশের সুরক্ষা। তাই নী-তিনির্ধারকদের উচিত 'কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল' পদ্ধতির সঙ্গে বাজারভিত্তিক পদ্ধতিরও চর্চা শুরু করা। একইসঙ্গে প্রণোদনার মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনের প্রক্রিয়াকে কীভাবে পরিবেশবান্ধব করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবুজ প্রযুক্তির স্থানান্তর ও সবুজ অর্থায়নের জন্য কূটনীতিক চেষ্টা জোরদার করতে হবে। 'গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড' ও 'লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডে' জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশের অর্থায়ন নিশ্চিতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের সঙ্গে কাজ করতে হবে। সেই অর্থ ব্যবহার করে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ এবং প্রকল্প হাতে নেওয়া যায়। সর্বোপরি জনগণকে পরিবেশ দূষণরোধে সচেতন হতে হবে এবং পরিবেশ দূষণ-বিরোধী নাগরিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে।
কারীমুল তুহিন: পরিবেশকর্মী এবং সবুজ অর্থায়ন বিষয়ে কর্মরত
karimul100@gmail.com
Comments