‘কান্না’ দিয়ে ‘ডাক’ ঢাকা: রাজকূট কেমিস্ট্রি 

‘মায়ের ডাক’ আর ‘মায়ের কান্না’

'মায়ের ডাক' আর 'মায়ের কান্না'। সংগঠন দুটির জন্মই কষ্টদায়ক ঘটনাকে বিষয়বস্তু করে। আবার দুটির আগে-পিছেই রাজনীতি-অতিরাজনীতির সংযোগ। মাঝে পড়ে গেছেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। এ নিয়ে রাজনীতি আর কূটনীতির ধ্রুপদি রসায়ন। কূটরাজের এ সন্ধিক্ষণকে ঘিরে এগোচ্ছে নানা কসরত।
  
গত কয়েক বছর ধরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন 'মায়ের ডাকে' সম্পৃক্ততা বেশি বিএনপির। কারণ গুমের শিকারদের বেশিরভাগই দলটির কারও সন্তান বা স্বজন। 'মায়ের ডাকের' নানা কর্মসূচিতে যুক্ত হন বিএনপির নেতাকর্মীরা। সরকার তাদের অভিযোগকে সেভাবে আমল দিতে নারাজ। অগ্রাহ্য-তাচ্ছিল্যও করছে কখনো কখনো। গুমের নামে কে কোথায় ঘুমাচ্ছেন, বিয়ে করে অজানা জায়গায় ঘুরছেন, পাওনাদারের ভয়ে লুকিয়ে আছেন- ধরনের কথা এসেছে সরকারের তরফে। অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার পথে ভূ-মধ্যসাগরে ডুবে মারা যাওয়াদের নামও গুমের তালিকায় ঢোকানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। আবার গুম নাটকের কয়েকটি অভিযোগ প্রমাণ করেও ছাড়া হয়েছে।
 
হালে গুম নিয়ে জবাব দেওয়ার গরজ দেখায় না সরকার। তবে কিছু যুক্তি দেয়। বাংলাদেশে আগেও বহু গুম হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুম-নিখোঁজ আরও বেশি হয় বলে দাবি মন্ত্রীদের। এর মধ্য দিয়ে গুমের শিকার পরিবারগুলোর কাছে বার্তা পরিষ্কার। বিচার বা স্বজনদের ফেরত পাওয়ার নমুনা না দেখে তারা সরকারের কাছে ধরনা দেওয়া বন্ধ করে দ্বারস্থ হচ্ছেন নানান জায়গায়। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনসহ নালিশ জানাচ্ছেন জাতিসংঘ-যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিদের কাছে। মানবাধিকারসহ বিভিন্ন দিবসে কর্মসুচি পালন ২০১৪ সাল থেকে তাদের নিয়মিত কর্মসূচি হয়ে গেছে। এতে গুমের শিকার পরিবারগুলোর শিশু-বৃদ্ধের বিলাপ নিউজ আইটেম হচ্ছে। তাদের কথাবার্তা সরকারের ঘোরতোর বিপক্ষে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাকেই বিষয়টি সরকারের জন্য বিরক্তিকর, অসহ্যের। তারওপর সরকার নিশ্চিত এর পেছনে বিএনপির বিস্তর সম্পৃক্ততা রয়েছে। গুম হওয়া বিএনপি নেতা সুমনের ২ বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি ও সানজিদা ইসলাম তুলি সংগঠনটির সমন্বয়কারী। এটি মায়ের ডাকের বিএনপি সম্পৃক্ততার যথেষ্ট প্রমাণ।
  
সংগঠনটির জন্মের প্রেক্ষিত সম্পর্কে আঁখি ও তুলি জানান, ভাই নিখোঁজের পর নিজের মায়ের কষ্ট ও অন্য পরিবারগুলোর আর্তনাদ দেখে তারা সংগঠনের নাম রেখেছেন 'মায়ের ডাক'। তাদের ভাই সাজেদুল সুমনসহ ৮ জনকে ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। একসঙ্গে গুম হওয়া সদস্যদের ফেরত পেতে বহু জায়গায় ঘুরেছেন তারা। এ বিষয়ে ক্যাম্পেইন করতে গুমের শিকার ভুক্তভোগী পরিবারগুলো 'মায়ের ডাক' ব্যানারে নানা উপলক্ষে একত্রিত হয়। নিখোঁজদের কানে পৌঁছবে মায়ের ডাক- এমন একটি আবেগী ভাব তাদের।

অন্যদিকে, 'মায়ের কান্নার' আহ্বায়ক কামরুজ্জামান লেলিন জানিয়েছেন, ১৯৭৭ সালে বিদ্রোহ দমনের নামে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। কোর্ট মার্শালে বিচারের আগেই তাদের ফাঁসি কার্যকর করে ফেলা হয়। মায়ের কান্না দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠার কারণেই সংগঠনের এমন নামকরণ উল্লেখ করে লেনিন জানান, হত্যাকাণ্ডের বহু বছর পর ২০১৮ সালে প্রথম জানতে পারেন তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট সাইদুর রহমানের মরদেহ রাতের আঁধারে আজিমপুর গোরস্তানে দাফন করা হয়েছিল। সংগঠনটি সেনা ও বিমানবাহিনীর যেসব সদস্যকে অন্যায়ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তাদের নামের তালিকা প্রকাশ এবং শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে কাজ করছে বলেও জানানো হয়। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, মায়ের কান্নারাও স্বজন হারানোর বেদনাহত। ২০১৪ সাল থেকে পরিচিত মায়ের ডাকের বিপরীতে 'মায়ের কান্না' মাঠে আসে ২০১৮ সালে। বছর খানেক ধরে তারা বেশ চাঙ্গা। সরকারের কাছে তারা বিচার চেয়ে মায়ের ডাকদের মতো নিগৃহিত হয়েছেন ঘটনা এমন নয়। বরং 'মায়ের কান্না'র পেছনে সরকারি মহলের পৃষ্টপোষকতা আর লুকিয়ে রাখার পর্যায়ে নেই। যে আমলেই হোক, গুমে হোক, নিখোঁজে হোক, আর বিচারের নামে অবিচারেই হোক; স্বজনহারাদের বেদনা কেবল ভুক্তভোগী স্বজনরাই জানেন। বাদবাকিদের এখানে সমবেদনা জানানো ছাড়া করণীয় তেমন কিছু থাকে না। কিন্তু, অন্যের শোককে নিজের সুখ বানাতে গিয়ে খোদার আরশ কাঁপানো রাজনীতির এ নোংরা চর্চার মধ্যে আবার কূটনীতিও চলে এসেছে। তাও 'অতি' পর্যায়ে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকা বা হাসি দিয়ে কাশি ঢাকা নয়, এক শোকাহতদের আরেক শোকাহতদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেওয়ার এ রাজনীতির মাঝে আবার খুচরা কূটনীতি। এ কেমিস্ট্রির ক্রিয়া-বিক্রিয়া কোথায় গড়াবে ভাবনার বিষয়। কান্না দিয়ে আর্তনাদ রোখার এ সার্কাস চেয়ে চেয়ে দেখা বিবেকমানদের জন্য বড় বেদনার।
 
সার্কাসটির একটি বিশেষ পর্ব মঞ্চস্থ হয়েছে গত ১৪ ডিসেম্বর। ২০১৩ সালে নিখোঁজ হওয়া বিএনপি নেতা সুমনের শাহিনবাগের বাসায় তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যান মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সকাল ৯টার দিকে বাসাটিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পৌঁছার আগেই জড় হয়ে যান 'মায়ের কান্না' ব্যানারধারীরা। সুমনের বাসায় গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করে ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে সেখান থেকে বের হওয়ার পথে হাস পড়েন বিপত্তিতে। তাকে ঘিরে ধরেন 'মায়ের কান্না'র লোকেরা। ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের ফাঁসি, কারাদণ্ড, চাকরিচ্যুত সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্য পরিচয়ে অবস্থান নেন তারা। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওই বাসায় ঢোকার মুখে তারা প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেন। পিটার হাস মায়ের কান্নার সদস্যদের সঙ্গে কথা না বলে দ্রুত চলে যান। শুরু হয় রাজনীতি-কূটনীতির গোলমাল ও জটিলতার আরেক এপিসোড। সেখান থেকেই তিনি ছুটে যান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে।
 
এর বিপরীতপন্থীরা বলছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্ষতিগ্রস্ত একটি পরিবারের কথা শুনলেন, অথচ ক্ষতিগ্রস্ত আরও পরিবারের স্মারকলিপিটাও নিলেন না। তাই তিনি পক্ষপাত দুষ্ট। যুক্তি যা-ই হোক এ নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্নের ঢেউ খেলছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, পিটার হাস যে ওখানে যাবেন তা তার মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়নি। অর্থাৎ তার মন্ত্রণালয়ের জানা ছিল না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় না জানলেও মায়ের কান্নার লোকেরা ঠিকই জেনেছেন। তার কাছে দূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি দেওয়ার পথে না গিয়ে মায়ের ডাকের জায়গায় গেছেন তারা। স্বজনহারানোর অমানবিক বিষয় নিয়ে এত ক্যারিশমা ভালো দেখায় না। এ ছাড়া বিদেশি কোনো রাষ্ট্রদূত কোথাও গেলে পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়কে জানাতে হয় কি না?; এ প্রশ্নও এসেছে যায়।
 
এর চেয়েও বড় কথা খই ফোটানো মেঠো বক্তব্যগুলো দেশ সম্পর্কে কি ভালো বার্তা দেয়? এর জেরে পুরনো নানা মন্দকাজ ও মন্তব্যও নতুন করে সামনে চলে আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক সাবেক রাষ্ট্রদূতকে কাজের মেয়ে মর্জিনা সম্বোধন, আরেক রাষ্ট্রদূতের গাড়ি আটকে অপদস্থ করা বা দেশটির ঢাকা সফরকারী এক প্রতিনিধিকে ২ আনার মন্ত্রী নামে তাচ্ছিল্যের কথা স্মরণে আনা মোটেই অনিবার্য ছিল না। কিন্তু কাজে-কাজে, কথায়-কথায় চলে আসছে পুরনো দুঃখজনক ঘটনাবলি। সেইসঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও নানা মন্দ কথার খিঁচুনি। যা না পড়ে রাজনীতির মানদণ্ডে, না কূটনৈতিক শিষ্টাচারে। যুক্তরাষ্ট্র তার বিরক্তির কথা চাপা রাখছে না। আবার এ দেশ থেকেও হচ্ছে অতিকথন। কোনোটাই ভালো খবর নয়।
 
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন 

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

14h ago