বেগুনে ক্যানসারের উপাদান, অসৌজন্যমূলক সাংবাদিকতা ও কয়েকটি প্রশ্ন

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বাংলাদেশের একটি অঞ্চলের বেগুনে পাওয়া গেছে ক্যানসার তৈরি করতে পারে এমন কয়েকটি ভারি ধাতু। আর গণমাধ্যমে তা প্রকাশ হওয়ায় টেলিভিশনে আলোচনা অনুষ্ঠানে এসে অসম্মানজনক আচরণ পেলেন গবেষক দলের প্রধান বিজ্ঞানী অধ্যাপক জাকির হোসেন।

দেশবাসীর সামনে তাচ্ছিল্য ভরে তাকে বলা হলো, গবেষণার ফল প্রকাশ করে তিনি 'ক্রাইম' করেছেন, তিনি 'ফৌজদারি অপরাধ' করেছেন।

একাত্তর টিভির ভিডিও ক্লিপটি দেখার সময় ভাবছিলাম, এটা কীভাবে সম্ভব? কোথায় গেল আমাদের শিষ্টাচার? আমি তো কোনো রাজনৈতিক টকশো দেখছি না। আমি দেখতে চেয়েছিলাম সাম্প্রতিক গবেষণাটির ফলাফল নিয়ে প্রধান বিজ্ঞানীর বক্তব্য। কিন্তু যা দেখলাম, তা মূলত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে ৩ জন সাংবাদিকের জেরা, বিষোদগার এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ। এই বিজ্ঞানীর অপরাধ, দেশের জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশ।

গবেষণাটির বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের বেগুনে ক্যানসারের উপাদান। এই খবরটি আমি প্রথম দেখি গত ১ নভেম্বর, একটি অনলাইন পোর্টালে। সেটি ছিল বিস্তারিত এবং যথাযথ। মূল গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের আগস্ট মাসে, বহুল পরিচিত ও প্রসিদ্ধ 'সায়েন্টিফিক রিপোর্টস' পিয়ার রিভিউ জার্নালে।

প্রকাশিত ফলাফলের চুম্বক অংশটি এই রকম: বিজ্ঞানী জাকির হোসেন ও তার দল জামালপুরের ইসলামপুর ও মেলান্দহ উপজেলার কয়েকটি স্থান থেকে বেগুন এবং খেতের মাটি নিয়ে পরীক্ষা করে বেগুন ও মাটি উভয়ের ভেতরেই ক্যানসার সৃষ্টিকারী হেভি মেটাল বা ভারী ধাতু লেড, ক্যাডমিয়াম ও নিকেলের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। এই বিষাক্ত ধাতুগুলোর উপস্থিতি মাটি ও বেগুন উভয় ক্ষেত্রেই স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চ মাত্রায় পরিলক্ষিত হয়। গাণিতিকভাবে ক্যানসার রিস্ক অ্যানালাইসিস করে তারা দেখতে পেয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরে এই উচ্চ হারে লেড, ক্যাডমিয়াম ও নিকেল আমাদের পেটে গেল বিভিন্ন ধরনের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকশ গুণ বেড়ে যায়। তবে তাদের অ্যানালাইসিসে মাটিতে থাকা বিষাক্ত ধাতুগুলো থেকে স্কিন ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

তাদের সাড়ে ৪ কোটি টাকার সরকারি অর্থায়নে গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাবর সুপারিশ হচ্ছে, এই ভারী বিষাক্ত ধাতুগুলো কোন উৎস থেকে বেগুনে প্রবেশ করছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। খেতের জমিতে যে উচ্চ মাত্রায় এই ধাতুগুলো রয়েছে, তা তারা নির্ণয় করেছেন। তবে মাটিতে এই ধাতুগুলো কীভাবে এলো, তা রয়ে গেছে অজানা। তাদের ধারণা, ভারী ধাতুগুলো সার, কীটনাশক বা পানি থেকে মাটিতে প্রবেশ করতে পারে। তবে তা নিশ্চিত করার জন্য দরকার আরও গবেষণা।

এখন ফিরে আসি একাত্তর টিভির একাত্তর জার্নাল অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্লিপটিতে। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করছিলেন মিথিলা ফারজানা। কিন্তু প্রথম মিনিটেই বোঝা গেল, তিনি যে বিষয়ে উপস্থাপনা করছেন সে বিষয়ে তার বিন্দুমাত্র কোনো ধারণা নেই। তিনি একবার বলছেন, বেগুনে ক্যানসারের কোষ, আরেকবার বলছেন ক্যানসারের জীবাণু। প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় অধ্যাপক জাকির হোসেন ভুলটি সংশোধন করে দেন।

তবে সমস্যাটি বাঁধালেন সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টি। তার অজ্ঞতা কোনোভাবেই আর হাস্যকর পর্যায়ে ছিল না। তার আচরণ ছিল দৃষ্টিকটু এবং সম্পূর্ণই শিষ্টাচার বহির্ভূত। অজ্ঞতার বিশাল এক ঝুড়ি আর জাজমেন্টাল মনোভাব নিয়ে তিনি বসে গেলেন একজন বিশিষ্ট গবেষককে জেরা করতে। সাইন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালের নাম তিনি কোনোদিন শোনেননি, পড়া তো দূরে থাক।

তার ধারণাও নেই, একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা কীভাবে হয় এবং এর সঙ্গে গবেষণায় যে অর্থায়ন করে, তার ভূমিকা কী। যদি ধারণা থাকতো তাহলে তিনি আক্রমণাত্মকভাবে প্রশ্ন করতেন না যে সরকারকে আগে না জানিয়ে তারা কেন তাদের গবেষণার ফলাফল সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালে প্রকাশ করেছেন। আসল ব্যাপার হচ্ছে, আমরা যখন গবেষণাপত্র প্রকাশ করি, তখন জার্নালে আমাদের লিখিত স্টেটমেন্ট দিতে হয় যে এই গবেষণার ফলাফল বা তা প্রকাশে অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না। অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের যদি কোনো বিশেষ এম্বার্গো বা নিষেধাজ্ঞা না থাকে, তাহলে গবেষণার ফলাফল কখন বা কোথায় প্রকাশ করা হবে সে সিদ্ধান্তের ভার সম্পূর্ণই প্রধান গবেষকের হাতে। এটাই সাধারণ নিয়ম।

মূল কথা হচ্ছে, এই গবেষণার ফলাফল প্রথমে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এক ধাপে এবং পরে ২০২২ সালের জুন মাসে আরেক ধাপে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। এরপর গত ২২ আগস্ট গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় সাইন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালে। এটা একটা স্বাভাবিক ধারা। এসব তথ্য না জেনেই মাসুদা ভাট্টি অধ্যাপক জাকির হোসেনকে বলে বসলেন, গবেষণার ফলাফল পাবলিকলি প্রকাশ করে তারা 'ফৌজদারি অপরাধ' করেছেন, তারা 'ক্রাইম' করেছেন, কর্তব্যে ভয়াবহ অবহেলা করেছেন।

আসলেই কী তাই? তারা কী সত্যিই অপরাধ করেছেন?

একজন গবেষককে টিভিতে ডেকে এনে জনসম্মুখে এ ধরনের আচরণ কী অসৌজন্যতার বহিঃপ্রকাশ নয়? সাংবাদিকদের কাছ থেকে এ ধরনের শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণ কী অনাকাঙ্ক্ষিত নয়?

গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুলভাবে প্রচারিত হয়, যা জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। এই ধরণের বিভ্রান্তি দূরীকরণে মূলধারার মিডিয়াগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমার ধারণা ছিল একাত্তর টিভির এই লাইভ অনুষ্ঠানটিরও মূল উদ্দেশ্য বেগুনে ক্যানসারের উপাদান শনাক্তের খবরে জনমনে যেন বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয় সেদিকটা তুলে ধরা। কিন্তু অনুষ্ঠানে উপস্থিত সাংবাদিকদের উপর্যুপরি ভুল তথ্যসমৃদ্ধ অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নমালা এবং আমন্ত্রিত বিজ্ঞানীকে কথা বলার সুযোগ না দেওয়ায় অনুষ্ঠানটির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন ক্রমাগত ট্রল চলছে অনুষ্ঠানটিতে অংশ নেওয়া ৩ সাংবাদিকের ভূমিকা নিয়ে। জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ মূল বিষয়টি আড়ালে পরে গেছে।

কিছু প্রশ্নের মাধ্যমে গঠনমূলক আলোচনা হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বের হয়ে আসতো ওই অনুষ্ঠান থেকে। সাধারণ মানুষ সঠিক তথ্যটি জানতে পারতেন। তারা ভয় বা ভ্রান্তি থেকেও বের হয়ে আসার সুযোগ পেতেন। প্রশ্ন হতে পারতো:

১. অধ্যাপক জাকির হোসেনকে জিজ্ঞেস করার সুযোগ ছিল, তাদের গবেষণার ফলাফল কতটুকু নির্ভরযোগ্য। অন্য কোনো দেশেও বেগুনে বা অন্যান্য সবজিতে লেড, ক্যাডমিয়াম বা নিকেলের মতো ক্ষতিকারক ভারী ধাতু অতিমাত্রায় শনাক্ত হয়েছে কি না। হয়ে থাকলে সেসব দেশে ক্যানসারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে কি না।

২. তারা যে বলছেন, এসব ভারী ধাতু উচ্চ মাত্রায় শরীরে প্রবেশ করলে ক্যানসারের ঝুঁকি কয়েকশ গুণ বেড়ে যায়, এটা কিসের ভিত্তিতে বলছেন? তাদের এই রিস্ক অ্যানালাইসিসের ফলাফল কতটা নির্ভরযোগ্য। এ ধরণের পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা কী?

৩. তাদের গবেষণার ফলাফলে দেশের মানুষের ভীত হওয়ার কোনো কারণ আছে কি না? তারা কী বেগুন খাওয়া বাদ দেবেন? কত বছর ধরে সবজি বা ফলের মাধ্যমে এ ধরনের ভারী ধাতু শরীরে প্রবেশ করলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়?

৪. তারা কেন শুধু একটি অঞ্চলের বেগুন নিয়ে পরীক্ষা করলেন? দেশের দক্ষিণ বা পশ্চিমাঞ্চল থেকেও নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হলো না কেন? শুধু বেগুনই বা কেন পরীক্ষা করলেন? অন্য সবজিতেও কি এ ধরনের ভারী ধাতু বিপজ্জনক মাত্রায় থাকার সম্ভাবনা রয়েছে?

৫. আপনাদের পরবর্তী উদ্যোগ কী হবে? মাটি বা বেগুনে এই ক্ষতিকর ভারী ধাতুর পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য সরকার বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? ইত্যাদি।

সবশেষে ওই অনুষ্ঠানের আরেকটি 'অফেনসিভ রিমার্ক' উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করছি।

অনুষ্ঠানের একেবারে শেষের দিকে মাসুদা ভাট্টি কোনো এক উৎস থেকে গবেষক দলের একটি বক্তব্য পড়ে শোনালেন। বক্তব্যটি এই রকম, 'তবে এই বেগুনে জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব উপাদানের উপস্থিতি নিয়ে আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।' তারপর তাচ্ছিল্য ভরে বললেন, 'এসব খুবই ভেইগ কথাবার্তা।' তার কাছে মনে হয়েছে, গবেষকদের এসব 'ভেইগ কথাবার্তা' বাজারের জন্য, মানুষের জন্য খুব 'খারাপ'।

একজন মানুষ কোনো কিছু না জেনে শুধুমাত্র কমন-সেন্সকে পুঁজি করে একটা বিজ্ঞানভিত্তিক বিষয়ের ওপরে কীভাবে একের পর এক উদ্ভট মন্তব্য করে যেতে পারে, তা জানতে হলে সবারই এই অনুষ্ঠানের ভিডিও ক্লিপটি দেখতে হবে। মাসুদা ভাট্টি যে বক্তব্যকে 'ভেইগ কথাবার্তা' বলছেন, সেই ধরনের বক্তব্য দিয়েই পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা পত্রেরই উপসংহার টানা হয়। এটাই নিয়ম। সায়েন্টিফিক রিপোর্টসে প্রকাশিত আলোচ্য গবেষণাপত্রের উপসংহারের শেষ লাইনটাও ছিল এমন যে বেগুন ছাড়াও অন্যান্য শস্য বা সবজিতে উচ্চহারে এই ধরণের ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য দরকার আরও বিস্তর গবেষণা।

আমিও মনে করি সরকারের উচিত এই গবেষণার বিস্তৃতি আরও বাড়ানো। কোন উৎস থেকে এই ভারী ধাতুগুলো মাটি দূষণ করছে, তা জানা অত্যন্ত জরুরি। পানি থেকে ধাতুগুলো আসছে কি না, সেটাও দেখার বিষয়। উৎস জানতে পারলেই তা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এর জন্য দরকার বড় পরিসরে মাল্টিডিসিপ্লিনারি গবেষণা। দেশে আর্সেনিক বিপর্যয়ের কথা আমাদের সবারই জানা। খাদ্যে মাত্রাতিরিক্ত ভারী ধাতুর উপস্থিতি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি।

ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম, এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি, সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য

(দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দ্য ডেইলি স্টার কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দ্য ডেইলি স্টার নেবে না।)

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

6h ago