করোনার বিএফ.৭ উপধরন এবং আমাদের করণীয়
ওমিক্রনের একটি উপধরন বিএফ.৭। বর্তমানে চীনে কোভিডের যে ঢেউটি চলছে, তার ৮০ শতাংশ সংক্রমণই হচ্ছে বিএফ.৭ উপধরনের মাধ্যমে। গত ২ বছর চীনে করোনা মহামারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলেও ২০২২ সালের শেষে তা চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে আসা ৪ জন চীনা নাগরিকের একজনের শরীরে বিএফ.৭ উপধরনের সংক্রমণ ধরা পরেছে। দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ৪ আরোহীর সবারই প্রি-ফ্লাইট কোভিড টেস্ট নেগেটিভ ছিল। বিমানবন্দরে র্যাপিড এন্টিজেন টেস্টে তাদের একজনের কোভিড ধরা পরে এবং পরবর্তীতে স্যাম্পল সিক্যুয়েন্সিং করে বিএফ.৭ উপধরন নিশ্চিত করা হয়।
এই খবরে অনেকের মধ্যে কোভিড নিয়ে আবারও ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। ভ্রান্ত তথ্যও ছড়িয়ে পরছে চারদিকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দেশে কি আবারও নতুন করে করোনা মহামারি দেখা দেবে? বিএফ.৭ কি অতিসংক্রামক এবং আগের উপধরনগুলো থেকেও মারাত্মক? বিএফ.৭ সংক্রমণে কি মারাত্মক কোভিড হতে পারে? টিকা নেওয়ার পরও কি নতুন উপধরনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে? চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া যেখানে উচ্চমাত্রায় সংক্রমণ বিদ্যমান, সে সব দেশ থেকে নতুন উপধরনের প্রবেশ বন্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া দরকার? দেশে কি নতুন করে করোনা বিধি-নিষেধ আরোপের প্রয়োজন আছে?
প্রথমত, ওমিক্রনের বিএফ.৭ উপধরনটি মূল ওমিক্রনের চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি সংক্রামক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই উপধরনকে 'ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন' হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। অর্থাৎ বিএফ.৭ সংক্রমণ গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং দরকার হলে তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে হবে।
চীনে চলমান ভয়াবহ করোনা সংক্রমণের জন্য কি এই বিএফ.৭ উপধরনটিই এককভাবে দায়ী? চীনে শনাক্তের আগেই গত আগস্টে বিএফ.৭ উপধরনটি শনাক্ত হয়েছে ইউরোপের বেশ কয়েকটা দেশে। তখন এসব দেশে করোনার কোনো বড় ঢেউ ছিল না। মহামারির শুরু থেকেই চীনে জিরো-কোভিড পলিসি মেনে চলা হয়েছে। এ কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে দেশটিতে করোনা সংক্রমণ ছড়াতে পারেনি। ফলে দেশটির বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোভিডের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ইমিউনিটি তৈরি হয়নি। দেশটির প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা হলেও ওমিক্রন সংক্রমণ প্রতিরোধে টিকা খুব একটা কার্যকর নয়।
২০২২ সালে চীনে যখন জিরো-কোভিড পলিসি শিথিল করা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পরে ওমিক্রনের বিএফ.৭ উপধরনটি দিয়ে।
বাংলাদেশেসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই ওমিক্রনের সংক্রমণ হয়েছে বিস্তৃত পর্যায়ে। যার ফলে জনসংখ্যার একটা বৃহৎ অংশে এই উপধরনের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে ইমিউনিটি। এর ফলে বাংলাদেশে বিএফ.৭ উপধরনটি প্রবেশ করলেও তাতে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য মতে, বিএফ.৭ ওমিক্রনের অন্যান্য উপধরনের চেয়ে বেশি সংক্রামক, তবে মারাত্মক না। বিএফ.৭ উপধরনে আক্রান্ত হলে হাসপাতালে ভর্তি এবং গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি অনেক কম। তবে যাদের উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ বা ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিল রোগ রয়েছে এবং যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি, তাদের ক্ষেত্রে যেকোনো উপধরনের সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে।
যারা করোনার ২ ডোজ টিকা নিয়েছেন বা আগে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তারাও বিএফ.৭-সহ করোনার যেকোনো উপধরনে সংক্রমিত হতে পারেন। বর্তমানের করোনা টিকাগুলো তৈরি মূল উহান উপধরনকে কেন্দ্র করে। ওমিক্রনে মিউটেশন হয়েছে অনেক। এ কারণেই ভ্যাকসিন ইমিউনিটি ওমিক্রনের সংক্রমণ থেকে শতভাগ প্রতিরোধ করতে পারে না। তবে টিকা দেওয়ায় শরীরে যে অ্যাডাপটিভ ইমিউনিটি তৈরি হয়, তা আমাদের ইমিউন সিস্টেমকে যেকোনো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সহায়তা করে। এর ফলেই টিকা দেওয়া শরীরে ভাইরাস সংক্রমণ হলেও তা হালকা উপসর্গ তৈরি করে ৫-৭ দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। এই কারণে সবাইকেই করোনার অন্তত ২ ডোজ টিকা নিতে হবে।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে দেশে বিএফ.৭ উপধরনের প্রবেশ বন্ধ করা যায়? গত ৩ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে এটা পরিষ্কার যে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে করোনার উপধরনগুলোর বিস্তার বন্ধ করা অসম্ভব। তবে বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগে এই বিস্তারের গতি কিছুটা কমানো সম্ভব। করোনার প্রায় ৫০০টি উপধরন চিহ্নিত হয়েছে এবং এই ভাইরাসের মিউটেশন হচ্ছে ক্রমাগত।
যেহেতু বিএফ.৭ তেমন কোনো মারাত্মক উপধরন না, তাই এর প্রবেশ বন্ধে কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন নেই। তবে যেসব দেশে বিএফ.৭ এর সংক্রমণ চলছে সেসব দেশ থেকে আসা সবার জন্য প্রি-ফ্লাইট কোভিড টেস্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে। ফ্লাইটে মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক এবং বিমানবন্দরে আসা করো করোনা উপসর্গ দেখা দিলে বাধ্যতামূলক অনসাইট র্যাপিড এন্টিজেন টেস্ট করতে হবে। টেস্টে করোনা পজিটিভ হলে তাকে ৭ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে রাখতে হবে এবং স্যাম্পল সিক্যুয়েন্সিং করতে হবে উপধরন নিশ্চিত করার জন্য। গণহারে অন-অ্যারাইভাল কোভিড টেস্ট করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। এ ধরনের পদ্ধতি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি অনুসরণ করার পরিকল্পনা করছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, দেশে কি এখনই আবার করোনা বিধি-নিষেধ চালু করার দরকার আছে? এখনই দেশে করোনা বিধি-নিষেধ চালু করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তবে নিজের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরিধান এবং নিয়মিত হাত ধুয়ে যেকোনো ধরনের জীবাণুর সংক্রমণ থেকে অনেকটা রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
আমার মতে, এই মুহূর্তে হাসপাতালগুলোতে করোনা বিধি-নিষেধ প্রয়োগ করা জরুরি। বিশেষ করে হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সবার জন্য মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করতে হবে। এতে করে স্বাস্থ্যকর্মীদের কাছ থেকে রোগীদের করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যাবে। হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা করোনা সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই পদ্ধতি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে বুঝবেন যে আপনি কোভিডে আক্রান্ত? বিএফ.৭ উপধরনে আক্রান্ত হলে সাধারণ লক্ষণগুলো হচ্ছে গলা ব্যথা, সর্দি, হাঁচির সঙ্গে সামান্য জ্বর, মাথা ব্যথা এবং পেটের সমস্যা থাকতে পারে। অর্থাৎ বিএফ.৭ উপধরনে সংক্রমিত হলে তা অনেকটা সাধারণ ফ্লুর মতো মনে হতে পারে। এমন হলে নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে আলাদা রাখুন। ৫ দিনের ভেতরে উপসর্গ চলে না গেলে কোভিড টেস্ট করান। প্যারাসিটামল বা এন্টিহিস্টামিন ছাড়া কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে কোনো রকম জটিলতা ছাড়াই তা ভালো হয়ে যায় ৫-৭ দিনের ভেতরেই। তবে যাদের কোমর্বিডিটি রয়েছে বা যাদের বয়স ৬০ বছরের বেশি, তাদের ক্ষেত্রে কোভিড হলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এতে কোভিডের জটিলতা এড়ানো সম্ভব।
বিএফ.৭ উপধরন নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই এখনই। খুব সম্ভবত এই উপধরনটি দেশে তেমন কোনো বড় মহামারির ঢেউ তৈরি করতে পারবে না।
ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম; এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি; সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
Comments