মশায় রুচির দুর্ভিক্ষ: ডেঙ্গুর কর্তৃত্ববাদ
প্রস্তুতি জানাতে না পারলেও এবার ডেঙ্গুর বিষয়ে আগাম সতর্কতার জানান দিয়েছেন স্থানীয় সরকার বিষয়ক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। সামনে বৃষ্টির কারণে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়তে পারে বলে শঙ্কা তার। তিনি দাবি করেছেন, তার মন্ত্রণালয় সতর্কতার সঙ্গে এবার আগে থেকেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। কী সেই ব্যবস্থা?
আগেরবার ডেঙ্গুর প্রকোপকে বলা হয়েছিল দেশের উন্নতির নমুনা। যানজটকে দাবি করা হয়েছিল উন্নয়নের দৃষ্টান্ত হিসেবে। বিভিন্ন ধনী দেশে ডেঙ্গু আছে, যানজটও আছে। বাংলাদেশেও আছে। অতএব বাংলাদেশও ধনী দেশ। এ যুক্তিবিদ্যাকে মানুষ নিয়েছিল ট্রল আইটেম হিসেবে। ঢাকা উত্তর সিটির মশারা দক্ষিণে বা দক্ষিণেরগুলো উত্তরে চলে যায়—এ ধরনের কথাবার্তা এবার এখন পর্যন্ত আসেনি। বরং মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে যথারীতি। রোববার সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মন্ত্রী অনেকটা সোজাসাপ্টা তার শঙ্কা জানিয়েছেন। বাসাবাড়ির আশেপাশের জায়গা পরিষ্কার রাখা ও পানি জমতে না দেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। মশা প্রতিরোধে পর্যাপ্ত কীটনাশক রয়েছে বলে আশ্বস্ত করেছেন। এখন পর্যন্ত ভারতসহ আশেপাশের দেশ থেকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে বাংলাদেশ ভালো অবস্থায় আছে বলে দাবি করে সিটি করপোরেশনগুলোকে বলেছেন তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে।
সেই পরিকল্পনাটি কী? কোন সিটির কী পদক্ষেপ? এ সংক্রান্ত তথ্য মানুষের জানার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সভায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে সব রকম প্রস্তুতি থাকার দাবি করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। প্রস্তুতির ধরন ব্যাখ্যার পরিস্থিতি ছিল না বৈঠকে। পরে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তারা অগ্রিম আরও হুইলব্যারো, ফগার ও লার্ভি সাইডিং মেশিন আমদানি করতে যাচ্ছেন। তা নিজস্ব অর্থায়নেই করবেন। তিনি এবার মশা মারতে কামান চাননি। চেয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট। অভিযান চালাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা আরও বাড়ানোর কথা বলেছেন তিনি।
তার যুক্তি—ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফল দেশগুলো বেশি বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে, জরিমানা করেছে। আষাঢ়-শ্রাবণ ও ভাদ্র-আশ্বিন—এ ৪ মাসে ঠিকমতো ১০ জন করে ম্যাজিস্ট্রেট পেলে সাফল্যের ব্যাপারে দৃঢ় আশাবাদ তার। ঢাকা দক্ষিণ সিটির মাঝে কেবল মালিবাগ-শান্তিবাগই ডেঙ্গুঝুঁকিতে—এ তথ্যও দিয়েছেন মেয়র তাপস। চট্টগ্রামের মেয়র রেজাউল করিম জানিয়েছেন, তিনি মশার সঙ্গে পেরে উঠছেন না। খাল ভরাট ও পানি চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ায় তার সিটিতে মশারা খুব কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছে।
জনপ্রতিনিধিরা যার যার জায়গা থেকে মশা ও মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু সম্পর্কে তাদের অবস্থা-অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন। রাজধানী বা শহরাঞ্চলে রুচির অকুলানে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে মশারা। যার জেরে দেশের ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাই চিকিৎসা ও কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, মশারা কেবল মশকরাই করছে না। রীতিমত হামলে পড়েছে। এটাই এদের ধর্ম-স্বভাব। চরিত্র হারিয়ে ভনভন বাদ দিয়ে এখন হাম্বা-হাম্বা ডাকছে না। তাদের যা করার তাই করে চলছে। রুচির দুর্ভিক্ষ কাটাতে বিচরণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজধানীর গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকা থেকে মুগদা-মান্ডায় যেমন ছড়িয়ে পড়েছে; শহর-বন্দর মাড়িয়ে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও আধিপত্য গেড়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মতো নিশ্ছিদ্র জায়গাকে পর্যন্ত ছাড় দেয়নি। দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও কীভাবে মশাদের এমন কর্তৃত্ব, উচ্চ আদালত তা জানতে চেয়েও সদুত্তর পাননি।
মানুষকে কামড়াতে মশাদের এখন দিন-রাত লাগে না। আগ্রাসী হতে শীত-গ্রীষ্ম বা রোদ-বৃষ্টির অপেক্ষা করে না। মশার মাধ্যমে ছড়ানো ডেঙ্গুর ভ্যারিয়েন্ট দিনকে দিনে আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠার বার্তা কবে থেকেই দিয়ে আসছেন চিকিৎসা ও কীটতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা। তাদের কথা আমলে নিতে বিলম্বের জের সইতে হচ্ছে। বিনা মৌসুমেও ডেঙ্গুর কর্তৃত্ববাদের শিকার হচ্ছে মানুষ। এক সময় ধারণা ছিল বৃষ্টিপাত বা বাসাবাড়ির আনাচে-কানাচে জমে থাকা পানি থেকে এডিস মশার বিস্তার হয়। এখন মশাদের শক্তি আরও বেড়েছে। বিশেষ করে এডিস মশার ডিম ৬ মাস পর্যন্ত শুকনো জায়গায়ও বেঁচে থাকতে পারে। এডিসের বাইরে অন্যান্য মশাও ডেঙ্গু ছড়ানোর শক্তি অর্জন করেছে। তারা কেবল বৃষ্টির জমা পানিতে বা কেবল জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্তই প্রজনন করে, সেই ধারণাও অচল হয়ে যাচ্ছে। এবার শীত যেতে না যেতেই আক্রমণকারী মশারা তাদের শক্তি জানান দিচ্ছে। মানুষের থাপ্পড়ের শক্তি প্রয়োগের মাত্রা বাড়িয়েও কাজ হচ্ছে না। মশারিতেও এ মশাদের রুখতে পারা যাচ্ছে না। কয়েল হার মেনেছে কবেই। স্প্রে, ইলেকট্রিক ব্যাটসহ আধুনিক নানা কীটনাশকও সব হার মেনেছে।
মশা মারতে কামান দাগানোকে এক সময় ঠুনকো কাজের উপমা দিয়ে উপহাস করা হতো। তা অসার হয়ে গেছে কবেই। নগর-মহানগরীর মেয়রসহ জনপ্রতিনিধিদের সাফল্যের প্রমাণ অনেকটা নির্ভর করছে তাদের মশা মারার দৃষ্টান্তের ওপর। কামান দাগিয়েও সম্মুখ সমরে মশাকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হয়ে এখন তাদের প্রয়োজনে আণবিক ভাবনায় যেতেও বাধ্য হওয়া লাগতে পারে। অন্তত গত কিছুদিন ধরে কিউলেক্স-এডিস মিলিয়ে নানা জাতের মশার ভয়ংকর হয়ে ওঠা সেই বার্তাই দিচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা নানান বাগাড়ম্বর করলেও ঢাকার ২ সিটি করপোরেশনের এ বিষয়ক বুঝবানরা সাদা চোখেই দেখছেন, মশা মারা মোটেই আর্টিলারির কাজ নয়। তাই তারা ফগিং কমিয়ে বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের দিকে বেশি জোর দিতে চান। কারণ তারা জানেন, একটি বাড়ি বা ভবনে একজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া মানে বাকিরাও ঝুঁকিতে।
বর্তমানে বৃষ্টি না থাকলেও রাজধানীতে মশা উন্নয়ন করপোরেশনের মতো অবস্থায় খাল-নালাগুলো। সেগুলোতে আবর্জনার স্তূপের সঙ্গে বেড়েছে পানির ঘনত্বও। সিটি করপোরেশনের তরল ওষুধ ওইসব করপোরেশনের সব জায়গায় পৌঁছাচ্ছে না। অথচ এ কাজের বাজেটে কমতি নেই। রাজধানীর মশা উন্নয়ন করপোরেশন তছনছ করতে ঢাকার ২ সিটি করপোরেশনের বাজেট শত কোটি টাকা প্রায়।
দক্ষিণে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে কেবল কীটনাশকের জন্য বরাদ্দ আছে ২৫ কোটি টাকা। আগের বছর তা ছিল ছিল ২২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। এর বাইরে দক্ষিণে মশক নিধনে ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিনের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। উত্তর সিটিতে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে বরাদ্দ ৭৬ কোটি টাকা। সেখানে মশার ওষুধ বাবদ বরাদ্দ ৪০ কোটি টাকা। কচুরিপানা, আগাছা পরিষ্কার ও পরিচর্যায় ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন পরিবহনে ৪ কোটি টাকা, আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ২৫ কোটি টাকা এবং মশক নিয়ন্ত্রণে চিরুনি অভিযানে ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এত টাকায়ও নগরবাসী কাবু মশা উন্নয়নের কাছে। এক ঢাকার ২ করপোরেশন মশা বিনাশ করতে বিভিন্ন সময়ে খাল, ড্রেন ও জলাশয়ে গাপ্পি মাছ, তেলাপিয়া মাছ ও হাঁস ছেড়েছে। ড্রোনের মাধ্যমে মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজে ওষুধ ছিটানোও হয়েছে। ডিএনসিসি মেয়রের নেতৃত্বে বিশাল টিম আমেরিকায় গিয়ে প্রশিক্ষণও নিয়ে এসেছে। কাজের কাজ কী হয়েছে? সামনে আর কী বাকি আছে?
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নিবে না।)
Comments